somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ আব্দুল মোতালেবের একটি দিন

১০ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘বেডাগোরে পাছা দেহাইতে মজা লাগে; তাড়াতাড়ি কাম সার, মাগি’, হিসহিস শব্দ বেরিয়ে আসে পুরুষটির কন্ঠস্বর থেকে। ‘কে, তগো পাছা নাই, তরা যে পাছা ধইরা ডেইনে বইসা থাহস, হেইডা কেউ দেহে না’, আরো ঝাঁঝালো কন্ঠে প্রতি-উত্তর নারীকন্ঠে। কথা ক’টি কানে আসতেই যেখানটায় ছিল ঠিক সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে আব্দুল মোতালেব; নিশ্চয়ই কেউ তার বউকে নিয়ে এসেছে সকালের কাজটা সারার জন্য আর তাড়া দিচ্ছে পাছে কেউ এসে এ অবস্থায দেখে ফেলে। বেচারি নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছে; নয়তো এ সময়ে পুরুষ ছাড়া অন্য কারোর এখানে আসাটা খুব একটা স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে না, ভাবে আব্দুল মোতালেব। এ বস্তিতে, মাইয়ালোক মানে নারী আর মর্দা বেঢি মানে কিশোরী – বয়সে হোক না হোক, শরীরের গঠনে যারা মর্দা অর্থাৎ যাদের বুক-পাছা দেখলে পুরুষদের নেশা লাগে – এই দুই শ্রেণীর মানুষকে মানে যাদের জন্য পর্দা মেনে চলাটা জরুরী, তাদেরকে কাজটা শুরু করতে হয় সন্ধ্যার আঁধারটা নামার পরে, যাতে পুরুষদের চোখে না পড়ে অথবা চোখে পড়লেও যাতে খুব একটা সমস্যা না থাকে কারণ এ সময়টায় আশপাশে লোকজনের আনাগোনা, চলাচল থাকে। আবার শেষটাও করতে হয় রাতটা গভীর হবার আগেই; কেননা রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে পুরুষদের নিম্নাংশের কিলবিলানি বাড়তে থাকে, আর তা মেটাতে এদের কেউ কেউ দল বেঁধে বস্তির পেছনের দিকের এ নালাটির উপরও ঘাপটি মেরে থাকে। এটাই মোক্ষম সময় তাদের জন্য, আর এ সুযোগে অনেক কিছুই ঘটে। তাই সারাদিন যেমনি তলপেটের নিম্নচাপ চেপে ধরে রাখতে হয়, তেমনি রাত গভীর হবার আগেই যা সারার তা সেরে নিতে হয়। এটাই পিক টাইম তাদের জন্য। আর তা না হলে ভয় থাকে, এর সাথে আরো অনেক কিছুই খসে যাবার।

ভোরটা পাতলা হয়ে আসার সময়েই ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস তার, বলা ভাল উঠেই যেতে হয় আব্দুল মোতালেবকে; নইলে বস্তির পেছন দিককার সে নালাটার উপর দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে বসে একটু আরামে প্রাকৃতিক কর্মটা সারার সুযোগে ব্যাঘাত ঘটে। ভোরের আলো বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এদিকটায় - থানাঘাট এলাকার এ বস্তিটায় হাজার হাজার মানুষের বাস। সেই যে ’৯৮-এর বন্যায় বাড়ী-ঘর ভেসে যাওয়া সব হারানো মানুষটা, বড় মেয়েটা কোলে তুলে নিয়ে বউটার হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে এসে আস্তানা গেড়েছিল ব্রহ্মপুত্র পাড়ের এ বাধটার উপর, মনে পড়ে আব্দুল মোতালেব ওরফে মোতালেব মিয়া ওরফে মোতালেব ড্রাইভারের।

