somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুতুব উদ্দিনের সংসারজীবন

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
বাসা থেকে আমার অফিসের দূরত্ব প্রায় পনেরো কিলোমিটার। যেহতু নিজের মোটর সাইকেল নেই, যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সিএনজি চালিত অটোরিক্সা। ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সাও চলে। কিন্তু সময় কম লাগে বলে, আমি বেশিরভাগ সময়ই সিএনজি চালিত গাড়িতেই আসা যাওয়া করি। যাবার পথে প্রায়ই একজনের সাথে দেখা হয়। ঠিক দেখা হয় বললে ভুল বলা হবে, বরং একই গাড়িতে যাওয়া আসা করি। সে অর্থে তিনি আমার সহযাত্রী। যদিও দেখা হয় প্রায় প্রতিদিনই, সেদিনের আগে, কথা হয়নি একদিনও। এমনকি নামটাও জানা হয়নি ভদ্রলোকের। যারা শিক্ষিত ও সচেতন, সবাই একটা কথা ভালোভাবে জানেন–– চলতি পথে অপরিচিতজনের সাথে অযাচিত হয়ে গল্প জমানো বা খেজুরে আলাপ জুড়ে দেওয়া কতোটা বিরক্তিকর। এতে করে অন্য যাত্রীদের যেমন বিরক্তির উদ্রেক হয়, তেমনি নিজের বাচালতা বা চটুলতাও প্রকাশ পায়। গ্রামের সহজ ভাষায় লোকে বলে ‘পাতলামি’। তবে হ্যাঁ, এর বিপরীত চরিত্রের মানুষও কম নেই।
যে-ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম, তিনি দেখতে আমার মতোই ছোটোখাটো গড়নের। মার্জিত চাওনি। পোষাক-পরিচ্ছদেও নেই জাঁকালো ভাব। সব মিলিয়ে এক নজরেই বোঝা যায় সাধারণ ঘরের, সাধারণ পরিবারের মানুষ তিনি।
এই সেদিন–– আটাশ নভেম্বর––পরিবহণ শ্রমিক ধর্মঘট চলার দিন, কোনো সিএনজি অটোরিক্সা চলেনা। মাঝে মাঝে দু-একটা ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা চলে। কিন্তু ভাড়া সামান্য বেশি। অন্যান্য দিন যেখানে পঁচিশ টাকা ভাড়ায় যাত্রী আনে নেয়, সেখানে তারা জনপ্রতি পাঁচটাকা বেশি নিচ্ছে।
অন্যান্য দিন সিএনজি গাড়ির ভাড়াই ত্রিশ টাকা। কিন্তু আমার মতোই, অন্য যাত্রীদের সিএনজি গাড়ির প্রতি বেশি আগ্রহের কারণ- এতে সময় কম লাগে। এ দিন অনন্যোপায় হয়ে সব যাত্রীকে ব্যাটারি চালিত গাড়িতেই চেপে বসতে হলো। অটোরিক্সা চালকেদের আরেক বদঅভ্যাস। দুজনের সিটে তারা উঠাবে তিনজন। পারেতো, তারা গাড়ির পেছনে বাঁশ লাগিয়েও যাত্রী নিতে চেষ্টা করে। আমাদেরও তাই করলো। তিনজনের একজন আমি। বসতে হলো মাঝখানে। আমার ডানে, আমারই কাছাকাছি বয়সের, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। বামে বসেছেন আলোচ্য ভদ্রলোক।
এই পাঁচটাকা বাড়তি ভাড়ায় দু-একজন আপত্তি তুলেছেন, দু-একটি বাড়িত কথাও বলেছেন। তবে সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়েনা। কিন্তু যে ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম তিনি অনেকটা রেগে আছেন, কথাতেই বোঝা যাচ্ছিলো। তাদের সম্বোধন প্রথম পর্যায়ে ‘আপনি’তেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তর্কের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে, সম্বোধেন ‘তুমি’তে নেমে এলো।
আমরো যে-গাড়িতে চড়েছিলাম, তার চালক একদম অল্প বয়েসী। বয়স খুব বেশি হলে হয়তো ঊনিশ বা বিশ হবে। অটোরিক্সা চালকের সাথে ভদ্রলোকের যেসব কথা হলো, সেসব আমার লেখাতে স্থান দিলে, আমারও বোধ হয় সীমা লঙ্ঘন করা হয়ে যাবে। যেটুকু স্থান দেয়া যায়, সেটুকু ছিলো প্রায় নিম্নরূপ-
-মিয়া, দেইখ্যা ত মনে অয় বিয়া শাদী কিছুই কর নাই। বিয়া কইরা লও! পরে বুজবা, পাসট্যাহার কত জ্বালা!
