কানেক্টিং দ্য ডটসঃ পিএসসি-জেএসসি-এসএসসি পরীক্ষা ও মধ্যবর্তী নির্বাচন
১/ যারা ২০১২ সালে জেএসসি পাশ করেছে তারাই এবছর ২০১৫ সালের এস এস সি পরীক্ষার্থী। এই ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শ্রেনীর রাগ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক কারন এরাই ২০১২ সালে মুদ্রিত ২০ পৃষ্ঠা (পৃষ্ঠা ১০ থেকে ২৮) জুড়ে লেখা মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত ব্যাকগ্রাউন্ড, যুদ্ধের অবকাঠামো গত তথ্য, যুদ্ধ পরিচালনা কালীন কর্মপন্থা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীকারীদের কদর্য-ভূমিকার বিবরণ সম্বলিত অষ্টম শ্রেনীর পাঠ্য বই পড়া প্রথম ব্যাচ। এই সব ছেলে মেয়েরা খুব স্পষ্ট ভাবেই জেনে এসেছে যে ৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত পেরিয়ে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেস যোগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেন যে "এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছে, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে দখলদার বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্যে আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে"। [পৃষ্ঠা ১৬, অষ্টম শ্রেনী, বিষয়ঃ বাংলাদেশ ও বিশ্ব ] । এই ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই জেনে বড় হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকার বলে সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হলেন শেখ মুজিবুর রহমান; মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ন রূপে পরিচালিত হয়েছে '৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক সরকার (যা মুজিব নগর সরকার বলে পরিচিত) এর অধীনে যাতে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী কে। এই তৃতীয় শ্রেনী থেকে অষ্টম শ্রেনীর এই বই গুলোতেই খুব স্পষ্ট ভাবে বলা আছে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ "মেজর" জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
যারা এতদিন মাথা চুলকে বার বার ভেবে আসছিলেন যে কেন একজন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সন্তান বিদেশের মাটিতে বসে মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন নানান ঘটনাতে "Hi" যুক্ত করে নানান "story" লিখছেন আর সেগুলোকে "History" নাম দিয়ে নিজের কর্মী বাহিনীকে "বুঝেছ তো? ... এগুলো জানতে হবে" বলে বলে বুঝাচ্ছিলেন ...তার কারন হল এইই। এই বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সত্য ইতিহাসের বলে বলীয়ান হয়ে যাচ্ছে... আর সেটা ঠেকাতেই বারবার নতুন Hi-story নিয়ে হাজির হচ্ছিলেন এই অধুনা "Hi-story বিদ" যেন এদের মধ্যে থেকে অন্তত একটা ফ্র্যাকশান হলেও দলে টানা যায় । সেটাতে ব্যার্থ হয়েই শেষ পর্যন্ত এই ব্যাচটার শিক্ষা জীবনকেই উৎকণ্ঠিত আর কণ্টকিত করতে উদ্যত হয়েছেন সেই "Hi যুক্ত Story বিদ"।
২/ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা এই ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরাই ২০১৮ সাল নাগাদ ভোটার হবে। একারনে ২০১৯ সালে নির্বাচন হলে এরাই হবে সেই নির্বাচনের নতুন ভোটার। আর বিভিন্ন সময়ে এটা প্রমানিত যে নির্বাচনে হারজিৎ নির্ধারিত হয় নতুন ভোটার দ্বারাই। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা এই নতুন ভোটাররা ভোট দিতে পারার আগেই নির্বাচন হওয়া জরুরী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির জন্যে। তাই চাই মধ্যবর্তী নির্বাচন... এরা ভোটার হওয়ার আগেই।
[এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে আশির দশকের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাস থেকে সফল ভাবে অন্ধকারে রাখতে পারাতেই সেই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও পরবর্তী ঘটনা নিয়ে নানান তথ্য বিভ্রান্তিতে ভোগেন। আর এতে করে এই জনগোষ্ঠীই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির মূল ভোট ব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছিল এবং এরাই এখন পর্যন্ত চলে আসা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দ্বারা ছড়ানো নানান প্রোপাগান্ডার মূল বাহক ও বিশ্বাস কারী। আর এই কাজটা তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী করেছিলেন পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধকে অতি সংকুচিত ভাবে উপস্থাপন করে। একারণে ২০১২ সালে মুদ্রিত সকল পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ কে যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করা বিরাট থ্রেট হিসাবে দেখবে ঐ সব রাজনৈতিক শক্তি গুলো এটা বলাই বাহুল্য।]
৩/ যারা ২০০৯ সালে প্রথম ব্যাচ পিএসসি পরীক্ষার্থী ছিল, তারাই ২০১২ সালের জেএসসি পরীক্ষার্থী... আর তারাই এবারের মানে ২০১৫ এর এসএসসি পরীক্ষার্থী। এদেরকে বঙ্গবন্ধুর জীবনী সহ বাংলাদেশের জন্মের অন্যতম রূপকার চার নেতা, মুজিব নগর সরকার ইত্যাদির বিস্তারিত পড়তে হয়েছে একেবারে তৃতীয় শ্রেনী থেকেই। আর যেহেতু বছর শেষে পিএসসি আর জেএসসি ন্যাশনাল পরীক্ষা বাধ্যতা মূলক, তাই টিচাররা পাঠ্য বইয়ের কোন একটি "বিশেষ" অংশ "এড়িয়ে" গেলেও বা "নিজের মত করে" পড়ালেও জাতীয় পরীক্ষার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা ঐ সব অংশ পড়তে বাধ্য হচ্ছে যা কিনা পিএসসি আর জেএসসি পরীক্ষা উঠে গেলে না পড়লেও হয়ত চলত। একারণে পিএসসি আর জেএসসি পরীক্ষা কে বিতর্কিত করাটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন দেশের "জ্ঞানী" "গুনী" ও "চিন্তাবিদ" ব্যক্তিরা পিএসসি-জেএসসি বাতিল করা হোক বলে রায় দেন। কিন্তু সত্য হল পিএসসি আর জেএসসি পরীক্ষার চাপ না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা হবে না ছাত্র ছাত্রীদের। সেই সাথে এই পাঠ্য পুস্তক গুলোর প্রতি পাঠের শেষে যেভাবে অনুশীলনী যোগ করা হয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবেঃ অষ্টম শ্রেনীর বইয়ের অধ্যায় দুই, পাঠ ছয়ের শেষে "অনুশীলন মূলক কাজ" অংশের দুটি কাজ হলঃ কাজ ১/ মুজিব নগর সরকারের পরিচয় দাও কাজ ২/ সে সময়ে এ দেশের জনগনের অবস্থার একটি চিত্র তুলে ধর।
জে এস সি পরীক্ষা থাকার কারণে কিছু শিক্ষক যারা "সিলেক্টিভ" ইতিহাস ছাড়া পড়ান না তারাও পুরোটা পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন আর ছাত্র-ছাত্রীরা আসলে "সত্যটাই" অর্থাৎ পাঠ্য পুস্তকে যা আছে সেটাই জানছে কিনা এবং সুষ্ঠু ভাবে জানছে কিনা তা যাচাই করে নেয়া যাচ্ছে।