তখনো খুব বেশি মানুষ এখানে বসতি গাড়েনি। গুচ্ছ গুচ্ছ কিছু ছাউনি, এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো। নদীভাঙা, ঘর-হারানো, সর্বস্ব-খোয়ানো বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জোটা মানুষগুলো কেমন স্বপ্নাহতের মতো ঘুরে বেড়ায় কেবল এদিক-ওদিক, আর শুধু খবর নেয় কোথায় একটু রিলিফ জুটবে, কোনমতে খেয়েপরে দিন কাটানো যায় কিভাবে। কমবেশি সবারই চিন্তা-ভাবনা ছিল পানি নেমে গেলে আবার ফিরে যাবে নিজের জায়গায়, ফেলে আসা মা-বাবার ভিটে-বাড়িতে। এদিকে আব্দুল মোতালেব, নিজের পেটের চাইতে যার বেশি দুঃশ্চিন্তা বউ আর কোলের মেয়েটাকে নিয়ে, ভাবতে থাকে কিভাবে দু’টা রুজি রোজগার করা যায়। ঘুরতে ফিরতে, কয়েক দিন আড্ডা দিতেই ঘাটের চা বিক্রেতাটার সাথে ভাব জমে যায়। তাকে ধরেই আব্দুল মোতালেব একটা রিকশা জুটিয়ে নেয় ভাড়ায়।

সেই থেকে ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার রহমতনগর গ্রামের চাষা কাম দিনমজুর শফি মিয়ার ছেলে আব্দুল মোতালেব ওরফে মোতালেব মিয়া হয়ে গেল মোতালেব ড্রাইভার – যে আজ সতের বৎসর পরও, ঠিক সেই সময়কার মতোই ভাঙা রিকশা টানতে টানতে একটি রিকশার মালিক হবার স্বপ্নজাল বুনে। ঠিক সেই দিনগুলোর মতোই। ঠিক একইভাবে আজো প্রতি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে। উঠেই পেছনের নালার পাড়ে দিকে ছোটে। নালার দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে বসে প্রাতঃকর্ম সেরে নিমের কালো মাজন দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বস্তির এবড়ো-থেবড়ো আড়াই ফুট প্রশস্ত কাদামাটি-ছাই-কংক্রিট-জলমাখা ফুটপাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, কোনরকমে পার হয় দু’পাশে নেমে আসা খুপরিগুলোর চালার টিনের কোনা থেকে সাবধানে মাথাটাকে বাঁচিয়ে।

কয়েক লাফেই অন্যান্য দিনের মতোই আজও সরু পাড় বেয়ে সে উঠে আসে বাধের উপর। ব্রহ্মপুত্রের সতেজ হাওয়াটা গায়ে এসে লাগে তার। দাঁত মাজার তালে তালে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যায় ঘাটের চওড়া সেই সিঁড়িটার দিকে, একটা একটা করে ধাপ ভাঙতে ভাঙতে একসময় নেমে পড়ে নদের জলে। মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে হয় ডুব দিয়ে, ভেসে গিয়ে প্রাণটা জুড়োবে কিন্তু জলে গা ডুবোতেই মন ভরে উঠে তার বিস্বাদে। এতো সেই সর্বনাশা নদ, সেই ব্রহ্মপুত্র - যার উতাল-পাতাল ঢেউ সর্বস্ব গিলে খেয়ে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে বস্তিঘরের এ আট ফুট বাই দশ ফুট আয়তনের এ ছাউনিটাতে। এখানে সব একাকার হয়ে মিশে আছে – নোয়াখালি, কুমিল্লা, বরিশাল থেকে জামালপুর হয়ে কুড়িগ্রাম সব এলাকার মানুষ নদীর ভাঙনে ভাসতে ভাসতে, ঘূর্ণিঝড়ের হাওয়ার তোড়ে উড়তে উড়তে এখানে এসে ভীড় জমিয়েছে; তবু এদের কারোর কোন আলাদা পরিচয় নেই, ভাষা নেই, জাত নেই - এরা কেবলই বস্তিবাসী এখানে। গা ডুবোতেই নদের পাড়ভাঙা সেই শব্দ আব্দুল মোতালেবকে আঁছড়ে ছুঁড়ে মারে উপরের দিকে। অন্যদিকে রিকশার টুংটাং ঘন্টাধ্বনি তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় রাস্তার দিকে – ভাড়া টানার তাগাদায়, চার চারটি মুখ যে তার ফিরে আসার আপেক্ষায় থাকে রোজ।

