‘সিরাজদ্দৌলাহ’ নাটকে নবাব সিরাজের একটি সংলাপ এরকম : বাঙালি হাসতে জানে না, জানে শুধু কাঁদতে। এ কথাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড়, সেকালেই। তার ভাঁড়ামি এক সময় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল। লোক হাসানোর দায় তিনি স্বেচ্ছায় মস্তকে তুলে নিয়েছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্রের মাইনে করা এই গোপাল শেষতক বাংলা সাহিত্যের রম্য শাখায় এক দিকপাল হয়ে বেঁচে রইলেন। প্রাক-গোপাল যুগেও বাঙালিকে হাসানোর জন্য ঢের রসিক জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গদেশের আনাচে-কানাচে যে বিস্তর রসকথা ছড়িয়ে আছে, তারাই সে সবের রচয়িতা। কাজেই বাঙালি ঠিকমত ভাত-মাছটা পেলে হাসে না—একথা ঠিক না। এসব বিবেচনা করেই কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বোধকরি লিখেছিলেন—‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা।’ বাংলার প্রাকৃতিক সতেজতা আর বাঙালির রসগ্রাহিতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হয়েই তিনি এই রসবাক্য রচিয়েছিলেন। এক কথায় রং আর রঙ্গ মিলেই বঙ্গদেশ। তবে একালে রস এবং রসিক, রং এবং রঙ্গ—দুয়েরই আকাল পড়েছে। এমনকি কাতুকুতু দিয়েও লোক হাসানো যায় না; বরং রেগে যায়। যে জাতির সবাই কম-বেশি কবি বলে সুখ্যাতি রয়েছে, সে জাতি গত শতকের শেষার্ধ থেকে বিমর্ষ হতে হতে যেন হারিয়ে ফেলেছে জীবনের সব সিমম্ফনি। গড় বাঙালির বদন এখন পলেস্তারা খসে পড়া ছাদের মতো, যেন ক্রমেই মরুময় হয়ে উঠছে তাদের চিত্তভূমি। হানাহানি, কামড়াকামড়ি, ভড়ং-বাঁদরামি বৃদ্ধি পেলে যা হয়। এখন ভরসা গাম্ভীর্য। বেশিরভাগ লোক কেবলই গম্ভীর হচ্ছে কিংবা গলাবাজি করছে, একজন অন্যজনকে কথায় এমনকি ইঙ্গিতে ব্যঙ্গ করছে। তাহলে হাসি ফুটবে কীভাবে, কোন ভরসায় ঠোঁটে কিংবা চোখে? কাচভাঙা হাসি, বাঁধভাঙা হাসি, বুকফাটা হাসি এমনকি অট্টহাসিও ভুলতে বসেছে লোকে। মানুষ বাড়তে বাড়তে এমন হয়েছে যে, গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগছে চলতে-ফিরতে-বসতে-হাঁটতে। কিন্তু হৃদয়ে হৃদয়ে দূরত্ব আকছার বাড়ছেই। কে কার আগে যাবে—এই নিয়ে এত পেরেশান হলে শূলে চড়ানোর ভয় দেখিয়ে তো আর হাসানো যায় না কাউকে। এ বছর চল্লিশেক আগেও জনসভায় কিংবা সংসদে নেতারা কৌতুক বলে লোক হাসাতেন। এখন তারা পরস্পর জঙ্গে লিপ্ত। কাজেই হাসির জায়গা দখল করেছে বকাবকি। রঙ্গলাল বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন নতুন পদ্য—‘রঙ্গভরা বঙ্গদেশ জঙ্গ করে সারা।’
আজকাল প্রাণ খুলে তো বটেই, মুচকি হাসলেও উল্টো ধাতানি খেতে হয়। প্রেমিক হাসলে প্রেমিকা খসখসে গলায় বলে ওঠে, তুমি তো সবকিছু হেসেই উড়িয়ে দাও। ক্লাসে শিক্ষার্থী হাসলে শিক্ষক বেত্র উঁচিয়ে বলেন, এটা হাসার জায়গা নয় চান্দু। জ্ঞানীরাও প্রায়ই শ্রোতাদের বলেন, না বুঝে হেসো না। এমনকি পারিবারিক পরিবেশে হাসলে বাপ ছেলেকে ধমকে বলেন, বড় বেশি বেয়াদব হয়ে গেছ। কাজেই নির্মল হাসি এখন কম-বেশি অবুঝ শিশুর ঠোঁটেই শোভা পায়। কেউ আবার বিনা কারণেই শিশুর মতো হাসে। জানতে চাইলে বলে, কিছু বুঝতে পারছি না বলে হাসছি। না হাসার চেয়ে তাও ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হাসি কমে গেলে কিংবা হাসাহাসি হ্রাস পেলে মানুষ প্রাণ খুলে কাঁদবে কী করে? হাসা-কাঁদা তো এক সুতোয় গাঁথা