চালক ছেলেও এতক্ষণ, ভদ্রলোকের কথায় চটাং চটাং উত্তর দিচ্ছিলো। এ কথা শুনার পর, মনে হয়, তার মধ্যে একটু হাস্যরসের ভাব এলো। সে বললো, ‘ক্যাল্লাইগ্যা! বিয়া কল্লে কি ট্যাহার দাম বাইরা যাইবো নাহি?’
-কইলাম ত বিয়া কইরা লও... পরে বুজবা–– ট্যাহার দাম বারে, না কমে, না কী অয়!
তার পর আরো কিছুক্ষণ উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি। একসময় বজ্রপাতের পর যেমন আকস্মিক নীরবতা নেমে আসে, সেরকম নীরবতা। সেদিনের আগে ভদ্রলোককে কোনোদনি চলার পথে কারো সাথে যেচে কথাই বলতে শুনিনি, কারো সাথে ঝগড়া করা তো অনেক পরের কথা। আমার ডানের যাত্রী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিসে আছেন, ভাই? মানে... কিসে চাকরি করছেন?
-কল্যাণীতে।
ভদ্রলোকের অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর। ভদ্রলোক উত্তরটা এমনভাবে দিলেন, শুনে বোঝার উপায় নেই আসলে কল্যাণী কী। এটা কি কঠিন, তরল বা বায়বীয় পদার্থ; নাকি এটা কোনো সংস্থা, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান অথবা আসলে এর অস্তিত্ব আছে নাকি নই অথবা এটা কি স্বর্গের জিনিস, না মর্তের। ‘আচ্ছা, আপনাদের শাখাটা কি ঝগড়ার চরেই...?’ ভদ্রমহিলা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। তার কথা শেষ না হতেই ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘ঝগড়ার চরেই, তবে বাজারের বাইরে’।
তাদের মধ্যে কথোপোকথন চলছিলো। তবে আমার সেসবে তেমন একটা আগ্রহ ছিলোনা। ফলে তাদের মধ্যে কী কথা হচ্ছিলো, আমার জ্ঞানচক্ষুর অগোচর।

দুই
আমার মাথায় কী যেনো একটা ভাবনা আসায়, সে বিষয়ে দু-এক লাইন লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। মোবাইল ফোনে। এ কথা জেনে আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন, আমি মোবাইলের পোকা। বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়। মোবাইল জিনিসটা আমার কাছে নিতান্তই প্রয়োজনীয় বিষয়। যে-কাজটা মোবাইলে না করলেই নয়, সেটাই আমি মোবাইলে করে থাকি। অনেকে হয়তো আমার এ কথায় হেসে উঠবেন। দুএক লাইন লেখার জন্য মোবাইল কি আবার একটা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় নাকি, যে অন্যের কথায় মনোযোগ দয়ো যাবেনা! হতে পারে, একেক জনের ভাবনা একেক রকম। আমারও একসময় এই অভ্যাসটা ছিলোনা। ছোটোবেলা থেকেই আমার হাবিজাবি সব লেখতে ইচ্ছে করে। ভালো মন্দ যা-ই হোক। লিখিও। কোথাও প্রকাশ পায়নি। মাঝে মাঝে ফেসবুকে লিখি। ফেসবুক তো নিজেকে প্রকাশ করার, প্রচার করা উন্মুক্ত মাধ্যম। কিছু কিছু আবার ব্লগেও দিই। একদিন আমাদের শেরপুর কর্পোরেট শাখায় কোনো এক কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখা পেয়ে গেলাম আমাদের ঝিনাইগাতি শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ শাহীন পারভেজ স্যারের। শেরপুর কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ রফিকুল ইসলাম স্যার ও শাহীন পারভেজ স্যার দুজনেই আমার সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন। উনাদের সাথে, প্রায় এক বছর আমার ঝিনাইগাতি শাখায় কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। কথায় কথায় শাহীন স্যার আমার লেখালেখির কী অবস্থা জানতে চাইলেন। আমি জানালাম যে, সময়ের অভাবে ভালোভাবে কিছু করতে পাচ্ছিনা। অনেক কথার মাঝেই, তাঁর একটা কথা আমার খুব মনে ধরেছিলো। তিনি বললেন, জীবনে বড় হতে হলে, ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও সময় বের করে নিতে হবে। অনেকের কাছেই কথাটা শুনে থাকি। কিন্তু কোনোদিন এতোটা গুরুত্ব অনুভব করিনা কথাটার। সেদিন কেনো যেনো একটু ভিন্ন রকম ব্যঞ্জনা পেলাম। এর পর থেকে, যে সময়টুকু গাড়িতে চড়ে অফিসে যাওয়া-আসা করি, সেটুকু কাজে লাগাতে চেষ্টা করি–– এটা সেটা মনে যা আসে, লিখে। সহকর্মীদের কেউ কেউ আবার বন্ধুদের মধ্য থেকেও দু-একজন প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমরা ব্যাংকে চাকরি করে দম ফেলার সময় পাইনা, তুই লেখালেখির সময় কই পাস? আমি মজা করে উত্তর দিই, ‘কাজে ফাঁকি মারি’।

তিন
‘আচ্ছা ভাই, আপনাকে অনেকটা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি বলুন তো!’ আমি ততক্ষণ মোবাইলে টুকিটাকি লিখেই যাচ্ছিলাম। চেতনা ফিরে পেলাম ভদ্রলোকের কথায়। কী জিজ্ঞেস করেছিলেন, শতভাগ ঠিকভোবে বুঝেও উঠতে পারিনি। আৎকে উঠে বললাম, ‘জ্বি! আমাকে বলছেন?’
-জ্বি, বলছিলাম–– এর আগে আপনার সাথে কোথায় দেখা হয়েছে, মনে করতে পাচ্ছিনা।
-কেনো! সিএনজি-স্টেশানে তো প্রায়ই আপনার সাথে আমার দেখা হয়।
-আরে নাহ! সেটা না। আমার মনে হয় আপনাকে আরো কোথাও যেনো আগে দেখেছি। আচ্ছা, আপনার পড়াশুনা কোথায়?
পরে জানতে পারলাম তিনিও আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। ছিলেন মাস্টারদা’ সূর্যসেন হলেরই ছাত্র। শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের ২০০৪-০৫ এমএ সেশানের ছাত্র ছিলেন তিনি। আমরা যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, তার কিছুদিন পরই তিনি হল ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন। সে জন্যই তার সাথে আমার জানাশোনাটা এতো নিবিড় নয়। কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় অর্ধেক পথ চলে এসেছিলাম। সিএনজি গাড়িতে হলে, এতক্ষণ ঝগড়ার চরের কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। কিন্তু এ গাড়িগুলো দ্বিগুণ সময় নেবে।
স্বাভাবিকভাবেই একই গুরুসদনের কাউকে পেলে, প্রাণ খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে সবারই। তিনিও এটা সেটা জিজ্ঞেস করছিলেন, আমিও দু-এক কথা জানতে চেষ্টা করছিলাম। আমাদের নাম-পরিচয়, কর্মস্থল সম্বন্ধে কথা কথায় দুজনেই জেনে নিলাম। আমি লক্ষ করলাম, আমার সাথে কথা বলতে যেয়ে, কেনো যেনো তিনি বারবার একটু লজ্জাবোধ করছিলেন। কিছুক্ষণ গল্পের পর, আমিও উনাকে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ ডাকার অনুমতি দিয়ে দিলাম। একটু চুপ করে থেকে, নারীদের মতো ইতস্তত করে তিনি বললেন, ‘দেখ, তুমি আমার হলের ছোটোভাই, তোমার সামনে এরকম একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে আমি ভাবি নাই’।
-কেনো, ভাই! কী হলো আবার?
-এই যে দেখনা... এরপর সুনসান নীরবতা। শুধু অটোরিক্সার চাকার অশান্ত ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
-কী, ভাইয়া? কোনো সমস্যা? সমস্যা থাকলে বলতে পারেন যদি নিতান্ত ব্যক্তিগত না হয়। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম।
-ব্যক্তিগত না, আবার ব্যক্তিগতও। এই দেখনা রাস্তার মধ্যে দু-চারটা টাকার জন্য মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করা। এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে।
-ও, আচ্ছা। এই কথা! সমস্যা নেই, ভাইয়া। এরকম মাঝে মধ্যে সবারই হতে পারে।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই, আমার কানের একদম কাছে মুখ নিয়ে উনি বললেন, ‘টুটুল, তোমার কাছে কি বাড়তি পাঁচটা টাকা হবে? আমি বাড়ি থেকে হিসেব করা পঁচিশটা টাকা নিয়ে বের হয়েছিলাম। এখনতো পাঁচটাকা বেশি লেগে যাবে’।
-কোনো সমস্যা নেই, ভাই––––
উনি আমার কথা শেষ করতে দিলেন না। ‘তুমি টেনশান করোনা। আমি অফিসে গেলেই টাকা পেয়ে যাবো। আামার আবার একটা ছোটো টিএ বিল পাস হবে আজ’ একইভাবে ফিসফিস করে কথাগুলো বললেন আমাকে। তারপর অনেকটা স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘তুমিতো তাহলে... ও হ্যাঁ! জনতা ব্যাংকে আছ? তাইত বলছিলা, তাইনা? আচ্ছা, আমি আজ ফেরার সময় তোমাকে ওটা ফেরত দেবো’। কথাগুলো একটানা বলে গেলেন তিনি। আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিলেন না।
‘আরে ভাই, কী যে বলছেন আপিন!’ আমি বললাম।
-আচ্ছা, তুমি কয়টার দিকে বের হও, জেনরাল্লি?