আজ তার মধ্যে খুব একটা তাড়াহুড়ো দেখা যায় না, ধীরে-সুস্থে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে পানির সাথে লাগোয়া শেষ সিঁড়িটায় বসে পড়ে মোতালেব মিয়া। পা দু’টো পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে পরম যত্নে দাঁত মাজতে থাকে সে। অন্যদিন যেমন তেমন, আজকে যেন দাঁতগুলো অন্তত সুন্দর দেখা যায়। দিনটার কথা ভাবতেই উত্তেজনা দেখা দেয় তার মনে। রাস্তা-ঘাটে, বস্তিতে কত ধরনের লোকজনের সাথেই তো সারাদিন কথা হয়; ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা কত কিছুরই বিনিময় হয়। আর প্রতিবারেই একেকজনের সাথে একেকরকম অনুভূতি কাজ করে। পুরুষদের সাথে এক রকম, মহিলাদের সাথে আরেক রকম। এখনো মহিলা প্যাসেন্জার দেখলেই আব্দুল মোতালেবের মধ্যে একটা ভিন্ন অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে, সুন্দরী কোন মহিলা রিক্শায় উঠলেতো কথাই নেই – মনে হয় যেন অসুরের শক্তি ভর করে সদ্য বিয়াল্লিশে পা দেয়া চার পুত্র-কন্যার জনক মোতালেব ড্রাইভারের গায়ে। ইচ্ছে হয় তখন রাস্তা ধরে নয়, হাওয়ার উপর দিয়ে ভাসিয়ে নেয় রিকশাখানা, এমনকি একটু কম ভাড়ায় হলেও আপত্তি নেই – ভাড়া দেয়া-নেয়ার অবসরে তার চোখ সুন্দরীর হাত-পা-আঙুল-চুল-চোখ-কপাল-ঠোঁট যেন চেখে চেখে দেখে। আর যখন ভাড়া দিয়ে বিদায় নেয়, তখন পেছন দিকটায় সেই ব্রহ্মপুত্রের লাহান ঢেউ – ছন্দে ছন্দে একদিকে উঠে আর অন্যদিকে নামে, অন্যদিকে নামে আর একদিকে উঠে। এ ঢেউ পাড় ভাঙে না, ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে আব্দুল মোতালেবের হৃদয়; আর ভেঙে খানখান হওয়া সে গহীন থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস, ‘ইস! আমার বউডা এরাম অইত, কমপক্ষে আঙুলটা, হাতটা বা ঠোঁটটা এরাম অইত! আর পাছার ফিগার – এর কাছাকাছিও যদি কিছু অইত’! ‘কীরে, আইজকা রিকশা চালাইতি না’ তার খুপরিঘরের লাগোয়া খুপরির কুতুব মিয়ার কথায় ঘোর ভাঙে মোতালেব ড্রাইভারের, কতোক্ষণ ধরে এভাবে বসে আছে নিজেই টের পায় না সে, ‘না, আজকা বস্তিত লোক আইব, থাকতে অইব’, বলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে – ভেসে যেতে থাকে ঢেউয়ের তালে তালে।

২.
বস্তির খুপরিঘরের দিকে বাপকে ফিরে আসতে দেখেই মোতালেব ড্রাইভারের বড় মেয়ে, সেই নদীভাঙা ঘোরলাগা সময়ে কোলে করে নিয়ে আসা মেয়েটি, আজকের বিশ বৎসর বয়সের যুবতী ফাতিমা, দৌড়ে গিয়ে হাঁড়ি-কুড়ি নিয়ে পড়ে – বাপের জন্য পান্তা ভাত বাড়তে লেগে যায়। মোতালেব ড্রাইভার ঠিক দরজার সামনের চালায় নেমে আসা টিনের উপর ভেজা লুঙিটি মেলে দেয় রোদে শুকানোর জন্য – আহা রোদ, বস্তিঘরের ভাঙা টিনের চালার ফাঁক বেয়ে নেমে আসা এক চিলতে রোদ, তাতেই বাইরের প্রকৃতির ছোঁয়া পায় তার বিছানায় পড়ে থাকা বউটি, মরিয়ম। আজ সাত বৎসর ধরে বিছানায় পড়ে আছে তার ল্যাঙড়া, খোঁড়া বউটি।

সে দিনটির কথা ভাবলে আজও আব্দুল মোতালেবের গা ঠান্ডা হয়ে আসে। মাসকান্দা বাস স্ট্যান্ড থেকে যাত্রী নিয়ে রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল সে তখন, মাঝে পথচারীদের টুকটাক কথাবার্তা কানে ভেসে আসলেও কিছু বুঝতে পারেনি প্রথমে। আরও খানিক আগানোর পর কিছু নারী-পুরুষের দিগ্বিদিক দৌড়াদৌড়ির কারণ জানতে আগ্রহী হয়ে বুঝতে পারে দুর্ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে সেখানে মরিয়মেরও থাকার কথা তার ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে। গাড়ির লোকজনদের ঠিক সেখানটায় নামিয়ে দিয়ে কখন কীভাবে ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল নিজেই টের পায়নি সে। চারিদিকে অগুনতি মানুষের ভীড় ঠেলে কোনরকমে ভিতরে ঢুকতেই তার চোখে পড়ে সারি সারি নারী-শিশু-বৃদ্ধ আহত হয়ে কাতরাচ্ছে। অস্থির কান্নাকাটি, গোঙানি আর যন্ত্রণাকাতর মুখগুলোর অনেকই চেনা, তার একই বস্তির। সবাই এখানে এসে ভীড় করেছিল জাকাতের আশায়। হায়রে জাকাত, হায়রে ঈদ – হাহাকার করতে করতে নিজের বউ আর মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে শেষে সন্ধান পায় হাসপাতালের বারান্দায়।

চারদিন হাসপাতালে থাকার পর সেই যে এসে বস্তির এ খুপরিটায় ঢুকেছিল, আর বেরোতে পারেনি মরিয়ম। মানুষের চাপায় পিষ্ট ভাঙা পা দু’খানি তার ভাল হয়ে উঠেনি আজ অবধি। বাইরেও আর কখনো পা বাড়াতে পারেনি মরিয়ম, মোতালেব ড্রাইভারের বউটি। টিনের চালের ফুটো আর ভাঙা বেড়ার মরিচাধরা ক্ষয়ে-যাওয়া ঝরে-পড়া অংশগুলোই তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে – তার চোখের সামনে বাইরের জগৎটা খুলে দেয়। বিছানায় অসহায় কাতরানি, ছেলে-মেয়ে-স্বামীর উপেক্ষা, বেলাগড়ানো ক্ষুধা, আশপাশ থেকে তার সোমত্ত মেয়ের উদ্দেশে ভেসে আসা কুৎসা, লাম্পট্যের মাঝে ভাঙা টিনের চালগড়ানো রোদের তাপ আর বৃষ্টির ছাঁটটুকুই তার কাছে বাইরের পৃথিবী আর সৃষ্টির অপার রহস্য; এর মাঝেও কদাচিৎ মোতালেবের ঘামেভেজা লোমশ বুকের নিবিড় স্পর্শ – যা আনন্দের চাইতে আতংক জাগায় বেশি। ভয় হয় আবার না জানি ঘরে মানুষের সংখ্যা বাড়ে, ক্ষুধার্ত মুখের সারিটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

