গত সপ্তাহে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। 'এক্সেস টু জাস্টিস' ধারণার অংশ হিসেবে আশপাশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুমানিক তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করে।
পর্যবেক্ষণ:
১) মানসিক আঘাত ও ট্রমা:অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া অন্তত ছয়জন শিক্ষার্থীকে দেখে মনে হয়েছে, তারা স্থায়ীভাবে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD)-এ আক্রান্ত। ভয়, আতঙ্ক, হতাশা ও সহিংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার ফলে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, তিনি আহত বা অসুস্থ তখনই হননি, বরং বিচার না দেখে দেখেই তিনি অসুস্থ হয়ে গেছেন। বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অসংলগ্ন হয়ে পড়েন।
২) পুলিশি নির্যাতন ও নিপীড়ন:একজন শিক্ষার্থী জানান, তার বাসা ছিল ধানমণ্ডি ৫, সুদা সদনের আশপাশে। তার মোবাইল থেকে জুলাই মাসের সকল অডিও, ভিডিও ও ছবি মুছে ফেলা হয়। তবে তার মা একটি নোটবুক প্যাডে এসব ট্রান্সফার করে রেখেছিলেন। পুলিশের অভিযানের সময় তার ফোনে কিছু না পেলেও, তার মায়ের নোটবুক প্যাডে থাকা ডকুমেন্টগুলো কাল হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ তা পাওয়ার পরই তাকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে। ভয়াবহ নির্যাতনের ফলে সে মূত্রত্যাগ করে ফেলে, এরপর তার মা ও বোনের সামনে তাকে নগ্ন অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ধানমণ্ডি থানায় নিয়ে গিয়ে তার হাঁটু ও পিঠে চরম নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের সময় তাকে বারবার 'তুমি কে, আমি কে, বাংগালি বাংগালি'—এমন স্লোগান দিতে বাধ্য করা হয়, এবং বাংগালি বলার সাথে সাথেই মারধর করা হতো। পরে তাকে গভীর রাতে ভাটারা থানায় স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে আবারও নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের ফলে তার হাত ফুলে যায় এবং সে টানা ১১ দিন বন্দী ছিল।
৩) গণগ্রেফতার ও কোটার হিসাব:সেসময় প্রতিটি থানায় নির্দিষ্ট সংখ্যক বন্দি আটক করার কোটা নির্ধারণ করেছিল। ঢাকায় প্রতি থানায় ১০০ জনের কোটা ছিল একদিন, কিন্তু সেদিন রাত ৮টা পর্যন্ত সেই থানা ১০০ বন্দী গ্রেফতার করতে পারেনি । থানার কোটা পূরণ করতে এক পর্যায়ে রাত ১টায় সিএমএম কোর্ট বসিয়ে বন্দিদের আদালতে পাঠানো হয়। আদালত অনেক ক্ষেত্রেই যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, তাদের বয়স ১৯ দেখিয়ে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
৪) বন্দি শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ:বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকের কারাগার সম্পর্কিত কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না। তারা জানত না কারাগারে কীভাবে টাকা রাখা যায়, জামাকাপড় সংগ্রহ করা হয়, কিংবা খাবারের ব্যবস্থা কীভাবে হয়। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী কারাগারের খাবার খেতে পারেনি। ১২ দিন পর্যন্ত কিছু বন্দি শিক্ষার্থী শুধু বিস্কুট ও পানি খেয়ে টিকে ছিল।
৫) গুম ও গোপন সেলে আটকের অভিযোগ:অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে বিশেষায়িত কিছু টিম গুম করে। একটি বিশেষ সংস্থার গোপন সেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ মোট ৩৫ জনকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছিল।
৬) রাতের ব্লক রেইড ও তথ্য ধ্বংস:সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ছিল রাতে ব্লক রেইড চালিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন। বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে তথ্য ও প্রমাণ নষ্ট করার জন্য নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালানো হয়।
৭) আহত শিক্ষার্থীদের ওপর পুনরায় নির্যাতন:বাড্ডায় এক শিক্ষার্থী তার চোখ হারানোর পর, তাকে মহাখালীতে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় মারধর করা হয়। চক্ষু হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে থাকা এক চিকিৎসক তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। পরে যখন তার অপারেশন হয়, তখন ছাত্রলীগ সদস্যরা হাসপাতালে ঢুকে আহতদের ওপর আরও নির্দয় নির্যাতন চালায়।
৮) শিক্ষক ও প্রশাসনের ভীতিকর অভিজ্ঞতা:এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিহত শিক্ষার্থীদের সন্ধানে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়ান। ঢাকা মেডিকেলে অসংখ্য লাশ দেখতে পান, কিন্তু তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের খুঁজে পাননি। পরে মিরপুর ও আজিমপুরের রাস্তায় থাকা লাশের মধ্যে কিছু পরিচিত মুখ দেখেন। সরকারি হাসপাতালের মর্গে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে, তিনি এক নার্সের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, লাশবাহী গাড়িতে অগণিত মৃতদেহ রাখা ছিল।
৯) সাধারণ মানুষের ওপর সহিংসতা:ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের দুই শিক্ষার্থী জানান, কারফিউ চলাকালে একজন মুয়াজ্জিন আজান দিতে বের হলে, তার সামনে গুলি চালানো হয়। তাদের বাসায় গিয়ে পুলিশ ও বাহিনী হুমকি দিয়ে আসে, যেন তারা এসব ঘটনা নিয়ে মুখ না খোলে।
পোস্ট সুত্র

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