-নিয়মিত ছ’টার দিকে বের হই। মাঝে মাঝে একটু এদিক সেদিক হয় আরকি।
-আচ্ছা, আমিত তাহলে একটু আগেই বের হব। ঠিক আছে, আমি তোমার অফিস হয়েই ফিরবো। একসাথে আজ শেরপুরে যাবো দুজনে।
-আপনি আমার অফিসে আসবেন, একসাথে ফিরবেন, ভালো কথা। কিন্তু ভাইয়া, যে জন্য অফিসে আসতে চাচ্ছেন, সে কথা যদি দ্বিতীয়বার বলেন, তাহলে খুব কষ্ট পাবো।
-সেটা পরে দেখা যাবে।
আমরা ঝগড়ার চর পৌঁছার পর, কেউ যেনো কিছু বুঝতে না পারে, সেজন্য উনাকে পকেট থেকে টাকা বের করতেই দিলামনা। ভাবখানা এই- যেনো আমি জোর করেই উনার ভাড়াটা পরিশোধ করলাম।
স্টেশান থেকে আমার অফিসে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে আমার কেবলই মনে হলো- জীবন নাটকের মঞ্চে আমরা, প্রত্যেই কতো বড় মাপের এবং নিখুঁত অভিনেতা! জীবন চালাতে প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের কোনো না কোনো অভিনয় করতেই হয়! ইচ্ছে বা অনিচ্ছে, যে কারণেই হোক।

চার
ফেরার পথে কুতুব উদ্দিন ভাইয়ের সাথে বিস্তর গল্প হলো। উনার সম্মান রক্ষার্থে এবং আসল পরিচয় গোপন করার স্বার্থে, আসল নামটা পাল্টে দিলাম। আশা করি, এটুকু বিকৃতির জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা পাবো। সে গল্প আর কিছুই নয়, তাঁর জীবনের গল্প। বাবা-মা, অভিভাবক সবার কথা অগ্রাহ্য করে, বিয়ে করেছিলেন নিজের পছন্দ মতো। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি প্রেম করে বিয়ে করা। মেয়ে দেখতে শুনতে, পরিবার পরিজন, টাকা পয়সা সবদিক থেকে সবই ঠিকঠাক আছে। কিন্তু, কুতুব উদ্দিন ভাইয়ের সাথে তার বিদ্যার পার্থক্য অনেক। সবে, এসএসসি পাশ করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হবে। এজন্যই অভিভাবকদের এতো অমত। কিন্তু কুতুব সাহেব, কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আসলে বিয়ে বিষয়টা এমন, যেখানে সমস্ত পৃথিবী বিপরীতে থাকলেও, পাত্র-পাত্রীর সম্মতি থাকলে, সব প্রতিকূলতা ও বৈপরিত্য অনুকূলে আসতে বাধ্য। অভিভাবকরা রাগে ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘দেহিস কুতুব! আংগর কতা তর অহন বালা লাগলো না। পরে কফাল থাফরাইবি ঠিকই’।
না, অভিভাবকদের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেনি। কুতুব উদ্দিনের কিশোরী-বয়স্কা স্ত্রীর ব্যবহারে ছোটো বড় সবাই মুগ্ধ। কুতুব নিজেও মাঝে মাঝে ভাবে- এতো ছোটো একটা মেয়ে কী করে এতোসব সামলে নিতে পারে! যতই ভাবে, স্ত্রীর প্রতি তার ভালোলাগা ততোই বাড়তে থাকে। আপন মনেই তার মধ্যে একটা ভাবনার সৃষ্টি হয় যে, মেয়েদের মধ্যে হয় জন্মগত কিংবা স্বভাবজাত এমন কিছু গুণ থাকে, যা দিয়ে সে সমস্ত পৃথিবী জয় করার যোগ্যতা রাখে।
বিয়ের পর, অন্য আট দশটা দম্পতির মতো, কুতুবেরও ভালোই কাটলো কিছুদিন। এখনো ভালো কাটে। অকারণ বাড়তি কোনো দাবি দাওয়া নেই। পড়শির সাধ-আহ্লাদ দেখে মিলির মধ্যে অনুকরণজনিত অভাবের তাড়না নেই। যেটুকু টানাপোড়েন আছে, সেটুকু কুতুব উদ্দিনের নিজেরই। আর্থিক টানাপোড়েন।
