প্রকৃতিক সম্পদের সুষম ব্যবহার :
কথাটির মর্মার্থ হলো ‘প্রকৃতির ধ্বংস’। যার প্রমান- বিশ্বব্যাপী বনজ সম্পদ হ্রাস, প্রজাতির বিলুপ্তায়ান, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ বাড়ার মত ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর মোট প্রাকৃতিক সম্পদের এক তৃতীয়াংশ আমরা ভোগ করেছি গত ত্রিশ বছরে। উপরন্তু যে হারে ভোগ বাড়ছে, সে হারে প্রকৃতিক সম্পদ তার নিজের নিয়মে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাই পৃথিবীর মোট বনভূমির ৮০ ভাগ আমরা ইতিমধ্যে উধাও করেছি। শুধু আমাজানেই মিনিট প্রতি কাটা পরছে ২ হাজার গাছ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পা পড়েনি বিশ্বে এমন বনভূমি রয়েছে মাত্র ৪ভাগ। একইসাথে বিশ্বজুড়ে সুপেয় পানির ৪০ শতাংশ এরই মধ্যে পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কাজেই ভোগ তারা যথেষ্ট করেছে। বরং বলা যায়, ভাগের অতিরিক্ত ভোগ করছে মার্কিনীরা। পরিসংখ্যান মতে,বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ৫ ভাগ বসবাস করে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু তারাই পৃথিবীর মোট সম্পদের ৩০ ভাগ ভোগ করছে। এই হারে যদি বিশ্বের প্রতিটি দেশ ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে ওঠে তাহলে আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীর মত ৫ টি পৃথিবী লাগবে বসবাস করতে। এ চিত্র পুরো উন্নত বিশ্বের।
আজ তাই যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত বিশ্ব নিজে মিতব্যায়ী না হয়ে হাত বাড়াচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দিকে। তার উপর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট মৎস্য চাহিদার ৭৫ ভাগ মেটাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। যে অঞ্চলের সম্পদ আহরণ শেষ হয়ে যাচ্ছে পরমূহুর্তে সে অঞ্চলের মানুষ বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে হয়ে পড়ছে মূল্যহীন।
পণ্য উৎপাদনের জন্য আহরিত প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে মেশানো হচ্ছে রাসায়নিক বিষ। ফলে ঝুঁকি বেড়েছে দ্বিগুন। বর্তমানে বিশ্বে এক লাখেরও অধিক কারখানায় রাসায়নিক বিষ বা সিনথেটিক টক্সিক ব্যবহার হচ্ছে। অথচ এ বিষ আমাদের শরীরে কী পরিমান ক্ষতি করছে তার বিবরণ নেই উন্নত বিশ্বের কাছে। তবে আমরা এটুকু বুঝি, রাসায়নিক বিষ মিশ্রিত হয়ে যা তৈরি হচ্ছে তা আরেক বিষ। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষের নাম “নিওরোটক্সিক”। যা প্রতিদিন ঢুকছে আমাদের শরীরে। মানবসৃষ্ট এ বিষ প্রভাব ফেলছে সরাসরি আমাদের মস্তিস্কে। মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক নিওরোটক্সিকের জন্ম আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য দাহ্যহীন বস্তু থেকে। ভেবে দেখুন
বিষ গ্রহণের এ যাত্রা শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। যে শিশুটি কেবলই পৃথিবীতে এলো, সেই নিস্পাপ প্রাণটি মায়ের বুকের দুধ থেকে পেল প্রথম নিওরোটক্সিকের স্বাদ। তাই আমাদের সমাজের সবচেয়ে ছোট সদস্যটির জীবন শুরু হয় তার মায়ের কাছ থেকে নেয়া বিষের মধ্য দিয়েই। তাই বলে কি মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। মোটেই না। এ অচলাবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে বহুজাতিক কোম্পানি এবং সরকার। বিষ দেয়ার এ প্রক্রিয়ায় মুনাফা ভোগ করে শুধুমাত্র মালিকশ্রেণী।
কেননা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এ বিষ টেনে নিচ্ছে কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকও। বিশাব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, মানব শরীরে অধিক বিষ প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম “রিসাইকেল সিস্টেম”। এ প্রক্রিয়ায় মানুষকে কাজ করতে হয় রিসাইকেল পণ্য এবং বিষের সাথে।
কিন্তু কেন কোম্পানীগুলো জেনেশুনে এ ধরনের বিষ উৎপাদন করে সবার ক্ষতি করছে ? উত্তরটা মূলত মুনাফা ও শ্রেণীশোষণের সাথে সম্পর্কিত।
ফিরে যেতে হয় লেখার শুরুতে।