দুই পুষ্প। বোধকরি হাসি কমে গেছে বলেই এখন মানুষ অন্যের দুঃখে তেমন করে আর কাঁদে না। রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকলেও বিচলিত হয় না। এই যে কান্নার আকাল, তা এই হাসির ঘাটতি থেকেই। হেসে হেসে জীবন দেয়ার কথা শোনা যায়। সে অবশ্য কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। মরার সময় হাসার ফুরসত কৈ! তবে হাসিতে আয়ু বৃদ্ধির কথা বিজ্ঞানীরাও বলেন। অন্তত ঠোঁট দিয়ে না হাসলেও চোখ দিয়ে হাসুন। চোখ নাকি পড়া যায়। ঠোঁট অবিচল রেখেও হাসা যায় চোখে চোখে! না হাসার আরেক সঙ্কট আছে। তা হলো: যারা নিজেরা মুখ ভার করে থাকেন তারা অন্যদের হাসাবেন কী করে! কাজেই যারা হাসিয়েছেন লেখালেখি করে, তারা সবাই ছিলেন হাস্যরসিক। কিন্তু সবাই তো আর সৈয়দ মুজতবা আলী কিংবা শিবরাম চক্রবর্তী নন, নন হোজ্জা, গোপাল ভাঁড়ও। মুজতবা আলীর সেই কাবুলের সরাইখানা থেকে ঠাণ্ডা আণ্ডা খাওয়ার গল্প পড়ে হাসেনি অথবা হাসবে না এমন নাদান লোক বঙ্গে কেন বিশ্বেও নেই। কলকাতা শহরে যখন নিষ্করুণ জীবনের হাহাকার, হৃদয়হীন মানুষের উল্লমম্ফন, তখন হাস্যবিদ শিবরাম চক্রবর্তী নিজেই নিজেকে হাসানোর জন্য এক অভূতপূর্ব কায়দা আবিষ্কার করে বসলেন। শিবরাম বানান পাল্টে লিখলেন ‘শিব্রাম’। এই হচ্ছে রসবোধ।
হ্যাঁ, হাসতে হলে রসবোধ চাই। সাহিত্যে করুণরস, বীররস, অদ্ভুতরস ইত্যাদি নামে আলঙ্কারিকরা রসকে ভাগ করেছেন নানা ধারায় রম্যকথক বা রস রচয়িতারা। এই রসভাণ্ডার থেকে বেছে নিয়েছিলেন ‘হাস্যরস’। পদ্য রচনা করে বাঙালিকে ঢের হাসিয়েছেন কবি ঈশ্বরগুপ্ত। তার একটি চরণ তুলে ধরছি—‘ইন্সপেক্টর পদি পিসি/তার আন্ডারে কলম পিষি।’ অর্থাত্ তিনি এক মহিলার অধীনে করণিকের চাকরি করতেন। পণ্ডিত বিদ্যাসাগরও ঢের হাসির খোরাক রেখে গেছেন। একবার এক দরিদ্র লোক তার কাছে অর্থ সাহায্য চেয়ে জানালেন, মহাশয়, বড়ই দুরাবস্থায় আছি। বিদ্যাসাগর মৃদু হেসে বললেন, তা ঐ আকার (া) থেকেই বুঝতে পেরেছি। এ ধরনের রম্য লেখক এখনও আছেন। কিন্তু লোকে আর প্রাণ খুলে হাসার চর্চা করে না বলে তাদের লেখা পাঠ্য তালিকা থেকে ক্রমশ বাদ পড়ছে।
কবি রবীন্দ্রনাথ খুবই হাস্যরসিক ছিলেন। কিন্তু তার হাস্যময় কোনো ছবি নেই। থাকলেও দুর্লভ। এ নিয়ে একটা মজার জোক আছে। একবার এক প্রাইমারি স্কুলছাত্র তার শিক্ষককে জিজ্ঞেস করল—স্যার, রবীন্দ্রনাথকে নাকি কেউ হাসতে দেখেনি। শিক্ষক হেসে জানতে চাইলেন—এ কথা তুমি কোথায় শুনেছ? ছাত্র বলল, রবীন্দ্রনাথের কত ছবি দেখেছি, কোনোটিতেই তার হাসি নেই। শিক্ষক হো হো করে হেসে ফেললেন এবং বললেন, রবীন্দ্রনাথ হাসতেন ঠিকই; কিন্তু তার ঠোঁট দাড়ি-গোঁফের আড়ালে থাকতো বলে দেখা যেত না। কাজেই হাসির জন্য দাড়ি-গোঁফ কোনো বাধা নয়। দ্রোহ-প্রেম-আনন্দ-বিষাদ—সব অবস্থায়ই হাসা দরকার। নইলে আবার মানুষ কিসের! মানুষ ছাড়া জগতের আর কোন জীব হাসতে পারে বলুন! কাজেই হাসুন। অন্তত ক্যামেরাম্যান যখন ছবি তোলার সময় বলেন—‘একটু হাসুন, এখন হাসুন।’
একবার থানার পাশের রাস্তা দিয়ে এক চোর দৌড়ে পালাচ্ছিল। টের পেয়ে তার পিছু নিল থানার এক পুলিশ। পুলিশ চোরকে পেছনে ফেলে এক দৌড়ে চলে গেল সামনের রাস্তায়। এ দৃশ্য দেখে একটি লোক পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন, চোর না ধরে দৌড়ে আগে চলে আসলেন যে! পুলিশ সহাস্যে উত্তর দিলেন, চোর যত সবলই হোক, দৌড়ে পুলিশের আগে যেতে সক্ষম নয়।