বিসিএস পরীক্ষায় দু’বার ভাইবা দেয়ার পরও কোনো ক্যাডার আসেনি। চাকরি বয়স প্রায় শেষ হয়ে আসায়, উপায়ান্তর না দেখে, অবশেষে চাকরি নিয়েছে অখ্যাত একটা এনজিওতে। এখানেও তাকে ঢুকতে হয়েছে এলাকার এক পরিচিত বড় ভাইকে বখশিশ হিসেবে দশ হাজার টাকা দিয়ে। এ নিয়ে তার নিজের মধ্যে হীনমন্যতার সীমা নেই। তাঁর ব্যাচের আর আট দশটা বন্ধুর সাথে যোগাযোগ নেই। ইচ্ছে করেই সে এটা করে না।
সব মিলিয়ে তার সংসারজীবন ভালো। কিন্তু অবিমিশ্র ভালো বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। কুতুবের সংসার জীবনেও সেরকমই কিছু অপ্রাপ্তিবোধ আছে। তার চিন্ত-চেতনা, ভালোলাগা-মন্দলাগা, কোনো কিছুই শেয়ার করার লোক নেই। সে যতোটা গভীরভাবে একটা বিষয়কে ভাবে, তার স্ত্রীর বুদ্ধি-জ্ঞানের পরিসীমা ততোটুকু ধারণ করতে পারেনা। প্রথম প্রথম সে মিলির সাথে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার চেষ্টা করতো। কিন্তু দেখা যেতো, কাঙ্ক্ষিত প্রত্যুত্তর বা প্রতিক্রিয়া কোনোটারই প্রতিফলন ঘটতোনা। হয়তো হালকা বিষয়কে খুব বেশি ভারি মনে করে, মিলি দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়তো অন্যথায় খুব সিরিয়াস বিষয়কেও এমনভাবে গ্রহণ করতো, যা হাস্যরসের পর্যায়ে পড়ে। কিছুদিন দেখার পর সে আর এসব তার স্ত্রীর সাথে আলোচনাই করেনা। যদি সময় সুযোগ হয়, সমমনা বন্ধুদের সাথে কিছু বলে নিজেকে হালকা করা চেষ্টা করে। আর মনে মনে ভাবে, একাকীত্ব কষ্টের কিন্তু মানসিক একাকীত্ব ভয়ঙ্কর রকম কষ্টের। এর চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর কী হতে পারে, সে বুঝতে পারেনা।
মিলির কথায় কুতুব প্রথম কষ্ট পেয়েছিলো, তাদের বিয়ের দুই বা তিন মাসের মাথায়। ভার্সিটির কয়েকজন বন্ধু বেড়াতে এসেছিলো বাড়িতে। কী যেনো একটা বিষয় নিয়ে দুজনের মঝে খুনসুটি হচ্ছিলো। আর অন্যরা তাদের দুজনকে নিয়ে মজা করছিলো- জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গে বরুদযোগে জ্বালয়ে দেবার মতো। হাসি তামাশা করতে করতেই স্ত্রীর ভরণপোষণ নিয়ে বন্ধুদের মধ্য থেকে কে যেনো কী একটা বললো। মিলি কোনোকিছু না ভেবে-চিন্তেই, চট করে বলে ফেললো, ‘আমার হাজবেন্ড আমার ভরণপোষণ কিভাবে করবে, সেটা তো আমার চিন্তা করার বিষয় না। সে চুরি করবে, না ডাকাতি করবে, সেটা তার বিষয়’।
কথাটা কুতুবের মনের মধ্যে বিষের তীরের মতোই বিঁধলো। মিলির কথা শুনে, কুতুবের বন্ধুরা একে অপের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। বিষয়টা হালকা করা জন্য কুতুব বললো, ‘একদম ঠিক কথা! স্ত্রীর দায়ভার যখন কেউ গ্রহণ করবে, সে ভার কিভাবে বহন করবে সেটা তো তারই ভাবতে হবে- তোরা কি বলিস!’

বিয়ের পর প্রায় তিন বছর পার হতে চলেছে। মিলি আর কুতুবের ঘর আলোকিত করে এক কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে। কুতুব সাধ্যমত চেষ্টা করে স্ত্রী-কন্যার চাহিদা পূরণ করতে। কিন্তু মাঝে মাঝে, জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×