ভাঙ্গাচোরা অন্ধকার একটা ঘর। শুয়ে আছি খটখটে শক্ত একটা বিছানায়। গুমট আবহাওয়া আর ভেপসা গরম। আলো বাতাসের সুব্যবস্থা নেই একদমই। শক্ত বিছানায় আরাম আয়েশ করে শোবারও জো নেই। চব্বিশ ঘণ্টা অন্ধকার করে রাখা হয় ঘরটাকে। রাত দিনের তফাত এখান থেকে বোঝা অসম্ভব। এক কথায় জেলখানার কয়েদীর মত জীবন পার করছি। জেলখানাই বটে। দম বন্ধ হয়ে আসে। থাকা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যপার। তবে কষ্টটা কমে যায়, যখন ভাবি, আমি একা না। এ তল্লাটের প্রতিটা বাসিন্দার একই অবস্থা।
স্কুলে থাকতে যখন নিয়ম করে গনিতে ফেল মারতাম, রেজাল্টের দিন আমাকে দেখা যেত সব ফেল্টুসদের ভীড়ে। ফেলের ভীড়ে নিজেকে একা মনে হতোনা আর । যখন দেখতাম, ওদের অবস্থা আরো করুণ। নিজের মাঝে একটা সুখ অনুভব করতাম।
এখানেও আমি একা নই। এইতো, পাশের ঘরটা মতিন সাহেবের। মতিন কাকা। আমার কুড়ি বছর, ছয় মাস, পাঁচ দিনের বড়। বড় হলেও সুখ-দুখের সব কথা তার কাছে পেতে বসি। মন খারাপ ভাব চলে যায়। ভাবতে ভাবতেই মতিন সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন।
- "কিরে হিমু, কান্দিস ক্যা?"
- "কাকা, আমাকে বলছেন?"
- "না!! তোর ঘরে তোর শশুড় কান্দে"
চোখ হাতড়ে দেখলাম। ভিজে আছে। আমিই কাঁদছি! বুঝতেই পারিনি।
- "হেহে। কাকা, কেমনে বুঝলা তুমি!!?"
- "বয়স তোর বেশি না আমার? কাঁন্দিস না রে বাপ। সব ঠিক হয়ে যাবে। কে এসে তোরে ঠকালো। আর তুই শুয়ে বসে দিন রাত কাঁদবি? বাপ মার কথা ভাইবা কান্দবি। কাজে লাগবে।"
হু হু করে কেঁদে দিলাম আমি। বাবা-মা, ভাই-বোন!!! কেমন আছে ওরা?! আমার কথা কি এখনো মনে পড়ে ওদের? রূপা মেয়েটাই বা কেমন আছে? আছে হয়তো ভালই। মতিন কাকা জানেন ওর কথা। আমার সব কথাই জানেন উনি। আমিই বলেছি। আনন্দের কথা বললে বাড়ে। কষ্টের কথা বললে কমে। কষ্ট কমাতেই বলেছি। মতিন কাকাই এখানে আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু সবকিছু। কান্না পেলে বলি। বলি, হাসি পেলেও। একসাথে হাসি, কান্নাগুলোও একসাথে। এইতো, বছরখানেক আগে ওনার সাথে দেখা এখানে। গত রমজানের ঈদের দুদিন পরে এলেন এখানে। ভারী গলা। কথা বলতেই ভয় করে। আস্তে আস্তে মনে হলো মশকরা করবার মত লোকটা। হাসি ঠাট্টায় থাকি এখন।
তিন ছেলেমেয়ে ওনার। বড় দুই ছেলে আর এক মেয়ে। দুই ছেলে বউয়ের অত্যাচারে এখানে এসে উঠেছেন। সপ্তাহে নিয়ম করে দু তিন বার ওনার জীবনের গল্প শুনি। বলা শেষে থম মেরে থাকেন। একটু পর নাক টানার শব্দ শোনা যায়। কাদেঁন উনিও। তবে শব্দ হয়না। টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে। অন্ধকারে দেখা যায়না। কিন্তু সে পানি পানি পড়ার শব্দ আমি শুনতে পাই।
- "কাকা, শুনছো?"
- "হ রে.... ক"
- "কাকা!"
