somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোল আলু

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(১)
ভার্সিটির শেষ বর্ষের স্টুডেন্ট তখন।
চুন খসে যাওয়া দেয়ালে ঘেরা ক্লাসের ভাঙ্গা বেঞ্চিতে বসে পড়াশুনো চলতো আমাদের। চারপাশটায় আধুনিকতা ছিলনা তেমন। তবে ছিল একগাদা ভাল সময় আর হাজার হাজার রঙিন স্বপ্ন। মুহুর্তগুলো আজও চোখে ভাসে আমার। ক্যাম্পাসে সবাই যখন গোল হয়ে বসে বসে বিড়ি ফুঁকতো আর খোশ গল্পে মজে যেতো। আমার তখন কাজ ছিল ক্যাম্পাসের পুকুরের ধারের মেহগনি গাছের পাশটায় বসা। সহপাঠীরা তখন চুটিয়ে প্রেমগাড়ি চালাতো। ওসবেও আমার মন ধরতো না। চরম বিরক্তিকর ব্যাপার স্যাপার।

পুকুরের পাড়টা ক্যাম্পাসের পেছনের দিকটায়। বিকেলের আলোটা ডানপাশ থেকে পড়তো। ঘড়ি ধরে যেতাম। আসতামও একই নিয়মে। সাথে থাকতো কোন একটা কবিতার বই। বিকেলের সোনালী আলোটা একটু একটু করে উবে যেতো। ছায়াটাও দীর্ঘ হতো। কবিতার পৃষ্ঠাসংখ্যাও বাড়তো। একটা সময় আলোগুলো মিলিয়ে যেতো । আমি উঠে পড়তাম।

ঘটা করে বলার মত তেমন কোন বন্ধু ছিলনা আমার। বিড়ি ফোঁকার অভ্যেসটা ছিলনা বলেই হয়তো। নয়তো, গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতা ছিলনা বলে। ছেলেবেলা থেকে তোতলানোটা আমার বেশ পাকাপোক্ত। বড় হতে হতে কিছুটা কমলেও পুরোটা যায়নি। এখনও রয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে কতবার যে মাথা নিচু হয়েছে, তা হিসেব ছাড়া। বেশ অস্বস্তিকর বটে। তাই কারো সাত পাঁচে যেতাম না। এমনি করেই সরে এসেছি সবার থেকে। আমার সাথেও কেউ মিশতো না তেমন একটা। কেনই বা মিশবে। আমার মত গোঁ ধরে থাকা মানুষের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

কোন এককালে ফিজিক্স স্যারের মেয়েকে ইংরেজী পড়ানোর জন্য আমাকে ঠিক করা হলো। পড়ানোর প্রথমদিন ছিল সেদিন। ঢুকতেই, ছাত্রী বিশাল সালাম দিয়ে তার পড়ার ঘরে নিয়ে গেলো। তারপর কি কি সব বললো, “স্যার, কোথা থেকে শুরু করবো পড়া?” উত্তরে আমি বললাম, “ওয়ালাইকুম আসসালাম”। এ টিউশনি টা একমাসের বেশি টেকেনি আমার। খুবই স্বাভাবিক। ছেলেপুলে হবে চটপটে। আমি ঠিক তার বিপরীত।

তো, নিয়ম করে কবিতা পড়া চলতো। বইয়ে মুখ গুঁজে সময়টা বেশ ভালই যাচ্ছিলো আমার...

(২)
সেদিন ছিল সেপ্টেম্বরের সপ্তম দিন।
কিটমিটে গরম পড়লেও বিকেলের বাতাসটা বেশ আরাম দিচ্ছিল। গরম টা গায়ে লাগছিলো না। কেমন যেন স্বর্গীয় একটা অনুভূতি! হাতঘরিতে দেখলাম বিকেল নামার সময় হয়েছে। বইটা ডান হাতে করে আমার গাছতলায় হাঁটা ধরলাম। যতদূর চোখ যায় তাতে মনে হচ্ছে, কেউ একজন আমার জায়গাটা দখল করেছে। হাতে কি নিয়ে যেন নেড়ে চেড়ে দেখছে। গায়ে লাল জামা পড়ে আছে। মেজাজটা তেঁতে গেলো একবারে। ঠিক করেই নিয়েছি গিয়েই কান সমানে একটা দিয়ে পুকুরে ফেলে দেবো। পরের হিসেব পরে হবে। আমার জায়গা দখল করে! কত সাহস তার!