খুপরির কোণায় বিছানো চারপায়া খাটটা, মরিয়মের মোটামুটি স্থায়ী ঠিকানা। তার উপর উঠে দড়িতে ঝুলানো তক্তপোশের উপর থেকে ভাঙা টিনের বাকশোটি নামিয়ে নেয় আব্দুল মোতালেব। এটাই আলমারি তাদের, পরিবারের সবার। জংধরা অ্যালুমিনিয়ামের ফুলের ছাপমারা পুরনো ট্রাংকটা। তালা খুলে ডালা উল্টে সে বের করে আনে গায়ে পরার সাদা একটা জামা – খবরের কাগজে মোড়ানো। জামাটা হাতে নিতেই কাপড় কাচা সাবানের গন্ধ টের পায় আব্দুল মোতালেব। মরিয়মের বিছানায় রাখতে গিয়েও সে শার্টটা রাখে না পাছে ময়লা লাগে তাই। ‘আগে খাইয়া লও, কী অইল অইনে?’, বাঁ হাঁটুর উপর জামাটা রেখে ডান হাতে ট্রাংকটার তালা বন্ধ করতে করতে মেয়ে ফাতিমাকে শুনতে পায় সে।

টিনের থালায় পান্তা ভাত আর তাতে কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ-লবনমাখানো একটু ভর্তা। এটুকুতেই খুশি ওরা সকালবেলাটায়, মোতালেব ড্রাইভার রিকশা বেয়ে যা পায় তা দিয়ে বিকেলবেলায় চাল-আনাজ কিনে খুপরিতে ফেরে ঝুঁকতে ঝুঁকতে। তা দিয়ে কোনরকমে রাতের খাবারের কোনমেতে যোগান হয় তাদের ছয়-ছয়টি পেটের। তা থেকে যেটুকু বাঁচানো যায়, তাই পরদিন দুপুরের জন্য তুলে রাখতে হয়। পান্তাভাত আর কাঁচামরিচ ছাড়া সকালবেলাটায় বিলাসিতার আর কোন সুযোগ নেই তাই। খুপরির মাটির মেঝেতে এক কোণায় একটা সাদা প্লাস্টিকের টুকরো বিছানো - তাতে বসে পড়ে সে।

‘কী অইল আইজ, কই যাইবা, শার্ট নামাইলা দেহি?’ গপাগপ খেতে থাকা মোতালেব ড্রাইভারের চোখে তখন ঘোরলাগা এক স্বপ্ন – এ বস্তিতে টয়লেট হবে, গোছলের ঘর হবে, টিউবওয়েল হবে, এজন্য ওরা লেগে আছে এনজিওগুলোর পেছনে। আজ একটা এনজিও’র লোকজন দেখতে আসবে তাদের বস্তিটা। মোতালেব ড্রাইভারের থাকতেই হবে কারণ সে বস্তির নেতাদের একজন, মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে একথাটা বলতে চেয়েও বলা হয়ে উঠে না তার। বিশেষত মরিয়মের সামনে উচ্চারণ করতে সাহস পায় না সে, পাছে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠে। বেটি বিছানায় পড়ে থাকলে কী হবে, মেজাজটা এখনো ঠিকই মিলিটারিমার্খা - এদিক ওদিক হলেই চ্যাঁৎ চ্যাঁৎ করে ওঠে।