৪/ কারো জ্ঞান বা জানা তথ্য যদি খন্ডানো কঠিন হয়ে যায়, তাহলে ঐ জ্ঞানী বা জানা ব্যাক্তিকে কূপোকাত করার সবচাইতে সহজ উপায় হল ঐ জ্ঞানী ব্যাক্তির ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করে দেয়া যেন মানুষ ঐ ব্যাক্তির কথা কানে না নেয়। ২০১২ সালের পর জাতীয় পাঠ্য পুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের পূর্বকথা, পাকিস্তানের বর্বরতা, মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু সহ যুদ্ধকালীন জাতীয় নেতাদের ভূমিকা নয়; অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে নৈতিকতা, নারী -পুরুষের সম অধিকার সংক্রান্ত বিষয়াদি, ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ সহ নানান বিষয় যা নিয়ে ধর্ম ব্যাবসায়ী সহ বিভিন্ন সুবিধা বাদী গোষ্ঠী ফায়দা লুটে আসছে। এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস বা বেশী পাশের হার বা কাড়ি কাড়ি জিপিএ ৫ এই সব বিতর্কিত বিষয় সামনে এনে এই সব ব্যাচের ছেলে মেয়েদেরকে মেধাহীন আখ্যায়িত করার একটা প্রয়াশ বেশ স্পষ্ট। যেহেতু এই সব পাঠ্য পুস্তক পড়া ছেলে মেয়ারা ভবিষ্যতে "কিছু" মহলের জন্যে থ্রেট হিসাবে আবির্ভূত হবে, তাই আগে ভাগেই এই সব ব্যাচকে "মেধাহীন" ব্যাচ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্যনীয়। ইদানীং কালে ফেসবুক সহ ভুঁইফোর সব অনলাইন পত্রিকাতে যে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে দিয়ে বিনা পয়সায় ছাত্র ছাত্রীদের হাতে তুলে দেয়, তা যতটা না সরকারকে বিব্রত করার জন্যে, তারচাইতে বেশী ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। ভাবখানা এমন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াতেই এরা পাশ করছে বা ভাল রেজাল্ট করছে, কিন্তু আদতে এরা যা জানে তা সব গার্বেজ। অর্থাৎ এরা যা জানে সেই "জানা" ব্যাপারটিতেই যত সমস্যা কিছু মহলের।
অথচ স্ট্যাটিসটিক্স অনুযায়ী কিন্তু প্রায় ঠিকটাই ঘটছে রেজাল্টে, ৫%-৮% ছেলেমেয়েই টপ রেজাল্ট করছে বা জিপিএ ৫ পাচ্ছে। আর আরেকটি বিষয়ও খেয়াল রাখা কর্তব্য যে এই জেএসসি-পিএসসি পরীক্ষা চালুর আগেও কিন্তু ছেলে মেয়েরা ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে আর এইট থেকে নাইনে উঠেছে। যেকেনো স্কুলে ক্লাস ফাইভে আর এইটের ফাইনাল পরীক্ষাতে কি ১০%-১২% এর বেশী অকৃতকার্য হত আগে? এখন জেএসসি-পিএসসি পরীক্ষা চালু করে বরং একটা মনিটরিং এর ব্যাবস্থা করা হয়েছে যেন এটা নিশ্চিত করা যায় যে ছেলে মেয়েরা পাঠ্য পুস্তকে যা আছে তাই ই জানছে ... অন্য মন গড়া কিছু নয়। এই ব্যাচের ছেলে মেয়েদেরকে খুব সুচারু ভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে জনগণের কাছে "মেধাহীন" হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন এরা এদের পাঠ লব্ধ জ্ঞান থেকে পরিবার পরিজনদের কাছে যুক্তি যুক্ত ভাবে কিছু তুলে ধরলে সেগুলোকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেন তারা।
এখানে চলছে সেই চিরন্তন খেলাঃ "জ্ঞান" যদি ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে জ্ঞানীকেই মানুষের কাছে অজ্ঞান হিসাবে প্রমানিত কর যেন তাঁর জ্ঞানকে মানুষ মূল্যহীন জ্ঞান করে উপহাসে উড়িয়ে দেয়।
[সকল শ্রেনীর পাঠ্যপুস্তক ডাউন লোড করা যাবে এই লিঙ্ক থেকেঃ
http://www.nctb.gov.bd/downloadpage22.php]
কার্টেসি - Anjuman islam

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