- "হু"
- "জানো কাকা! রূপা অনেক রূপবতী ছিল। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মত। সেদিন যখন ও আমায় লাল গোলাপগুলো দিয়ে বললো, "ভালবাসি হিমু"। খুশি হতে পারিনি। অবাক হয়েছিলাম। জানতাম, এ সবই রূপার আবেগ। বয়স আর কত ওর! সতেরো কি আঠারো হবে। কতটুকুই বা বোঝে ও! ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন প্রথম রূপাকে কাঁদতে দেখলাম। বাড়ি ফিরে সেদিন রাতে ঘুমোতে পারিনি। ওর কাজল ভেজা কালো অশ্রুগুলো আমারো ভেতরটা ছুঁয়ে গেল। তারপর এক সপ্তাহ ঘরে ঘাপটি মেরে থাকলাম। ওর সামনে যাবার সাহস হয়নি। সপ্তাহ শেষের কোন এক বুধবার। মা এসে বলে গেল, “তোর বান্ধবী এসেছে” । আঁৎকে উঠলাম। সাত কূলে আমার কোন বান্ধবী নেই। মা নিশ্চই গাঁজা সেবন করেছে। উঠতে যাবো তখনই নীল শাড়িতে রূপাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। অনুমতির তোয়াক্কা না করে পাশে এসে বসলো । এতটা সুন্দর হয় কেউ! এত সুন্দর ও! ভাবা যায়? আনমনে বলে ফেললাম, “ভালবাসি” । দরজার আড়ালে আড়ি পেতে থাকা ছোটবোন খিক করে হেসে দৌড় দিল। চরম বেইজ্জতি! লজ্জায় মুখ লাল, নীল, হলুদ, সবুজ হয়ে গেলে আমার । রূপা মিটমিট করে হাসছে তখনও। শুরুটা এভাবেই ছিল। বড়রা বলেন, সুখের সময়গুলো তাড়াতাড়ি ফুরোয়। হলোও তাই। চারটা বছর কিভাবে যেন পেরোলো। চার বছরের প্রেমজীবন পার করে ভাল ডাক্তার ছেলে পেয়ে যখন রূপা আমায় ভুলে গেল! তখন আমি আর কিছু ভাবতে পারিনি, জানো কাকা!!! রূপার অাবেগের সময়টায় ও এসছিল আমার জীবনে। আবেগের শেষে চলে গেল। আগে আবেগ ছিলনা আমার। এখন একটুতেই কাঁদি। হাসিও অল্পতেই।”
মতিন কাকা “হু… হা…” করে যাচ্ছে তখন থেকে। জোরে সোরে হাক দিলাম।
- “কি গো কাকা, শুনছো?”
- “হ্যাঁ রে, শুনি।”
আমি জানি কাকা শুনছে না। গত কয়েক মাসে এ গল্প কয়েকশোবার শোনা হয়ে গিয়েছে ওনার। নতুন গল্প পাইনা। এক গল্পই বলি।
- “কাকা, তোমার আর কাকীর প্রেমের গল্পটা আরেববার বলোনা। বহুদিন শুনিনি।”
- “বহুদিন! গত পরশুই না শুনলি?”
- “পরশু শুনেছি?”
- “হ্যাঁ রে”
- “আজ আরেকবার শোনাও না”
- “আজ নারে। কাল শোনাবো”
- “আচ্ছা কাকা”
কাকাকে দেখলে আমার হিংসে হয়। প্রেমের বিয়ে ছিল ওনার। তিন বছর প্রেম করে যখন সালেহা কাকীর বিয়ে ঠিক অন্য কোথাও। কাকা ওনাকে নিয়ে সেই যে ভাগলো। আর দেখা নেই। বিয়ে সাদী করে লম্বা ঘোমটার বউ নিয়ে হাজির হলো দেড়মাস পর। পরে নাকি সবাই মেনে নিয়েছিল। আমিও ভাগতাম। রূপা থাকলে আমিও লম্বা ঘোমটার বউ নিয়ে হাজির হতাম। সবাই মেনে নিতো। কিন্তু কিভাবে? রূপাই তো বলে দিলো শেষ দেখার সময়,
“পালাতে চাইছো? খাওয়াবা কি আমাকে? তুমি অনেক ভাল ছেলে। অনেক ভাল মেয়ে পাবা। আমাকে ভুলে যেও। পারলে মাফ করে দিও।”
সেদিন ওকে কিছু বলতে পারিনি। কান্না আসেনি চোখে। শুধু হেসেছিলাম। তারপর রাস্তা দিয়ে হাটতে গিয়ে পেছন থেকে ট্রাক টা ধাক্কা মারার পর সেই যে ঘুমালাম। সে ঘুম ভাংলো এই ছোট্ট ঘরটায়। বাবা-মা, ভাই-বোন কাউকেই দেখা হয়নি আর। প্রথম প্রথম এসে মাটির দেয়ালের আড়াল থেকে দেখে যেত আমাকে। মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম আমি। অশ্রুগুলো চোখ থেকে মাটি বেয়ে আমার বুকে এসে পড়তো। তারপর বহুদিন কেটে গেল। অনেকদিন কেউ আসেনা আমাকে দেখতে। কে জানে! কেমন আছে ওরা! হয়তো ভালই।
- “কাকা শুনছো?”
ওপাশ থেকে কোন সাড়া নেই। কাকা ঘুমোচ্ছে? ঘুমোক। একা থাকতে হবে এতক্ষণ। আচ্ছা, রূপা মেয়েটা কেমন আছে? আছে হয়তো ভাল। ভাল থাকতেই তো চলে গিয়েছিল। সবাই ভাল থাকতেই চলে যায়।
প্রতিবেশীদের কাছে শুনলাম রূপার শশুড়বাড়ি নাকি আশেপাশেই। একবার ওর সাক্ষাত পেলে মন্দ হতোনা। ভাবছি, একটা চিঠি লিখবো। অপ্রকাশিত চিঠি। চিঠিতে অনেক কিছু লিখবো। ছোট ভাইবোনের কথা থাকবে। বাবা-মার কথাও লিখবো। মতিন কাকার কথা থাকবে ওতে। মতিন কাকার ভেগে গিয়ে বিয়ে করার কথাও লিখবো। থাকবে রূপার কথাও। যার কোন প্রাপক থাকবেনা। শুধু প্রেরকের ঠিকানায় লেখা থাকবে-
“হিমু…
আজিমপুর কবরস্থানের সর্বদক্ষিণের পুরোনো একটা কবর।”
#GMHimu
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:১৭