(১)
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, আমার হাতে এখন পাঁচ - তিন সাইজের একটা ছবি। একটা মেয়ের ছবি। রোগা পটকা একটা মেয়ে। বয়সটা ঠিক ধরা যাচ্ছেনা। তবে কুড়ির বেশি না। তেল চটচটে চুলে বেণী করা তার। দিনের আলোতে তেলেভরা চুল গ্রীষ্মের দুপুরের টিনের চালের মত চকচক করছে। মুখে হালকা হাসি। দাঁতগুলোও সারিবদ্ধ হয়ে গজায়নি; আঁকাবাঁকা। গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা। আর পরনে জ্বলে যাওয়া পুরোনো কমলা রঙা একটা শাড়ি। বোঝাই যায়, গ্রামের মেয়ে । হাতের ছবিটা আপতত এসবই বলে দিচ্ছে।
.
অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই বাবা ছবিটা হাতে দিলেন। বললেন, "এটাই শেষ"। বুঝলাম, আর গতি নেই। গত কয়েক বছর ধরে আগডুম বাগডুম বলে অনেক পালিয়েছি। এবার বাঁচার আর কোন পথ নেই হয়তো। বিয়ে এবার করতেই হচ্ছে। তা নাহয় করলাম। তাই বলে একে! এমন গেঁও ভুত আর ক্ষ্যাত টাইপের মেয়ে ঘরে আনলে মান ইজ্জত আর এক ফোঁটাও থাকবেনা। কি বলবো সবাইকে? মুখ দেখাবো কিভাবে? বিয়ের আগেই বাসা ছেড়ে ভাগবো ঠিক করলাম। তারপর কি যেন একটা ভেবে সে চিন্তা মাথা থেকে সরালাম। বাবার কথা ভেবেই হয়তো।
.
বাবার শুকনো মুখটা কেমন যেন ভয় করে আমার। মায়া করে। বুকের মাঝখানটা নাড়িয়ে দেয়। মানুষটা বেশ অদ্ভুত রকমের। কেমন যেন!
মা মারা যাবার পরও বাবাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি আমি। মনমরা হয়ে পড়ে থাকে শুধু। প্রশ্ন করলে একগাল হাসি দেয়; শুকনো হাসি। যে হাসিতে সুখ নেই। অনেক অনেক কষ্ট লুকোনো থাকে। মানুষ কতটা শক্ত হলে কষ্ট লুকিয়ে হাসতে পারে, বাবাকে না দেখলে বোঝা অসম্ভব। সব ভুলে বাবার কথা ভেবেই এই ক্ষ্যাত মেয়েটাকে বিয়ে করবো ঠিক করলাম। আমার অশুভ আর বাবার জন্য শুভ এই খবরটা ওনাকে জানাতে বারান্দার দিকে এগুলাম। মা যাবার পর এখানটাই বাবার সঙ্গী। সকাল বিকাল বাবাকে চায়ের কাপ হাতে এখানে পাওয়া যায় ওনাকে। এক কাপ শেষে করে আরেক কাপের অর্ডার। তারপর বুয়া এসে দিয়ে যায়। এভাবেই দিন চলে বাবার।
.
বারান্দায় এলাম। বাবা চশমাটা পাশের টেবিলে রেখে চোখ বুজে ঝিমাচ্ছেন। আমি ওনার কাঁধে হাত রাখলাম। বাবা হালকা করে চোখ খুললেন। আমি আমার সম্মতির কথা বললাম। জানি, এখন তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে খুশিতে কেঁদে দেবেন। তারপর সবাইকে ডেকে বলবেন, "শোনো, আমার হিমুর বিয়ে"। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। বাবা "ওহ" বলে আবার চোখ বুজলেন। অবাক হয়ে বললাম,
"বাবা, তুমি খুশি হওনি?"
"না"
"কেন বাবা?"
"খুশি হবার কি আছে? বিয়ে এবার তোর করতেই হতো। নাহলে বাসা থেকে খ্যাদাইতাম না তোরে?" চোখ কটমট করলো বাবা। যদিও বয়স কম হয়নি আমার। তবু ছোটবেলায় বাবার কিলানি গুলা মনে পড়ে ।
আমি কোনমতে কেটে পড়লাম। আমাকে সরে যেতে দেখে বাবাও চোখ বুজে ঝিমানোতে মন দিলেন।
.
.
(২)
আজ আমার বিয়ে। ইয়ে মানে, আমাদের বিয়ে। মেঘলা আর আমার। ‘মেঘলা’, সেই তেল চটচটে ক্ষ্যাত মেয়েটা। বিয়ের আসরে বসে আমরা।
দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বেশ নাজেহাল অবস্থা। কোরবানির আগে কোরবানির পশুর যেমন অবস্থা হয়, অামার অবস্থা ঠিক তেমনই। খুব করে চাইছি, কিছু একটা মিরাকল হোক। দোয়া-দরুদ পড়ছি আমি। মনে প্রাণে উপরওয়ালাকেই ডাকছি শুধু। এত ডাকাডাকির পরও তিনি সাড়া দিলেন না। সাড়া দিলেন কাজী সাহেব। ব্যাটা পাজি, আসছে আমার কুরবানী করতে। কিসব সুরা পড়ে দুজনকেই কবুল বলতে বললেন। রসকসহীন 'কবুল' বলতে হলো তিনবার। রিক্সার হুডের মত মস্ত এক ঘোমটার আড়াল থেকে মেঘলাও ‘কবুল’ বলে দিলো। কুরবানী হয়ে গেল আমার। আমার স্বাধীন জীবনের। আমার আসমান - জমিন সব এক লাগতে শুরু করলো। দুনিয়া ঘুরছে যেন আমার।
.
