রঙের পৃথিবীর রূপ দেখে মানুষ চোখ দিয়েই। চোখে অসুখ হলে মনেও সুখ থাকে না। অথচ অল্প যত্নেই চোখ ভালো রাখা যায়। পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. ইসরাফিল। লিখেছেন ডা. মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ
সবার চোখের সমস্যা এক রকম নয়। শুধু রোগের ধরন হিসেবে নয়_বয়স, লিঙ্গ, শ্রেণী, পেশার ভিন্নতার কারণেও চোখের সমস্যা বিভিন্ন হতে পারে। রোগীরা সাধারণত চোখে কম দেখা, চোখ ব্যথা করা, মাথাব্যথা, চোখ দিয়ে পানিপড়া, পিঁচুটি পড়া, আলো সহ্য করতে না পারা, চোখে আঘাত পাওয়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন। তবে সব সময় যে উপসর্গ থাকে তা-ও নয়। আবার সরাসরি চোখের রোগ ছাড়াও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ ইত্যাদি কারণেও চোখের সমস্যা হতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর ২৮৫ মিলিয়ন মানুষ দৃষ্টিগত সমস্যায় ভুগছে এবং এর ৮০ শতাংশই প্রতিরোধ বা নিরাময়যোগ্য।
সানগ্লাস ব্যবহার
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি চামড়ার জন্য যেমন, চোখের জন্যও ক্ষতিকর। সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে চোখ লাল হয়ে যায়, চুলকায় এবং চোখ কচকচ করে। তবে এ ধরনের সমস্যা সাধারণত অল্প সময়ের জন্য হয়। অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শ থেকে সরে এলে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বা দীর্ঘদিন অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে গেলে এর প্রভাব হতে পারে খুব ভয়ংকর। এতে ছানিপড়াসহ অক্ষিপট বা রেটিনার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। সূর্যের আলোর সঙ্গেই অতিবেগুনি রশ্মি আসে বলে সতর্কতা হিসেবে দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকার আগে অবশ্যই ভালোমানের সানগ্লাস ব্যবহার করা উচিত। সানগ্লাস শুধু রঙিন হলেই হয় না, সানগ্লাস হতে হবে অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিরোধী। তাই যে ধরনের সানগ্লাস অতিবেগুনি 'এ' এবং 'বি' রশ্মি ঢুকতে বাধা দেয়, ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ দৃশ্যমান আলো থেকে রক্ষা করে, ত্রুটিবিহীন, ধূসর লেন্সযুক্ত_সেগুলো ব্যবহার করা উচিত। সংগত কারণেই সস্তায় এ ধরনের সানগ্লাস পাওয়া সম্ভব নয়।
ভিটামিন এ, সি, ই
চোখের ভিটামিনও বলা হয় এগুলোকে। এ ভিটামিনগুলো ছানিপড়া রোধ করে। বয়সের কারণে যে ধরনের চোখের রোগ হয়, তা প্রতিরোধ এবং চোখের ম্যাকুলার অধোগতি প্রতিরোধ করে। গাজর, সবুজ শাক, হলুদ ফল, কলিজা, মাছ, ডিম ও দুধে ভিটামিন 'এ' প্রচুর পরিমাণে থাকে। টক-জাতীয় ফল ও পেয়ারায় থাকে ভিটামিন 'সি', সূর্যমুখী বীজ ও কাজুবাদামে ভিটামিন 'ই' পাওয়া যায়।
পেশা যখন ক্ষতির কারণ
পেশাগত কারণে চোখের বেশ কিছু অসুখ হতে পারে। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি, ধুলাবালি ও ধোঁয়া, রোদ, অল্প আলো ইত্যাদি কারণে চোখের বেশ কিছু রোগ হয়। যেমন_লৌহশিল্প, ঝালাই কারখানা, রাসায়নিক দ্রব্যাদির কারখানায় যাঁরা কাজ করেন তাঁরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িতদের আঘাতজনিত কারণে কর্নিয়ায় আলসারের ঝুঁকি বেশি থাকে। ভাবছেন, আপনি এ ধরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত নন বলে বিপদমুক্ত। কিন্তু বিপদ হতে পারে ঘর থেকেও। এমনকি ঘরে গৃহস্থালির কিছু কাজ যেমন_ঘরের ঝুল পরিষ্কার করা, রান্নার সময় অতিরিক্ত গরম তেলে পানির ছটা পড়া ইত্যাদি কারণে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। তাই চোখের জন্য বিপদ হতে পারে_এমন কাজ করার সময় চোখে আচ্ছাদন বা গ্লাস ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে চোখ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত এবং যথাশিগগির সম্ভব চক্ষুবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
চোখের নিয়মিত পরীক্ষা
প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে চোখের বেশির ভাগ রোগই নিরাময়যোগ্য বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। তাই নিয়মিত চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের অপটোমেট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, শিশুর ছয় মাস বয়সে, তিন বছর বয়সে, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির আগে এবং এরপর আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি দুই বছর অন্তর চোখের ডাক্তার দিয়ে চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত দু-তিন বছরে অন্তত একবার চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের প্রতিবছর ডাক্তার দিয়ে চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। যদি কারো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পারিবারিক চোখের রোগ থাকে অথবা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে হয়, তবে তাঁর নিয়মিত চোখের ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
কম্পিউটার এবং চোখ
এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয়। তাই কম্পিউটার মনিটর থেকে বিচ্ছুরিত উচ্চ আলো সব সময় চোখে এসে পড়ে। অধিক সময় কম্পিউটার ব্যবহার করলে চোখ ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা এবং চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম্পিউটার বন্ধ করে দিলে বা কাজ থেকে দূরে থাকলে ধীরে ধীরে উপসর্গগুলো উপসম হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয় এমন ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ দীর্ঘস্থায়ী পীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই কম্পিউটারের পর্দা চোখের লেভেলের চার-পাঁচ ইঞ্চি নিচে এবং চোখ থেকে ২০-২৮ ইঞ্চি দূরে রাখা উচিত। মাথার ওপর কম ওয়াটের বাতি ব্যবহার করে কম্পিউটারের পর্দার উজ্জ্বলতা কমানো যেতে পারে। এক দৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে না থেকে বারবার চোখের পলক ফেলা এবং প্রতি দুই ঘণ্টা কম্পিউটার ব্যবহারের পর ১৫ মিনিট বিশ্রাম নিলে কম্পিউটারজনিত চোখের সমস্যা কম হবে।
কন্টাক্ট লেন্স
চোখের সৌন্দর্য বাড়াতে কন্টাক্ট লেন্স খুব ব্যবহার হয়; কিন্তু কন্টাক্ট লেন্স যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের অনেক সময় চোখ জ্বালা করা, ঝাপসা দৃষ্টি, ব্যথা ও অস্বস্তি হতে পারে। লেন্স পরা অবস্থায় চোখে আঘাত পেলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। কন্টাক্ট লেন্সজনিত ক্ষতি কমাতে লেন্স ব্যবহারের আগে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। পরিষ্কার ও শুদ্ধ সলিউশনে লেন্স ডুবিয়ে রাখা উচিত। সাঁতার, গোসল ও ঘুমের আগে কন্টাক্ট লেন্স অবশ্যই খুলে রাখতে হবে।
চোখের ছানি
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সমস্যার ধরন পাল্টাচ্ছে যেমন_মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, তাই বয়সের কারণে চোখে ছানি পড়ে অন্ধত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। একই সঙ্গে বয়স্কদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রেটিনোপ্যাথি বা অক্ষিপটের সমস্যাও দিন দিন বাড়ছে। চোখে ছানি পড়লে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক কাজকর্ম যেমন_টেলিভিশন দেখা ও লেখাপড়া করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ছানিপড়া রোগীদের ড্রাইভিংয়ে বেশ সমস্যা হয়। কারণ বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলো অধিক উজ্জ্বল বলে মনে হয় এবং হেডলাইটের আলোর চারপাশে রোগীরা চকচকে আলোর মণ্ডলী দেখতে পায়। ছানিপড়া রোগীদের চোখে চশমার পাওয়ার ঘন ঘন পরিবর্তন করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে চক্ষুবিশেষজ্ঞরা ছানি অপারেশনের নিরাপদ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।
বয়সজনিত ছাড়াও আঘাতের কারণে বা দূষিত পরিবেশের কারণে বা ধোঁয়া বা কেমিক্যালের প্রভাবে যেকোনো বয়সে ছানি পড়তে পারে। ছানিরোগটি যথাসময়ে চিকিৎসা করালে ভালো হয়। তাই নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
চালশে
শৈশবে চোখের লেন্স নমনীয় থাকে; কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর নমনীয়তা কমতে থাকে। লেন্স অপেক্ষাকৃত শক্ত হয়ে যায়, তাই কাছের বস্তুতে ফোকাস করতে বা কাছের বস্তু দেখতে কষ্ট হয়। চল্লিশের আশপাশের বয়সে এ ধরনের রোগ দেখা দেয় বলে রোগটি চালশে নামেই পরিচিত। এ ধরনের সমস্যায় অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তার রিডিং গ্লাস বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ধূমপান ত্যাগ
ধূমপানের কারণে চোখের ক্ষতি হয়ে থাকে। কারণ ধূমপান চোখের রক্তনালিতে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়। সবার জন্য তো বটেই, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বা ম্যাকুলার অধোগতি রোগ যাঁদের রয়েছে, তাঁদের ধূমপান অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।
চোখের বিপদ চিহ্নগুলো
আলো-আঁধার ও দূরত্ব নির্ণয়ে সমস্যা হলে চোখের আইরিস বা কনীনিকা এবং চোখের পাতার রং পরিবর্তন হলে, চোখে ব্যথা, একদিকে দুটি দেখা, দৃষ্টিসীমায় কালোমণ্ডল দেখা, শুষ্কতা বা চোখ দিয়ে পানি ঝরা, আলোর ঝলকানি দেখা, পাশের বস্তু না দেখা ইত্যাদি হলে বুঝতে হবে, চোখের কোনো সমস্যার জন্য এটা হচ্ছে। তাই দেরি না করে চোখের ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিতঋ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


