সুদীর্ঘ একচ্ছত্র আধিপত্যের পর মুখ ধুবড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের বামধারা। ২০১১ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জী; পদত্যাগ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অভিনন্দন মমতার প্রাপ্য।
সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লালঝাণ্ডাবাহী শক্তি সন্দেহাতীতভাবে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর চক্ষুশূল। অন্য যেসব দেশে বামধারা ক্ষমতাসীন, সেগুলোর অধিকাংশই একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তকমা-খচিত (অন্ততঃ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিচারে তো বটেই)। কিন্তু ভারত সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বামধারা শক্তিশালী হলেও সরাসরি এর বিরোধিতা করা আমেরিকান গণতন্ত্রের শালীনতার মধ্যে পড়ে না। তাই কষ্টকর হলেও এটিই গলাধঃকরণ করতে হয়েছে তাদেরকে।
আমি কিন্তু দাবি করছি না যে, বামধারার রাজনীতি পাপমুক্ত; এটাও দাবি করা হচ্ছে না যে, বামধারা চিরকাল অপরাজিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমি কেবল এটুকু মনে করিয়ে দিতে চাই যে, সম্প্রতি (২২ এপ্রিল ২০১১) উইকিলিকস-প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে “পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের তুলনায় মমতার নেতত্বাধীন জোট সরকার মাকির্নিদের অনেক ভালো বন্ধু হতে পারে।” শুধু এটুকুই নয়, মমতাকে ভাবী-মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। (দেখুন: )
অন্ততঃ প্রকাশিত ফলাফল আমেরিকার পরিকল্পনা-প্রত্যাশা মোতাবেক হয়েছে-- এটা বলাই বাহুল্য। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার যে-শুদ্ধিঅভিযান চলছে, পশ্চিমবঙ্গেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লক্ষ্য করা যায়, আরব-বিশ্বে তার শুদ্ধিঅভিযান (তথা আমেরিকা-বিরোধীদের হনন প্রক্রিয়া) অব্যাহত থাকলেও, সৌদি-আরবের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন মতামত নাই। কেননা, সৌদি আরব বরাবরই আমেরিকার তেল-ঘাটতি লাঘবে বদ্ধ-পরিকর। এখানে আরো একটি তথ্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না বোধ করি-- উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য বলছে, “তার দলের প্রকাশ্য ঘোষণার মধ্যে কোনো মার্কিন বিরোধীতা নেই। কনসুলেটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার দলের যোগাযোগ আছে।” এখানে ’মার্কিন-বিরোধিতা’ খুবই অর্থবহ। মার্কিন-বিরোধী কোনো শক্তিকে আমেরিকা কখনোই ছাড় দেবে না; তাদের প্রেসিডেন্ট ওবামা হোক আর যে-ই হোক। এই-বিষয়টা নিয়ে আমি আগেও লিখেছিলাম। ওবামার বিজয়ের পরপর আমেরিকা-প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই উদ্বেলিত হয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। মনে হচ্ছিলো, তাঁদের পরিবারের কোনো নিকটাত্মীয় বুঝি-বা জয়ী হয়েছেন। সেটা হয়তো ওবামার নামের সঙ্গে "হুসেইন” রয়েছে বলে। তখন আমি বলেছিলাম-- ওবামার বিজয়ে অতিরিক্ত আনন্দ্রাশ্রু ফেলার কিছু নাই, উনি শেষ পর্যন্ত আমেরিকান, গায়ের রংটা হয়তো কালো। একইরকম কথা ড. ইউনূসের বেলায়ও বলেছিলাম যথন উনার ক্ষুদ্র-ঋণ (বা অন্য যেকোনো) কার্যক্রম আমেরিকার হোয়াইট-হাউসে উত্থাপিত হয়েছিলো। সহজ প্রশ্ন-- আমেরিকার স্বার্থ-বিরোধী কোনো কার্যক্রম বা অভিসন্দর্ভ কি হোয়াইট হাউজে উত্থাপিত হতে পারে?
এগুলো হচ্ছে ঘরোয়া ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক রূপ। আমরা দেখেছি, ছোটবেলায় কোনো কারণে মা হয়তো ছোটভাইকে শাঁসিয়েছেন এই বলে যে, আজকে তোর খাওয়া বন্ধ। সঙ্গেসঙ্গেই তিনি আবার আমাদের কাউকে চোখ-ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, পাশের রুমে প্লেটে ভাত তোলা আছে; ছোটভাইকে যেন (মায়ের চোখের আপাত-অন্তরালে) খাইয়ে দেই। এখন, আমেরিকার কাজ হচ্ছে মার্কিন-বিরোধী শক্তিকে কোনো এক অজুহাতে গুঁড়িয়ে দেয়া, আর ড. ইউনূসদের কাজ হবে ওইসব দেশে গিয়ে পুনর্বাসনের কাজ করা। আবাসন ধ্বংস না হলে পুনঃ-আবাসন হবে কী করে! তাহলে ক্ষুদ্রঋণইবা নেবেন কারা! এভাবেই এই-চক্রের ঘুর্ণি জারি থাকে। আর এভাবেই, ”কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে পক্ষান্তরে ‘কিস্তিমাত’ হয়।”
মার্কিন-স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য তাই দেশীয় সোনার ছেলেদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে (নোবেল ইত্যাদিতে) জর্জরিত করা হয় যাতে আমাদের কাছে তাদের একটা পয়গম্বর-সুলভ গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হয়। এরপর, দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে আমেরিকার কথাই ঘোষিত হয়। সময় বলবে, মমতার জবানীতে আমেরিকার কোন কোন স্বার্ধ রক্ষিত হয়। আমাদেরকে হয়তো আরো একবার উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যের জন্যই অপেক্ষা করতে হবে।