কাছে গিয়ে কিছু বলার আগেই একটা মেয়ে বেরুলো ওখান থেকে। বেশ বিপত্তিতে পড়লাম। পরনে লাল রঙা তাতের শাড়ি, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়িগুলো পড়েছে মেয়েটা। রিনিঝিনি করে বেঁজে উঠলো চুড়িগুলো। মোটামুটি হাইটের গোলগাল দেখতে মেয়েটা। চোখে গোল ফ্রেমের একটা বড় চশমা।
মেয়েটা বলতে শুরু করলো..

- আজ এত দেরী যে? পাঁচটা তো সেই কখন বেঁজেছে!

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমার নজর মেয়েটার হাতের দিকে। হাতে কি ওটা?! কয়েক মুহুর্তে অনেক কিছু ভেবে নিলাম। উত্তর না পেয়ে মেয়েটা আবার শুরু করলো।

- কি হলো? উত্তর দেবেন না?

উপায় না পেয়ে মুখ খুলতেই হলো..

- কে আপনি? আমার জায়গা দখল করেছেন কেন? আমার জায়গা আমাকে ফেরত দিয়ে দিন। নাহলে পুকুরে ফেলে দেবো কিন্তু।

মেয়েটা হেসে দিলো। গালে টোল পড়েছে। হাসলে মেয়েটাকে বেশ মানায়। কেমন যেন সবকিছু পাল্টে যেতে লাগলো। চিন্তা ছেড়ে বললাম,

- কি হলো হাসছেন কেন? ভয় টয় নেই নাকি মনে? ধাক্কা দেবো, দেখবেন?
- আমি সাঁতার জানি জনাব। আমাকে ওসবের ভয় দেখিয়ে লাভ হবেনা। নিজে যে সাতার জানেন না তাই বলে সবাই কি জানবেনা? আপনাকে দেই ধাক্কা? কেমন হবে?

আবার হেসে দিল মেয়েটা। বেশ বিপদে পড়েছি। আমি যে সাঁতার জানিনা, এটা জানলো কিভাবে মেয়েটা? এখন যদি সত্যিই ধাক্কা দেয়! কিছুটা নরম হলাম। কিছু বলার আগেই খামে মোড়ানো জিনিসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটা বললো,

- বাড়ি গিয়ে খুলবেন ওটা, রাত বারোটায়। আগে যদি খুলেছেন, ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলবো আপনাকে।

মেয়েটা আবার হাঁসছে। হাসি এতটা সুন্দর হয় কারও, জানা ছিলনা। শাড়ির কুচিগুলো এলোমেলো হয়ে আছে মেয়েটার। কি যেন বলতে চাইলো মেয়েটা। আবার, “নাহ্ থাক” বলে থেমে গেল। নিজেই কুচিগুলো সাজিয়ে নিয়ে হাঁত নাড়াতে নাড়াতে চলে গেল মেয়েটা। মেয়েটার টোল পড়া হাসি, চঞ্চল এক জোড়া চোখ, গোল আলুর মত মুখটা, আর হাতের সেই চুড়ির শব্দ; বেশ ভাবাচ্ছে আমায়। একটু একটু করে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল মেয়েটা। হাতের খামটায় নজর গেল আমার।

ঘরে গিয়ে বসে আছি। বারোটা বাজতে ঢের দেরী। ছটফটানি বেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

(৩)
ঘরিতে ১২টা..
খামটা খুলতেই দেখলাম আরো দুটো খাম। একটায় চিঠি। আরেকটায় কি একটা! বোঝা যাচ্ছেনা। চিঠির খামটা খুললাম শুরুতেই। বেশ গোটা গোটা মেয়েলী হাতের লেখা। পড়তে শুরু করলাম।

“মাননীয় হিমু সাহেব,
কেমন মানুষ আপনি? একটা মেয়ে আপনার জন্য একটা গিফট নিয়ে পুকুর পাড়ে একা একা বসে এতগুলো মশার কামড় হজম করলো। আর আপনি কিনা আমার নামটাও জানতে চাইলেন না?”