বিয়ে শেষ। যাবতীয় ভদ্রতা সেরে পোটলা পুটলি গুছিয়ে নিলাম।
.
.
(৩)
গাড়ি এসে বাসার সামনে দাঁড়ালো।
অকালপক্ক কিছু ছেলে মেয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ করতে করতে একপ্রকার তুলে নিয়ে গেল আমাদের । মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা আমার এসব। ধমক দিয়ে সরালাম বদের হাড়িগুলোকে। সব এক এক করে কেটে পড়লো।
.
বাসার বারান্দা, বাথরুম, কিচেন সবখানে ঘাপটি মেরে বেড়াচ্ছি। কোনভাবেই ঢুকবোনা মেয়টার সাথে ঐ অন্ধকার ঘরে। তবুও কিভাবে জানি আমার লোকেশান ট্র্যাক করে ফেললো বাড়ির পুচকি রাডারগুলো। নানী- দাদী, আর ভাই বোন গুলো এসে ধরে নিয়ে গেলো আমাকে। অনিচ্ছা সত্বেও ভরে দিলো জেলখানার মধ্যে। ঢোক গিলে টিপ টিপ পায়ে গেলাম। মেঘলা, মানে আমার বউ; হাত-পা-চোখ-কান সব ঢেকে আছে। আমি আস্তে করে শুয়ে পড়লাম। একটু পর আমার নাক ডাকার শব্দ শোনা গেলো।
.
সকাল ছয়টা। ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলাম। পাশে মেঘলা। বসে আছে সেও। কাল যেভাবে বসে ছিল, ঠিক সেভাবেই। একই শাড়ীতে। অবাক হলেও বুঝতে দিলাম না। যেন কিছুই হয়নি। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি সে উধাও। নেই সেখানে। বের হলাম জেলখানা থেকে। সবাই আড় চোখে দেখছে আর মিটমিট করে শয়তানি হাসি দিচ্ছে। মনে মনে বললাম, “হাসো হাসো। যা ভাবছো, তার কিছুই হয়নি। আর হবেও না কখনো।” কাউকে তোয়াক্কা না করে পুরো বাড়ি একবার পাক খেলাম।
পড়লাম এক বুড়ির হাতে। দুরসম্পর্কের নানী। কিল দিয়ে বললো, “কিরে! বউ খুঁজতে বের হয়েছিস?” সবাই আট হালি দাঁত বের করে হেসে দিলো। ছি ছি! কি বেইজ্জতি! মানে মানে সরে পড়লাম।
মাসখানেক কেটে গেল এভাবেই। সবার দৃষ্টি এড়িয়ে আমাদের সুখে থাকার নাটকটা ভালই চলছে।
.
(৪)
শীত শেষের দিকে। বসন্তের আগমনী চলছে। ছুটির দিন। কেন যেন বিরক্ত লাগছে সবকিছু। ম্যাড়ম্যাড়ে বিকেল। ছাদে এলাম গায়ে বাতাস লাগাতে। হাঁটছি আর আকাশ দেখছি।
.
কোণার দিকটায় কে যেন একটা দাঁড়ানো। মেঘলা? না তো, এখন তো তার এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু ওটা মেঘলাই। ছাদের কোণটায় আমার লাগানো লেবু গাছটার পাশে দাঁড়ানো। হালকা বেগুনী আর নীলচে ধাঁচের একটা শাড়ী। মাথায় ছোট্ট করে ঘোমটা দেয়া। আচমকা হাওয়ায় ঘোমটা টা পড়ে গেল। খোলা চুল। বাঁধনহারা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। মেঘলার পাশে। হাতে সাতরঙা চুড়ি। চোখে কাজল আঁকা। আমায় দেখে ঘোমটা টা বড় করে দিল ও। মুখটা দেখা যাচ্ছেনা। আমি মেঘলাকে ডাকলাম। ও সাড়া দিচ্ছে না। আবারো ডাকলাম….
- মেঘলা
- জ্বি বলেন
- আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। অনেক বড় অন্যায়। তাইনা?
.
মেঘলা উত্তর দিলো না। আমি আবারো ডাকলাম মেয়েটাকে।
- মেঘলা?
- কিছু বলবেন?
- ভালবাসি তোমাকে। আমার মত অপদার্থকে ভালবাসা যায়না? সুযোগ দেয়া যায়না একবার?
.
মেঘলা মাথা নিচু করে চলে যেতে চাইলো। আমি বাঁধা দিলাম। যেতে দিলাম না। হাতটা ধরলাম ওর। সাতরঙ্গা চুড়িগুলো রিনিঝিনি শব্দে বেজে উঠলো। শেষ বিকেলের আলোয় বড্ড মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে। তার মুখটা আলতো করে উপরে তুলে ধরলাম। চোখদুটো চকচক করছে মেয়েটার। অশ্রুগুলো বিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়বার আগেই আমি ভালবাসা দিয়ে মুছে দিলাম। হাতে হাত রেখে বললাম, “দেখে নিও, আর কখনো কাঁদতে দেবোনা তোমায়”। মেঘলা হয়তো ভরসা পেলো। আমার হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরলো মেয়েটা। কিন্তু কিছু বলছেনা।
.
বুঝলাম, এ অভিমান বহুদিনের। ভাঙ্গতে সময় তো একটু লাগবেই । তবে এতটুকু আমি জানি, মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালবেসে ফেলেছি। আর মেয়েটাও আমাকে…..