Annarasumanara (মানহোয়া রিভিউ)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ছোটকালে মানুষের জীবন থাকে অনেক রকমের স্বপ্নে পূর্ণ, জীবনের প্রতিটি ছোটবড় ঘটনা যেন জাদুর ছোঁয়ায় হয়ে উঠে রঙিন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে যেন সেই সব অদ্ভুত সৌন্দর্যময় দিনগুলি জায়গা ছেড়ে দেয় কর্মব্যস্ততার জীবনকে, জাদুময় পৃথিবীকে গ্রাস করে নেয় নির্মম বাস্তবতা। সমাজে সম্মানজনক অবস্থানের জন্যে বেঁছে নিতে হয় ভাল পেশা, পরিবারকে দেখে শুনে রেখে দুনিয়ার সামনে মাথা উঁচু করে হেঁটে চলবার পথ। নিজে ভালমতো খেয়েপরে নিয়ে সবাই চায় তাদের সন্তানেরাও যেন তাদের দেখানো পথে চলে, সবাই যেন ঠিকমতো “বড় হয়ে উঠে”।
তবে কেউ যদি সমাজের দেখানো পথে “বড় হয়ে উঠতে” না চায়, তাহলে কী হবে? সমাজ কি তার এই “ছোট থেকে যাওয়া” মেনে নিবে? নাকি সবাই তাকে আর সবার মতই তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যে উঠেপরে লাগবে?
তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, সবার দেখানো পথে “বড় হয়ে উঠে” জীবন গড়ে তুলার বিরোধিতা করে ছোটকালের সেই স্বপ্নময় জীবনকে তাড়া করে ছুটলে কী হবে সেই মানুষটির? তার জীবন কি সেখানেই থেমে থাকবে? নাকি কারও তোয়াক্কা না করে আপন গতিতে ছুটে চলতে পারবে জীবনের পথে?
Annarasumanara নামক কোরিয়ান মানহোয়াটি পড়ার সময়ে এরকম বিচিত্র প্রশ্ন মাথায় আসবে পাঠকদের। Ha Il-Kwon এর আঁকা ও লেখা এই ওয়েবটুনটি ৩টি ভলিউমে ২৭ চ্যাপ্টারে প্রকাশিত হয়।
কাহিনী: গল্পের নায়িকা Yoon Ah-Ee এক গরীব পরিবারের মেয়ে। পড়াশুনায় তুখোড় এই ছাত্রীর জীবন দারিদ্রতায় অসহনীয় হয়ে উঠে। পরার কাপড় ছিড়ে গেলেও নতুন কাপড় কিনতে চিনতা করতে হয় যে এই খরচের পর মাসের বাকি দিনের জন্যে খাবার কিনবার মত টাকা থাকবে নাকি হাতে। নতুন ক্লাসে তার পাশের চেয়ারেই জায়গা হয় Na Il-Deung-এর, যে শহরের অন্যতম ধনী পরিবারের ছেলেই শুধু নয়, ভাল ফলাফলে সবাইকে ছাপিয়ে স্কুলের সেরা ছাত্রও বটে। পড়াশুনার জন্যে অঢেল টাকা খরচ করে ফেলা তার কাছে কোন ব্যাপারই নয়। এদিকে এত বড় সম্পদশালী পরিবারের ছেলের পাশে বসে থেকে Ah-Ee-এর চিন্তাভাবনায় সারাক্ষণ চলে আসে তাদের দুজনের মধ্যে জীবনধারণের পথের এত বড় পার্থক্যের ব্যাপারটি।
তাদের স্কুলে একদিন হঠাৎ একটি গুজব ছড়িয়ে পরে যে পরিত্যক্ত এমিউজমেন্ট পার্কে এক জাদুকর এসে উঠেছে, আর সেখানেই থাকে এখন। জাদুকরটি একটু রহস্যময়, আর সে নাকি যেকোন মানুষকে গায়েব করে দেবার জাদু দেখাতে গেলে সত্যি সত্যি সেই মানুষকে গায়েব করে ফেলতে পারে। Yoon Ah-Ee ঘটনাচক্রে একদিন সেই জাদুকরের সামনে পরে, যে তাকে প্রথমেই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, “Do you believe in magic?”
Ah-Ee এর ছোটকালে সবসময়ে শখ ছিল জাদু শিখা, বড় হয়ে সে হতে চেয়েছিল একজন জাদুকর। কিন্তু তার বাবা তাকে ও তার ছোট বোনকে ফেলে চলে যায় ঋণের বোঝা মাথায় চাপিয়ে দিয়ে। সংসারের টানাটানিতে এক সময়ে ছোটকালের সেই সুন্দর স্বপ্ন ঝেড়ে ফেলে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। নুন আনতে পান্তা ফুরানো জীবনে সে জলদি বুঝে উঠে, পড়াশুনায় ভাল ফলাফল করে ভাল একটি চাকুরী পেতে হবে তাকে। আর তাই এতদিন পর ছোটকালের সেই পূরণ করতে না পারা স্বপ্নের ব্যাপারটি তাকে গভীরভাবে আঘাত করে। জাদুকরের জীবন বেঁছে নিলে পরিবারকে কী খাওয়াবে? সমাজ তাকে কী চোখে দেখবে? সত্যিকারের জাদু বলতে কিছু নেই। এটি শুধুই চোখে ধুলো দেওয়া এক খেলা, যা মানুষকে বিনোদনই দিতে পারে, এর বেশি কিছুই না।
এদিকে রহস্যময় জাদুকর বারবার তাকে একটি কথাই বলে, সে সত্যিকারের জাদুকর। সে সত্যি সত্যিই জাদু জানে। কথাটি Ah-Ee মেনে নিতে না চাইলেও তাকে মাঝেমাঝেই কিছু অবাস্তব ধরণের জাদু দেখিয়ে দিতে থাকে। আর সেই সাথে Ah-Ee-কে একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, তার ছোটকালের স্বপ্ন কি সে চাইলে এখনও পূরণ করতে পারবে?