আসলেই তো। নামটা জানা হয়নি তো। ছি ছি, লজ্জা লজ্জা। তবে মেয়েটা কিভাবে জানে, তার নামটা জানতে চাইবো না! ঠিকই তো। আমার মত সমাজ-বিচ্ছিন্ন মানুষের কাছে এসব খুব স্বাভাবিক। বেশ ভুল হয়েছে। পরে বার দেখা হলে নামটা জেনে নেয়া যাবে। আবার পড়তে শুরু করলাম।

“কি ভাবছেন? ভুল করে ফেলেছেন বুঝি? এত ভাবতে হবেনা। আমি মেঘলা। আপনার ভার্সিটির কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর হুম, আজ যে আপনার জন্মদিন, ভুলে গিয়েছেন তাইনা? খুব স্বাভাবিক। তবে এসব হিসাব পরে মেটাবো। পাশের খামটায় নীল রঙা একটা পাঞ্জাবী আছে। অনেক শখ করে এনেছি। কাল আপনার প্রিয় জায়গাটায় আমি থাকবো। সকাল সাড়ে দশটায়। আসবেন? উত্তরটা আপনার কাছেই থাক..”

মেয়েটা আর কিছু লেখেনি। শিরদাড়ায় কেমন যেন ঠান্ডা একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। রাতে ঘুম হলোনা ঠিকমত। ভোর রাতে হালকা তন্দ্রা এসেছিল শুধু।

সকাল হয়েছে। মেঘলার দেয়া পাঞ্জাবীটা পড়ে বের হলাম। পুকুর পাড়টায় আসলাম। ও নিজেও নীল পড়েছে আজ। মায়াবতী বললে ভুল হবেনা। হয়তো বেশিই হবে আরো।
ও বসে আছে । আমাকে দেখেও উঠলোনা। শুধু বললো,

- পাটকাঠির মত দেহটা নিয়ে গোল আলুর মত দেখতে একটা মেয়ের পাশে বসতে কি খুব বেশি সমস্যা হবে?

- আমি কিছু বললাম না। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ও হেসে দিলো। বলতে শুরু করলো।

- একটা কথা বলি?
- বলো
- হিমু হবেন? গল্পের হিমু না। আমার হিমু। হলুদ পড়তে হবেনা। আপনাকে নীলেই বেশি মানায়। খালি পায়ে হাঁটতে হবেনা। জুতো পায়ে আমার পাশে হাঁটলেই হবে। আমি জানি গল্পের হিমু কারো হাত ধরেনা। আপনি আমার হাতটা ধরবেন? জীবনের শেষ বিকেলটা পর্যন্ত?

আমি কিছু বলিনি । ওর হাতটা ধরেছি । ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম সারাটাক্ষণ। মেঘলা অনেক বুদ্ধিমতী । বাকিটা ও বুঝে নিয়েছিল ।

তারপর থেকে মেয়েটা সবকিছু বদলে দিল। পাল্টে গেলাম পুরোটাই। তবে ক্যাম্পাসে বেশ হাসাহাসি চলতো। গোল আলু নিয়ে নাকি ঘুরতে হয় আমাকে। আমি হাসতাম শুধু।

(৪)
তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বন্ধু মহলের এক একজন এক এক জায়গায়। কারো কোন খোঁজ কেউ জানেনা। তবে সেদিন রাশেদের সাথে দেখা হয়েছিল। মেঘলাকে যে গোল আলু বলে বেশি অপমান করতো। সংসারের কথা জানতে চাইতেই বেচারার মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। জানতে পারলাম, বেচারার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে বিয়ের কয়েক বছর পরেই। অনেক বেছে বেছে সুন্দরী মেয়ে ঘরে তুলেছিল। তবে সংসার টেকাতে পারেনি অনেক কিছু করেও। বাকিদেরও একই অবস্থা। কারো সংসারে সুখ নেই। কারো বউ ভেগেছে। এইসবই। আমার কথা জানতে চাইলো। বললাম, ভালই আছি আমার গোল আলুকে নিয়ে। সুখে থাকতে একটা গোল আলুই যথেষ্ট। মিষ্টি আলু প্রয়োজন পড়েনা।

আজ মেঘলার জন্মদিন। নীল রঙা শাড়ি কিনেছি একটা। আমি কিনেছি একই রঙের একটা পাঁঞ্জাবী। আমার গোল আলুকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবো আজ। ক্যাম্পাসের সেই পুকুরের পাড়টায়। গল্পের হিমু হবার শখ নেই। গল্পের হিমুরা কারো হাত ধরেনা। আমি গল্পের হিমু নই। আমি মেঘলার হিমু। আমি ওর হাতটা ধরেছি। জীবনের শেষ বিকেল পর্যন্ত…

লেখাঃ G M Himu
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৩
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×