৩.
সারা বস্তিটা ওরা ঘুরে ঘুরে দেখায়, এ গলি থেকে ও গলি, ও গলি থেকে সে গলি – কিছু কিছু জায়গায় টয়লেট বসানোর জায়গাও দেখায়। খুশি হয় এনজিও’র লোকরা, বিশেষ করে বিদেশী মহিলাটি। বারেবারেই তার মুখে ‘গুড, ভেরি গুড’ শব্দগুলো শুনে ওরা বুঝতে পারে। কিছু কিছু ইংরেজী শব্দের মানে ওরা এখন বুঝে। অনেক এনজিও এখানে কাজ করে, অনেক সময় বিদেশীরাও আসে; তাই এ জাতীয় অনেক শব্দের মানে জানা হয়ে গেছে ওদের। মোতালেব ড্রাইভার তাদের সমিতির খাতাখানা বাঁ হাতের বগলে চেপে রেখে ডান হাতে লুঙিটা একটু উঁচিয়ে ধরে ওদের সাথে সাথে হাঁটতে থাকে। সুযোগ পেলেই বিশেষ করে বিদেশী মহিলাটির পাশে কিংবা পেছনে হাঁটে আব্দুল মোতালেব। ‘কী ঘেরান মাখছে মইলায়, এতো সোন্দর’ হাঁটতে হাঁটতে ভাবে আব্দুল মোতালেব। ‘জিন্সের প্যান্ডের উপর ফউত্তা পরছে মেয়েটা। ইশ্, একবার যদি নিজের ঘরের কাছ দিয়া লইয়া যাইতে পারতাম, তাইলে মইরম আর ফাতেমা বুঝত আমার ওজনটা কিল্লান, আমি কাদের লগে চলাচল করি, ওরা কিল্লান আর তরা কিল্লান। ঘরে খালি খ্যাট খ্যাট, তোর দুইখান পাছা ওর একখান পাছার সমান অইব, দেখ শালি’, ইচ্ছামত শুনিয়ে দিতে পারত মোতালেব ড্রাইভার।

বস্তিটা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে দু’এক জায়গায় টুকটাক ঝগড়াঝাটিও তৈরি হয় জায়গা নিয়ে আর এতে খেপতে থাকে আব্দুল মোতালেবরা মানে বস্তির নেতারা। ‘শালার বস্তির গরুগুলা আর মানুষ অইল না, এদের ভালার লাইগ্যা এতোকিছু করি, এনজিওরা জিনিস দিবার চায়, আর হালার হ্যারায় আছে জায়গা লইয়া, জমি লইয়া, একটায় আরেকটারে গুয়া মারা লইয়া, খানকি মাগীর গলাগুলাও বেশি, মাগিরা সারাদিন পাছায় গু লইয়া বইয়া থাকব, হেই খবর নাই, শালি গো শালি। বেডাগোরে বুক-পাছা দেহাইয়া নদীতে গোছল করতে মজা লাগে; হেগো বাথরুম দিব হেইডা মজা লাগে না’, ধমক দেয় কেউ কেউ। কোথাও কোথাও সবাই একটু সরে গেলে পাতি নেতারা উল্টা ঝাড়ি লাগায়, ‘এই মাগি, বাড়াবাড়ি করলে বস্তি থেইকাই তুইল্লা দিমু, লাত্থি দিয়া কুত্তার মত খেদাইয়া দিমু কইলাম কিন্তু’।

বস্তির কয়েকটা গলি ঘুরেই ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে। ওদেরকে জানানো হয় যে আর ঘুরতে হবে না। এবার সবাই বসে একটু কথা বলবে কোথাও। সবাই মিলে বাধের ওপরেই একটা খোলা জায়গায় বসে পড়ে। আশপাশের ঘরগুলো থেকে খুঁজে-পেতে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার জোগাড় করে ওরা। বসতে দেয় এনজিও’র লোকদের। বিদেশিনী উপরে বসে না, ওদের পাশেই বসে পড়ে চ্যাপ্টা মেরে। ওরা যুগপৎ অবাক ও বিব্রত হয় – কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। নিজেরা যা যা বলবে ঠিক করে রেখেছিল, তাতেও আউলা ঝাউলা লেগে যায় সব দেখে। মোতালেব ড্রাইভারের এতে সুবিধাই হয়, সারাদিন রাস্তায় নানান কিছিমের লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত মোতালেব ড্রাইভার সবার কথায় যোগ দেয়, কেউ কিছু উল্টাপাল্টা বললে ঠিক করে বলে দেয় - আর এতে খুব খুশী হয় এনজিও’র স্থানীয় লোকগুলো, তাদের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারে সে। বিদেশিনীরও চোখ পড়ে তার ওপর, অন্যরা কিছু বলতে গিয়ে আমতা আমতা করলেই ওরা সবাই মোতালেবের দিকে তাকায়। তাতে মোতালেব ড্রাইভারের উৎসাহ বাড়ে, বুকে তার উজানের হাওয়া বয়। একজন রিকশা ড্রাইভার হওয়ার পাশাপাশি বস্তির নেতা হওয়ারও একটা মর্যাদা টের পায় সে। সবশেষে বিদেশিনী তার বক্তৃতা দেয় আর সাতে সাথে একজন বাংলায় বুঝিয়ে দেয়, আর এনজিও’র লোকজনের জোড় হাতের তালুর শব্দের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে ওরাও হাততালি দিতে থাকে কিছুক্ষণ পরপর।