চরিত্র: গল্পের মূলে রয়েছে তিন প্রধান চরিত্র: দরিদ্র কিন্তু মেধাবী ছাত্রি Yoon Ah-Ee, বড়লোক ঘরের দেখতে হ্যান্ডসাম ও মেধাবী ছাত্র Na Il-Deung, এবং রহস্যময় জাদুকর। পুরো গল্পটি এই তিনজনকে কেন্দ্র করে গড়ে হয়ে উঠে, আর ধীরে ধীরে তিনজনেরই চরিত্রের বিকাশ দেখানো হয়েছে সুন্দরভাবে।
বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে অনেক পরিণত চিন্তার Yoon Ah-Ee জানে অনেক পরিশ্রম করে গরীব পরিবারের হাল ধরতে হবে। আবেগে গা ভাসিয়ে না দিয়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়া তার সিদ্ধ্বান্তে লক্ষণীয়।
Il-Deung বিশ্বাস করে উন্নত সুখময় জীবনের জন্যে দরকার অনেক টাকা-পয়সা ও ভাল পেশা। আর বড়লোকের ঘরে জন্মানোতে সে সেইসব সুবিধা উপভোগ করতে পেরে নিজেকে আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান ভাবে।
বিলাসিতার জীবন ছেড়ে আসা জাদুকর নিজের জীবনের স্বপ্নের পথেই পা বাড়ায়। বয়স বাড়লেও, মানসিকভাবে কখনও বড় হয়ে উঠতে না চাওয়া এই জাদুকর সবাইকে মনের কোনে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটিকে জাদু দেখিয়ে আনন্দ দেখিয়ে বেড়ায়। তার বিশ্বাস জীবনে সবসময়ে স্বপ্নের পথেই এগিয়ে যাওয়া উচিৎ, সমাজের বাহবা পাওয়ার লক্ষ্যে নিজেকে বিলিয়ে না ইয়ে জীবন উপভোগ করাই হওয়া উচিৎ জীবনের সত্যিকারের লক্ষ্য।
আর্ট: মানহোয়াটির আর্টের মধ্যে একটা অন্যরকম সৌন্দর্যের ছোঁয়া আছে। মাঝে মাঝে এবস্ট্রাক্ট আর্টের ব্যাপারটি চোখে পরার মত, আর সেই সৌন্দর্য অনেক বেশি উপভোগ্য! জাদুর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা মানহোয়াটিতে মাঝে মাঝেই দেখা যায় একটি পুরানো বন্ধ হয়ে যাওয়া এমিউজমেন্ট পার্কের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য! চিত্রবহুল এই মানহোয়াতে এক প্যানেল থেকে আরেক প্যানেলে অংকনের পরিবর্তনগুলি কাহিনীতে গভীর ছাপ ফেলে। সবচেয়ে বেশি চোখে যা পরবে তা হল আর্টে একটা ডার্ক থিম থাকলেও কাহিনী সেরকম ডার্ক নয়, যাতে এ দুটি জিনিসের কম্বিনেশন অসাধারণ হয়ে উঠেছে!
একজন বাস্তববাদী, একজন অভিজাত-বংশীয় এবং একজন জাদুকরের কাহিনী আপনাকে মনে করে দিবে শুধু লোকদেখানো নয়, নিজের জীবনকে নিজের মত করেও গড়ে তুলা উচিৎ। স্বপ্ন শুধু স্বপ্নে থেকে যাবার জন্যেই নয়, সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারাটা জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দিক!
মনে গভীর ছাপ রেখে যাবার মত ঘটনাবহুল একেকটি অধ্যায়, সেই সাথে চোখজুড়ানো আর্ট এই মানহোয়াটিকে স্বাভাবিকভাবেই খুব জলদি আপনার মনোযোগ কেড়ে নিবে। গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, কাহিনী আগানোর সাথে সাথে চরিত্রগুলি অনেক সুন্দর ভাবে বিকশিত হয়। চরিত্রগুলিতে দেখার মতন পরিবর্তন আসে। জাদুর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা কাহিনীতে চরিত্রগুলিও জাদুময় কিছু মুহুর্ত উপহার দিতে পারবে।
প্রায় ৪০-৫০ পাতার একেকটি চ্যাপ্টার পড়তে খুব বেশি সময় নিবে না হয়তো। অতএব কমিক্স, মাঙ্গা, মানহুয়া ও মানহোয়া পাঠকেরা এই মানহোয়াটি না পড়ে থাকলে আর দেরী না করে এখনই পড়ে ফেলুন, আর উপভোগ করুন অসাধারণ সুন্দর একটি গল্প! জাদুময় কিছু মুহুর্তই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে
MyAnimeList Rating: ৮.৬৯/১০
আমার রেটিং: ১০/১০
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ
'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )
যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন
কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস
রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন