এতো বড় পরিবার এই এলাকায় খুব কমই চোখে পড়ে। উনিশ সদস্যের রান্না চলে এক হাঁড়িতে। সবাই বাড়িতেই থাকে। আর থাকবেই না বা কেন? বাইরের আলো-বাতাস এরা কোনোদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। একান্নবর্তী এ পরিবারে শিক্ষিতের হার একদম নেই বললেই চলে। হিমেলরা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন অবশ্য বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। হিমেলের ছোট বিলকিসের বিয়ে হয় ২০০৩ সালে। তখন হিমেল সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ভাইবোনের মধ্যে হিমেল আর রাজু দুজন মাত্র লেখাপড়া করে। রাজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। হিমেল ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। বড়রা সবাই মূর্খ। একদম মূর্খ বললেও ভুল হবে। একমাত্র বড়ভাই বাদে সবাই নাম ঠিকানা লিখতে পারে। দেশে গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার বদৌলতে সেটা সম্ভব হয়েছে। বোনেরা অবশ্য ধর্মীয় দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে। পাঁচ বোনেরা কুরআন শরীফ পড়তে জানে। হিমেল এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। মোটামুটি ভালো ছাত্র সে। হিমেলের স্বপ্ন লেখাপড়া শেষ করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে। তাই তো পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তা মনে হয় সম্ভব হচ্ছে না।
পড়াশোনা করতে যে অনেক খরচ। সে খরচ জোগাবে কে? উনিশ সদস্যের নৌকায় হাল ধরা যে কতো কষ্টের তা হিমেলের বাবা শওকাত সাহেব ভালোই জানেন। বাইরে থেকে একটা পয়সাও উপার্জন নেই। বসে বসে শুধু লেখাপড়া করলেই হলো। তাই তো বেচারা হিমেল মাঝেমধ্যে মন খারাপ করে বসে থাকে। কি-ই বা করার আছে তার। কোনো উপায় না থাকায় আঞ্চলিক একটা দৈনিকে সাংবাদিকতা শুরু করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে। হিমেলের বেশ নামডাক আছে এলাকায়। গ্রাম্য মঞ্চে হিমেলের লেখা কয়েকটি নাটকও ইতিমধ্যে মঞ্চস্থ হয়েছে। ভালো মেধা থাকা সত্ত্বেও
হিমেলের বাবা শওকাত সাহেব তাকে লেখাপড়া করাতে চান না। কারণ একটাই অর্থের অভাব। গতকাল হিমেল বাবার কাছে ভর্তি গাইড কেনার জন্য টাকা চেয়েছে। বাবা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে একটা টাকাও দিতে পারবো না। যথেষ্ট হয়েছে। এবার ঢাকা গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করো। আমাদের মুক্তি দাও।
বাবার কথা শুনে হিমেলের রাগে-দুঃখে অভিমানে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারে না। হিমেল জানে এবং বোঝে তার বাবার অবস্থা। গ্রামাঞ্চলে ২০ বিঘা জমির ফসল দিয়ে উনিশ সদস্যের সংসার চালানো কতো যে কষ্টের তা একমাত্র শওকাত সাহেবই জানেন।
হিমেল বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কাউকে কোনো ঠিকানাও দেয়নি। শুধু একটি চিরকুট লিখে গেছে ছোটভাই রাজুর জন্য। øেহের রাজু, ভালো করে লেখাপড়া করিস। মাঝেমধ্যে সংসারের কাজকর্ম করিস ভাই। তুই তো জানিস আমি কি জন্য বাড়ি ছাড়লাম। তাই তোকে অনুরোধ করবো লেখাপড়ায় মন দে। আর বেশি কিছু লিখলাম না। তোরই শ্রদ্ধাভাজন হিমেল।
রাজু আর ভাবতে পারে না। হিমেল ভাইয়া কোথায় যাবে? কি খাবে? একটা টাকাও তো নিয়ে যায়নি। রাজু বড় ভাইদের লক্ষ্য করে বলে। ছিঃ ছিঃ কেমন ভাই তোমরা? বিয়েশাদি করে ছেলেমেয়ে জন্ম দিয়েছো। একটা টাকা উপার্জন করো না। বসে বসে খেতে লজ্জা করে না? বাবার অবস্থা ভালো নয়। সম্পত্তি কয়দিন থাকবে। হিসেব করে দেখো ২০ বিঘা সম্পত্তি পাঁচ ভাগ করলে কয় বিঘা ভাগে পাও। এভাবে হাত-পা গুটিয়ে আর কয়দিন? আজ হিমেল বাড়ি ছেড়েছে। কাল আমিও চলে যাবো। আমাদের ভাতের অভাব হবে না। লজ্জা করে না? ছোট ভাইদের লেখাপড়া করানো কি তোমাদের দায়িত্ব নয়? রাজু শব্দ করে কেঁদে ওঠে। মা বারান্দায় এসে রাজুর মাথায় হাত বুলায়। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়ে পড়ে বেদনার অশ্র“।