৪.
হাঁটতে হাঁটতে থানাঘাট বাধের মুখে কাউন্সিলর অফিসের সামনেটায় এসে পড়ে সবাই, যেখানটায় বিদেশিনীকে নিয়ে আসা কালো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে এনজিও’র নিশানা বুকে নিয়ে। তারা সবাই খুব খুশি যে এনজিওটা এখানে কাজ করবে বলে কথা দিয়েছে। তাদের খুব পছন্দ হয়েছে জায়গাটা, বিশেষ করে তাদের বড় কর্মকর্তাদের। ‘এরকম উদ্যমী লোক থাকলে কাজ করে মজা পাওয়া যায়’, ওদেরকে দেখিয়ে বলছিলেন একজন। আর তাতেই বুকের ছাতিটা যেন আরো ইঞ্চিখানেক করে বেড়ে যায় মোতালেব ড্রাইভারদের সবার। গাড়িতে উঠার আগে বিদেশিনী ঘুরে দাঁড়ায় আর একবার, সানগ্লাসটা চোখ থেকে সরিয়ে মাথার উপর তুলে দিয়ে সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। হাসিমুখে হাত মেলাতে থাকে সবার সাথে এক এক করে, ধন্যবাদ জানায়। যথারীতি মোতালেব ড্রাইভারও সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে হাতখানা ধরে তার, কী নরম তুলতুলে পেলব স্পর্শ, বিদেশিনী ডান হাতে তার বাড়িয়ে দেয়া হাতখানা চেপে ধরে একটু ঝুঁকে তার হাতের উপর বাম হাতখানাও রাখে, ‘থ্যাংক ইউ আব্ডুল মোটালেব, আই লাইকড ইউ ভেরি মাচ’ বিগলিত হয়ে উঠে মোতালেব ড্রাইভার; কারণ এ শব্দগুলোর মূল মানেটা সে বুঝতে পারে। সে যেন গলে গলে টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। এমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় আব্দুল মোতালেব যে গাড়িটা কখন ধূলা উড়িয়ে ছেড়ে যায় তাও ঠিক টের পায় না। তার চোখের সামনে মরিয়ম-ফাতেমা-জালালদের চেহারা ভাসতে থাকে, তারা যদি সচক্ষে দেখত আজ এসব। তার বুকের ছাতি ফুলে উঠতে থাকে, এদেরকে বলতে হবে আজ, ‘দেখ্, বাইরের লোকজন কী সম্মান করে আমারে’, সে উড়ে উড়ে যেতে থাকে তার খুপরিঘরের দিকে, মনে মনে ভাবতে থাকে কী কী বলবে সে তাদেরকে। মাথার উপর রোদটা ঝাঁ ঝাঁ করছে এখন। পথটুকু পেরোতেই দর্দর করে ঘামতে থাকে মোতালেব ড্রাইভার। খুপরির কাছে গিয়ে পৌঁছাতে পাশের কোন খুপরির রান্নার ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগে, আর এতে ক্ষুধাটা চাগাড় দিয়ে উঠে তার। মনে পড়ে সকাল থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি। খুপরির কাছে পৌঁছে সে হাঁক দেয়, ‘এই ফাতেমা, ভাত দে, খুব খিদা লাগছে’। ভেতর থেকে কোন সাড়া পায় না সে, পা বাড়িয়ে দেখে মরিয়ম বিছানায় কাতরাচ্ছে। ‘কী রে ফাতেমা, কই তুই, ভাত দিতে কইলাম হোনচ না’, চেঁচিযে উঠে আব্দুল মোতালেব। ‘রিকশা চালাইছনি আইজ, বাজার-সদাই আনছ নি, ভাত চাইতাছ? ঘরে কিছু নাই। প্যাডের লাইগা মেয়েডারেও কামে দিছি, এমন জামাই কপালে আছে আমার!’ মনে হয় একটার পর একটা বাজ পড়তে থাকে মোতালেব ড্রাইভারের মাথায়। একটু একটু করে ঘোর কাটতে থাকে তার, নেতা বনবার পাগলা স্রোতের টানে ডুবে যাওয়া মোতালেব ড্রাইভারের সারাদিন একটা ক্ষণের জন্যও নিরন্ন মুখগুলোর কথা মনে পড়েনি। খেয়ালই ছিল না রোজগার না হলে খাবার জুটবে না। তার মনেই ছিল না যে সে আজ রিকশা চালাতে যায়নি – কী যাদু জানে এনজিওদের এই ফেরিওয়ালারা! ‘পোলাপানের প্যাডে ভাত নাই, আবার গ্যাছে নেতাগিরি ছোদাইত’ চাবুকের মতো আব্দুল মোতালেবের গায়ে এসে লাগে মরিয়মের শব্দগুলো। সপাট বাড়ি খেয়ে সে খুপরি ছেড়ে বাইরে এসে পড়ে মুহূর্তেই, শুয়োরের মতো গোঙাতে গোঙাতে বাধের উপর এসে পড়ে সে। আশেপাশে কেউ নেই, মোড়ের দোকানটা দিকে চোখ যায় তার। অনেক দেনা হয়ে গেছে সেখানে, দোকানটারটা আর বাকী দেবে না। নেতা হওয়ার স্বপ্নদেখা, চোখে ঘোরলাগা মোতালেব ড্রাইভার হতভম্বের মতো হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর ভাবতে থাকে এখন কোথায় যাওয়া যায়, কী করা যায়। অন্তত দু’মুটো চাল যদি পাওয়া যেত, কোনরকমে লবনমাখা ভাত খেয়ে হলেও পেটের জ্বালাটা জুড়াতে পারতো। মরিয়মের শেষ কথাটুকু কানে বাজে তার, তার মানে মেয়েটারেও কাজে লাগিয়েছে মরিয়ম। বিদেশিনীর পারফিউমের গন্ধের ঘোর কেটে তার মেয়ের ছেঁড়া ঠেসে যাওয়া জামা আর ময়লা ঘামের দুর্গন্ধটা নাকে এসে ভর করলে সারা শরীরটা গুলিয়ে উঠতে শুরু করে তার। কেমন যেন বমি বমি ভাব হয়। নদীর দিকে মুখ দিয়ে বাধের উপরেই তলপেটটা চেপে ধরে বসে পড়ে আব্দুল মোতালেব ওরফে মোতালেব মিয়া ওরফে মোতালেব ড্রাইভার – মনে হয় বমি করতে করতে পুরো ব্রহ্মপুত্র ভাসিয়ে দিতে পারলেই তবে কেবল একটু শান্তি হত তার!


আশীষ বড়ুয়া
২৫.০৯.২০১৫ ইং
ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৪৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×