বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ভারতের সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থনে শুরু হয়েছে বলে এক তথ্যে জানা গেছে। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের ইকনোমিস্ট পত্রিকাও লেখে যে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গ্রেফতারও ভারতের ইচ্ছায় হয়েছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ- দায়ের ছাড়াই কারাবন্দি করে রাখার পেছনেও ভারতের অনুরূপ ইচ্ছাই কাজ করেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। উপরের ঐ একই সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইন ও গোটা বিচার প্রসেসের সংস্কার দাবি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাতে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিরোধী পক্ষকে দলন-দমনের হাতিয়ার না হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুর সাথে ভারতের সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরোক্ত অভিমতের বিষয়টি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারী ক্লিনটনের মধ্যকার টেলিফোন-আলোচনার ফাঁস হওয়া ট্রান্সক্রিপট সূত্রে জানা গেছে। ঢাকার ইংরেজি পত্রিকা সাপ্তাহিক হলিডে তার গতকাল (২১.০১.১১) এর ইস্যুতে "Geopolitics under Transformation : Washington Expresses 'grave concern' over war crime trial" শীর্ষক প্রধান শিরোনামে এ বিষয়ের ওপর একটা দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারী ক্লিনটনের টেলিফোনিক কথোপকথনের ফাঁস হওয়া ট্রান্সক্রিপ্ট-এর (সরকারিভাবে সমর্থিত নয়) অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে। অংশবিশেষটির সংশ্লিষ্ট অংশ হলো :
"Partial text of the leaked transcript reveals Secreatary Clinton having said to Hasina, "Madame Prime Minister, I have been updated by Ambassador-at-Large Stephen Rapp about his visit to Dhaka. Honestly, at the request of New Delhi, we sent him there and tried our best to help you better organize the (war crime) trial. After listening from Ambassador Rapp and our Ambassador Moriarty, I felt obligated to inform you that both I and President Obama take the isslent. Bangladesh has to reform the whole process in a way so that it doesn't become a conduit of punishing opposition."
In response PM Hasina said, "Madame Secretary, I understand your concern and I already asked my Law Minister to take note of what Ambassador Rapp suggested. This is a trial we undertook with active support and assistance of New Delhi. I am sure Indian Ambassador in Washington DC will brief you further on that." অর্থাৎ ‘‘আংশিকভাবে ফাঁস হওয়া ট্রান্সক্রিপ্টে সেক্রেটারি অব স্টেট ক্লিনটন শেখ হাসিনাকে বলছেন, ‘‘ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যা প তার ঢাকা সফরের পর আমাকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। সত্য ঘটনা হলো, দিল্লীর অনুরোধে তাকে আমরা ঢাকা পাঠিয়েছিলাম এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারের ভাল ব্যবস্থাপনার জন্যে আমরা আপনাকে সাহায্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্রদূত র্যা প ও ঢাকাস্থ আমাদের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির কাছ থেকে শোনার পর আমি এটা আপনাকে জানানো দায়িত্ব মনে করছি, আমি ও প্রেসিডেন্ট ওবামা উভয়েই ইস্যুটা গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশকে অবশ্যই (যুদ্ধাপরাধ বিচারের) গোটা প্রক্রিয়াকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে এটা (এই বিচার প্রক্রিয়া) বিরোধীপক্ষকে শাস্তি দেয়ার অস্ত্র না হয়ে দাঁড়ায়।
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ম্যাডাম সেক্রেটারি, আমি আপনার উদ্বেগ অনুধাবন করছি। আমি ইতোমধ্যেই আইনমন্ত্রীকে রাষ্ট্রদূত রযাধ প যে পরামর্শ দিয়েছেন সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এই বিচারের বিষয়টা আমরা দিল্লীর সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যে গ্রহণ করেছি। আমি নিশ্চিত, ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে আপনাকে আরও ব্রিফ করবেন।’’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট-এর কথোপকথনের এই তথ্য থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ-ইস্যু নতুন করে তোলা এবং এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও গ্রেফতারের মত সব বিষয়ের পেছনে ভারত প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারী ক্লিনটনকে জানিয়েও দিয়েছেন। বিশেষ করে এ ব্যাপারে তিনি ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে রেফার করা এবং তার কাছ থেকে হিলারী ক্লিনটনকে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ইস্যু সংক্রান্ত আরও বিষয় জেনে নিতে বলা প্রমাণ করে, ভারত এ বিষয়টির সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট এবং আরও প্রমাণ হয় যে, ভারত সরকার তার একটা পলিসি হিসাবেই এটা করেছে। যার কারণে ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও এ ব্যাপারে ওয়েল ব্রিফড। এ বিষয়টা আরও প্রমাণ করে, যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুটা ভারতের এজেন্ডা এবং তারাই বাংলাদেশের ওপর এটা চাপিয়ে দিয়েছে। ইস্যুটা বাংলাদেশের হলে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানার জন্য হিলারী ক্লিনটনের কাছে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে রেফার করতেন, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে নয়।
ভারত সরকারের এই ভূমিকার পেছনে তাদের পলিসিটি কি এ সম্পর্কে পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত হলো, শেখ হাসিনার সরকারকে চাপে ফেলে ও যুদ্ধাপরাধের মত বিভেদমূলক ইস্যুতে সরকারকে জড়িয়ে জনবিচ্ছিন্ন করে ভারত তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সব স্বার্থ হাত করে নিয়ে বাংলাদেশকে তার আজ্ঞাবহ রাষ্ট্র বানাতে চায় এবং ভারত তার এই চাওয়া ও পাওয়াকে নিরাপদ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠকে নীরব করার লক্ষ্যেই রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন ও যুদ্ধারাপধ ইস্যু বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে ভারত ইতোমধ্যে কিছু সফলতাও পেয়েছে। রাজনৈতিক নির্যাতন-নিপীড়ন, মামলা-হামলা ও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর ডামাডোলের মধ্যে ভারত ট্রানজিট, করিডোর, বন্দর ইত্যাদি পাওয়া, বিদ্যুৎ-করিডোর নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশের ন্যাশনাল গ্রিডে প্রবেশ করা, বাংলাদেশকে বন্ধুহীন করা, সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশকে ভারতের চারণভূমি বানানো ইত্যাদি বিষয়ে কিছু চুক্তি সম্পাদনে এবং কিছু কাজও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্ত-প্রতিরক্ষা তছনছ হয়ে যাওয়া এবং আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অপরিমেয় ক্ষতি হওয়ার জন্যও পর্যবেক্ষক মহল ভারতকেই দায়ী করেন। বাংলাদেশের বিরোধীদল ও জনগণের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, মামলা-হামলা ও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর খড়গ ঝুলিযে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে না পুরলে ভারত এতটা অগ্রসর হতে পারতো না।
সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম