somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিভোর্স ও পুরুষতান্ত্রিক মেরিটাল সোসাইটি

১২ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সারাদিন টিভির রঙ্গিন পর্দায় বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজি নাটক বা সিনেমা দেখেও, সমাজ তার আজন্মকালের ভাবনায় ও অভ্যাসে সবকিছুকেই "সাদা" বা "কালো","ভালো" বা "খারাপ" এরকম দ্বি-বিভাজনে আনতে চায়। এই বিভাজনের ভাবনার অনুসরন এবং চর্চা আছে প্রত্যেকটি সামাজিক আচরণ ও প্রতিষ্ঠানের সাথে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে নিঃসন্দেহে পরিবার হচ্ছে প্রাচীনতম, যার উৎপত্তি পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সম্মানের বোধকে ঘিরে। প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত বুননের মানের জন্য ভালোবাসা নামক তৃতীয় একটা মাত্রাকেও হিসাবে আনা হয় অনেকসময়। বহুমাত্রিক এই প্রতিস্থানের গড়ন ও গঠন তার সাম্প্রতিককালে হারাচ্ছে নিজের "টেকসই" বৈশিষ্ট্য। চারপাশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার দেখলে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়।

যেহেতু, প্রথাগত অনুশীলন অনুযায়ী সমাজ তার প্রাচীন দ্বিমাত্রিক মানদণ্ডে মাপতে চায় যে কোন ঘটনাকে, একটি ডিভোর্সেকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও সমাজ "ভালো" বা "মন্দ" এই দুই মানের সাথে মিনিয়ে নিতে চায় ঘটনার মূলে থাকা মানুষ দুটিকে। সেই সাথে জড়িত থাকে আর কিছু কিছু পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত ডিভোর্সের সামাজিক বিশ্লেষণকে আরও জটিল করে তুলে । ডিভোর্সের ঘটনাকে কখনই ভালো কোন দৃষ্টিতে দেখাতো হয়ই না, উপরন্তু যতখানি সম্ভব খারাপ একটি ঘটনা হিসাবেই বর্ণনা করা হয়। পূর্ব নির্ধারিত এই হাইপোথেসিস বিষয়টিকে এমন ভাবে পরিবেশন করে, যেন কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে। যদিও বিবাহ-বিচ্ছেদ সমাজ ও ধর্ম দ্বারা অনুমদিত সেই সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে অনুপ্রানিত। কারো ডিভোর্স হয়েছে শুনলে আমরা, যারা নিজেদের কে সামাজিক প্রানি বলে দাবী করতে চাই, তাদের জিজ্ঞাসায় থাকে "দোষ কার? ছেলের নাকি মেয়ের?" । এটাও আরেক পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত যে, একটা বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটলে সেখানে কোন না কোন পক্ষকে দায়ী হতে হবে। ঠিক যেন একটি হত্যাকাণ্ড, যেখানে একজন খুনির অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। প্রত্যেকটি মৃত্যু কিন্তু কোন খুন নয়, "স্বাভাবিক" মৃত্যু বলে একটি বিষয় আছে, আর আছে "আত্মহত্যা" নামক আরেকটি মাত্রা। প্রত্যেক মানুষের যেমন স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার আছে, ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি "পরিবার" নামক প্রতিস্থানের থাকার কথা "বিচ্ছেদ" - এর অধিকার। স্বাভাবিক মৃত্যুতে যেমন কেউ দায়ী হতে পারে না, ঠিক তেমনি একটি বিবাহ-বিচ্ছেদে কেউ দায়ী না থাকতেই পারে। সমাজের ভাবনার যে গতিপথ, সেই গতিপথে ভুল করেও চিন্তাতেও আসে না যে, দুইজন ভালো মানুষও একসাথে থাকতে নাই পারতে পারে। একটি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনাতে থাকতে পারে সম্মানের ও শ্রদ্ধার প্রকাশ। কোন বিয়ের কথা শুনে কেউ তো জিজ্ঞাসা
করি না "গুন কার? ছেলের নাকি মেয়ের?" । যদি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার সময় এই প্রশ্ন না উঠে তাহলে প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তির সময় (পড়ুন "বিলুপ্তি" ; "ভাঙ্গন" নয় ) "দোষ" বা ত্রুটি খুজতে শুরু করাটা সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয় না ।

এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই বাংলাদেশে বাড়ছে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা, চিন্তার শুরু হয় হয় যখন এই সংখ্যাকে "আশঙ্কাজনক কম" বা "আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি" বলা হয়। সংখ্যাটা কত হলে "সাধারন" বলা হবে সেটা যেমন বলা সম্ভব না, তেমনি "আশঙ্কাজনক" বা "আশানুরূপ" বলার আগে অনেক কিছু চিন্তা করার জায়গা আছে। প্রশ্ন আসতে পারে এই বিশেষণের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা। এক কথায় এর উত্তর "আছে"। কারন গঠনতান্ত্রিক ভাবে যে সমাজ "পুরুষতান্ত্রিক" আর বুননগত দিক থেকে "মেরিটাল", তার কাছে পুরুষের সামাজিক অবস্থান এবং পরিবারের সাসটেনাবিলিটি মূল্য অনেক বেশী। এখানে নারীর স্বাধীনতার থেকে পুরুষের ক্ষমতার বিস্তারের (প্রকৃত অর্থে যা আধিপত্যের বিস্তার) গুরুত্ব অনেক বেশী। আর মেরিটাল সোসাইটি তার সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় রাখার জন্য, এবং একই সাথে পরিবার হচ্ছে গুনগত মানে সমাজকে মাপার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ডিভোর্সের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গত কয়েক বছরে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপরেশনের হিসাবে, গত বছরের চেয়ে এই বছর ডিভোর্স এর হার প্রায় তিনগুন । গত বছর(২০১৩) জুলাই মাস পর্যন্ত আবেদন ছিল ৮২১৪ টি সেখানে এই বছর(২০১৪) তে সেই সংখ্যা ২২৪৮৮। একই সাথে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল (পুরুষশাসিত সমাজের কাছে) এখানে বেশির ভাগ আবেদন জমা পরেছে নারীদের কাছে থেকে। শতকরা হিসাবে মানটা ৭৫% থেকে ৭৮% । মেরিটাল সমাজ এই সংখাকে "উদ্বেগজনক" পরিস্থিতি বলতে পিছপা হয় না। যদিও সবদিক থেকে তারাই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটে ।

প্রথমত, কোন নারী ডিভোর্স দিচ্ছেন, সুতরাং সমাজকে সহজেই বুঝানো যাবে যে, পরিবারের পুরুষ চেয়েছিল সামাজিক এই বন্ধনটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য, কিন্তু ডিভোর্সদাত্রী নারীর জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। এই কথার পুছনে যে দর্শন থাকে, সেটা আধিপত্য বিস্তারের আর একই সাথে নিজেকে "উন্নত" দাবী করার কৌশল মাত্র। সমাজ যদি দেখে কোন নারী নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিচ্ছে (যেটা দেখে পুরুষ অভ্যস্ত না) তাহলে সেই নারী কে দু-চারটা অশালীন বিশেষণ-এ বিশেষিত করতে এই সমাজ বিন্দুমাত্র সময় নেওয়াই না। এই আচরণের পিছনে যতটা না বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন থাকে, তার চাইতে বেশী থাকে "ভয়" । এই ভয় কোন অর্থেই "সামাজিক বন্ধন" বা "জীবন সঙ্গী"-কে হারানোর না, এই ভয় সমাজের নিয়ন্ত্রকের অবস্থান থেকে নিজের সম্ভাব্য বিচ্যুতির।

দ্বিতীয়ত, "যেহেতু নারী ডিভোর্স দিচ্ছেন, সেহেতু কাবিনের টাকা দিতে হবে না" , এরকম একটা ভুল ধারনা সমাজে আছে অনেকদিন ধরে, আর পুরুষরা সেই সুযোগ নিতে দেরি করে না । অন্যদিকে নারীরাও নিজের সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে "তথ্য ও সহযোগিতার" অভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে না।

এরকম পরিস্থিতিতেও এক শ্রেনির মনবিজ্ঞানী ডিভোর্সকে নিরুৎসাহিত করতেব্যস্ত। তাদের কাছে চমৎকার যুক্তি, ডিভোর্স পরবর্তী প্রজন্মের উপর অশুভ প্রভাব ফেলে। চারপাশের পরিস্থিতি দেখে ব্রোকেন ফ্যামিলীর পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা হতাশাতে ভুগে। কিন্তু কোন অর্থে কি ভেবে দেখা যায়না যে, কতটা নিরুপায় হলে একজন নারী , যে কিনা তার আজন্মকালের ধ্যান ও ধারনায় পারিবারিক বন্ধনকে জীবনের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান যেনে এসেছে, সে ডিভোর্স এর কথা ভাবে। সাধারনত একজন নারী অস্তিতের সংকটে বিপন্ন না হলে
ডিভোর্স দেয় না, আর যে পরিবারে নিজের ও আত্মার অস্তিত্তের নিরাপত্তা থাকে, সম্মান থাকে না সেই পরিবার যদি আদৌ টিকে থাকে , সেই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম কি শুদ্ধতার মাঝে বেড়ে উঠবে ?

(একই সাথে একাধিক ব্লগে প্রকাশিত)
তথ্য সূত্র :
রাজধানীতে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ; এগিয়ে নারীরা

ডিভোর্স চাই আমি

ডিভোর্স আপনি চাইতেই পারেন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×