এসব কারখানায় উৎপাদন কাজে নিয়োজিত হয় সেসব দেশের মানুষ যাদের বনভূমি উজার ও তাদের শোষণ করে উন্নত দেশে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। নিঃস্ব দেশের গরীব মানুষ অভিবাসী হয়ে আসে উন্নত বিশ্বে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইএমও এর মতে, বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে অভিবাসী হচ্ছে।
আগেই বলেছি, বিষ দিয়ে বিষ উৎপাদন হচ্ছে কারখানাগুলোতে। প্রোডাক্টের সাথে বাই প্রোডাক্টের ফলে দূষিত হচ্ছে বায়ু ও পানি (যেমন: ঢাকা ও আশপাশের নদীগুলো)। যুক্তরাষ্ট্র সরকার হিসাব করে দেখলো, ফিবছর তারা ৪০০ কোটি পাউন্ড বিষ উদগীরণ করছে। এ হারে চলতে থাকলে একসময় সে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই তারা কল-কারখানাগুলো ছড়িয়ে দিল বিশ্বের অন্যান্য স্থানে। এর ফলে দুটি লাভ হলো। প্রথমটি, বিশ্বায়নের ফলে সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করা যাচ্ছে। আর ডলারের হিসাবে কম বেতনে শ্রমিক পাওয়াটা দ্বিতীয় কারন। প্রয়োজনে আমার উৎপাদিত পণ্য পরে উন্নত বিশ্বের ট্যাগ লেগে বেশি দামে আমাকেই কিনতে হবে। অবশ্য সরল এই কেনা বেচার পেছনে রয়েছে বায়ু ও পানিতে বিষ ছড়িয়ে পরার মত মারাত্মক সমিকরন। অবশ্য পরিবেশবাদিদের তকমা নিয়ে উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ উপরিতল (সারফেস) রক্ষাকবচ তৈরির প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গভীরভাবে এর প্রভাব ও দায় তারা জানাতে বা নিতে নারাজ।
পরিবেশন:
এ ধাপের লক্ষ্য বিষপণ্যগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিক্রি করা। এজন্য দেয়া হয় ছাড়,উপহার ক্ষেত্র বিশেষে বিনামূল্যে। একটা কথা বেশ চালু আছে চারিদিকে : প্রচারেই প্রসার। অন্যদিকে বাজারজাতকারকদের দ্রুত পণ্য বিক্রি করতে দেয়া হচ্ছে টার্গেট ও তাড়া। ডিস্ট্রিবিউটররা তা আমাদের গছিয়ে দিতে প্রদর্শণ করে বিভিন্ন “মূলা”র । মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভোগে উদ্বুদ্ধ করতে পণ্য উৎপাদনের সাথে যোগ হচ্ছে বিভিন্ন বিশেষন এবং সর্বনাম। যেমন : গ্রীণ প্রোডাক্ট।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-সুপারশপে একটি রেডিও কিনতে গিয়ে মার্কিন গবেষক এ্যানি লিওনার্ড দেখলেন ছোট্ট গ্রীণ রেডিওটির গায়ে লেখা ৪ ডলার ৯৯ সেন্টের প্রাইস ট্যাগ। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কিভাবে এত কম দামে পণ্য বিক্রি করা যায়? উত্তরটা এখন আমি জানি। রিডিওটার মেটাল সংগ্রহ করা হয়েছে সাউথ আফ্রিকা থেকে,উৎপাদন তেল সংগ্রহ করা হয়েছে ইরাক থেকে,চীন থেকে নেয়া করা হয়েছে প্লাস্টিক বা দানা এবং পুরো পণ্যটি এ্যাসেম্বলিং করা হয়েছে মেক্সিকোতে। পরিবেশনের আগে উৎপাদনের এই ধারায় ৪ ডলার ৯৯ সেন্টের মধ্যে আছে কর্মচারীর বেতন,পরিবহন ব্যায়সহ আনুসঙ্গিক খরচ। সে হিসেবে পণ্য বিক্রি করে লাভ বলে কিছু নেই। বরং কিছু কোম্পানি ভর্তূকি দিয়ে পণ্য বা সেবা বিক্রি করছে। তাই এ্যানি উপলব্ধি করলেন, পণ্যটার জন্য তিনি অর্থ পরিশোধ করছেন না। তাহলে অর্থটা পরিশোধ করছে কে? এর উত্তর খুঁজে মার্কিন গবেষক এ্যানিকে পেরোতে হয়েছে অনেকটা সময়। অবশেষে মার্কিনী হওয়ার সুবাদে সে যা জানতে পারলো তা বাইরের কারো পক্ষে জানা অসম্ভব ছিলো। কেনান তার কেনা রেডিওটির জন্য আক্ষরিক অর্থে এ্যানি মূল্য পরিশোধ করলেও আসল সাফারার তারা, যারা তাদের বনভূমি ও বাসভূমি হারিয়েছে। যেমন : আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে ৩০ শতাংশ শিশু আজ স্কুলের বদলে লাভজনক এ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। এ্যানি শুধু অর্থ দিয়েছে আর তৃতীয় বিশ্বের অবুঝ দেশগুলো দিচ্ছে মূল্য। এ মূল্যা তারা পরিশোধ করছে, যারা পণ্যের উৎপাদনে শরীরে বিষ টেনে নিচ্ছে। এর বিনিময়ে তারা পাচ্ছে এ্যাজমা, ক্যান্সারসহ নানা দূরারোগ্য ব্যাধি। এতগুলো মানুষের ত্যাগে সুশীল দেশগুলোতে এ্যানির মতো লক্ষ মানুষ ভোগ করছে উন্নত জীবন। তবে শেষ পর্যন্ত গরীব মানুষের এ ত্যাগ ও শ্রম কোন কোম্পানীই তার হিসাবের খাতায় যোগ করে না। তাই একবিংশ শতাব্দিতে পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ভোগের অন্যতম একটি সূত্র হচ্ছে: “সত্যিকারের উৎপাদন ব্যায় ভিন্ন কিছু” যা সাদা চোখে দেখলে আর চলছে না।
কিস্তি ১:
:: আপনাদের আগ্রহ থাকলে (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১১ দুপুর ১২:৫৭