প্রেক্ষাপট: ১৯৭১ সাল, নভেম্বর মাস।
আমি সাজ্জাদ। আজ থেকে ২১ বছর আগে এই
বসুধায় এসেছি। ২১ বছর ধরে এই ধরণীতে কি দেখছি
জিজ্ঞেস করলে হয়ত কিছুই বলতে পারব না। তবে
একটি অনুভুতি আমার আছে।যখন এই মহা সমীরণে
আমি প্রথম এলাম, চারিদিকে এত আলো, এত সুন্দর
সবকিছু, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম, আর অবাক হয়ে
ভাবছিলাম 'পৃথিবী এত সুন্দর কেন.?' হয়ত এই
মায়াবী আলো আমি এত সহজে গ্রহণ করতে
পারিনি, তাই তো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে
আগমনি বার্তা জানিয়ে দিলাম। এরপর থেকেই তো
জীবন যাত্রা শুরু।
আজো পৃথিবীর দিকে তাকালে ঠিক ততটাই
অবাক হই। মানুষ গুলো অসম হারে বদলে যাচ্ছে। এই
বদলানোটাও অস্বাভাবিক। আগে ভোরের ঘুম
ভাঙ্গত, মোরগের লম্বা ডাকে। আর এখন.!! প্রতিটি
মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে থাকি, ঘুমুব কখন.? সামনেই তো
মিলিটারি ক্যাম্প। শুধু একটা খাল পেরোলেই হল।
বদলানোর শুরুটা তো তারাই করেছে। তারা ধীরে
ধীরে মানুষ খেকো হয়ে উঠছে। আর আমরা হচ্ছি
প্রতিবাদী।
দেশের এই চরম পরিস্থিতিতে আমার আর বিথির
বিয়ে হয়। কোন আয়োজন পর্যন্ত করতে পারলাম না।
শুধু বিথির হাত ধরে অনেকটা পালিয়ে নিয়ে
এসেছি। নিজ দেশে থেকেও যেন প্রবাসী।
বিথির কথা আর কি বলব.!! ১৭ বছরের এক রূপবতী
নারী। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায়, আমাদের
মধ্যকার প্রণয় অতি তাড়াতাড়িই গড়ে উঠল।সে
আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। আমিও তাকে
অন্যকিছু বুঝতে দেই না। সংসার গোছানো তো
দূরের কথা। সে চুলোর আগুন পর্যন্ত ধরাতো না। আমি
অবশ্য রাগতাম না। থেকে থেকে আমিও তো কম
ভালোবাসি নি।একটু আহ্লাদ তো করতেই পারি।
বিথি অসম্ভব সাহসী। তার সাহস দেখেই আমার
ভয় হয়। চারিদিকে এই অবস্থা। সকাল থেকে সন্ধ্যা
অবদি আমি বাড়িতে থাকি না। বিথির কোন বিপদ
যেন না হয়ে যায়। যুদ্ধ সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং
আগ্রহ আমার থেকে অনেক বেশি। কখন কি হচ্ছে,
কোন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেল, কাদের বাড়ি লুট
হল, কয়টি মিলিটারি ক্যাম্প আছে, কোথায়
কোথায় আছে, কখন তারা ধেয়ে আসতে পারে,আবার
কবে মুক্তি বাহিনি একশ্যানে যাবে, সব ধরণের
খবরা-খবরই সে রাখে। যুদ্ধে তার বাবা-মা দুজনকেই
হারিয়েছে। সে কারণেই হয়ত বা এত আগ্রহ, এত
চিন্তা।
সেদিনকার ঘটনা। কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি
ফিরেছি। বিথিকে দেখলাম রাগে ফুসছে।
জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলে না। কিছুক্ষণ পর পর
শাড়ির আচলের নিচে সে কি যেন লুকুচ্ছে। আমি
যথেষ্ঠ হাতাহাতির পর দেখলাম আমাদের সেই
ধারালো ছুরিটি। হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।
কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। বিথির শুধু একটাই
কথা-'যা হবার আজ রাতেই হবে। তুমি একটু
সাবধানে থেকো।'আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।
বিথির বাঁ হাতে ছুরি, চোখ দুটো দেখাচ্ছিল উজ্জল
সূর্যের মত, শক্ত মুখ, সুঠোল ঠোঁট। প্রতিটি অঙ্গই
যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
মধ্যরাতে মিলিটারি আসল। সাথে দু-একটা
পরিচিত রাজাকার। আমার সামনেই তারা বিথিকে
টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আমার যেন
কিছুই করার নেই। স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে আছি, আর
কিছুক্ষণ পর পর মার খাচ্ছি। বিথির ধারে কাছেও
আসতে পারলাম না।
এরপর কতক্ষণ কাটল, আমার খেয়াল নেই। ভোর
হতেই এলাকায় চেঁচামেচি শুনা গেল। খবর পেলাম
ক্যাম্পের মিলিটারিরা পালিয়ে গেছে। তিনজন
নিহত। আমি প্রায় চিতাবাঘের মতই ছুটে গেলাম।
আশেপাশের অনেক লোক ক্যাম্পে এসেছে। সবার
চোখেই হতাশা। আমি বিথিকে খুজেই যাচ্ছি,
কিন্তু পাচ্ছি না। হঠৎ লক্ষ করলাম কোণার একটি
ক্যাম্পে কান্নাকাটির আওয়াজ।ছুটে গেলাম
সেদিকে।
ক্যাম্পের অবস্থা যথেষ্ঠ স্যাঁত সেতে।
চারিদিকে কাপড়-চোপড় ছরানো। অতি দূর্ঘন্ধময়
জায়গা।ভালোমত খুজতেই চোখে পরল, দুজন মৃত
মিলিটারির মাঝখানে বিথির নিথর দেহ পরে
আছে। আমার আশা-ভঙ্গ হল। বিথি আর বেঁচে নেই।
রাতে মিলিটারিদের অত্যাচার তার অসম্পূর্ণ
জীবনকে শেষ করে দিল। আমার অনুপস্থিততে বিথি
যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তা বুঝতে আমার আর
বাকি রইল না। আমি আহত দৃষ্টিতে তার দিকে
চেয়ে আছি। বিথির বাঁ হাতে রক্তাত্ত ছুরি, চোখ
দুটো দেখাচ্ছিল উজ্জল সূর্যের মত, শক্ত মুখ, সুঠোল
ঠোঁট। প্রতিটি অঙ্গই যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
আমি কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিলেও এ বিদ্রোহ
থামার নয়।
.
.
আশিক রাফি