প্রিয় হুমায়ূন
আশা করি ভালো আছো।এই কয়টা দিন তোমার খোজ নিতে পারি নি,নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। পরীক্ষার ব্যাস্ততা আমার মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। তবু একটু আগে যখন শুনলাম তুমি রাগ করে চলে গেছ তখনি বুঝতে পারলাম এই যাহ,দেরি হয়ে গেছে।হুমায়ূন,এখন গেলে কি ধরতে পারবো তোমাকে মাঝপথে,নাকি অনেক দূর চলে গেছ?মনে হয় না পাব।তাই এই ছোট চিঠীটা লেখাই সম্বল মনে করলাম।
হুমায়ূন,তোমার সাথে আমার প্রথম পরিচয় তোমাকে দিয়ে।সেই ক্লাস সিক্স হবে।এরপর তো হরহামেশাই তোমার সাক্ষাত পেয়েছি।আমার পুরো বুকশেলফ জুড়ে তোমাকে বন্দী করে রেখেছি।আজ আমি কোথাও যাবো না,আমার চোখে সেই প্রথম পানি এনেছিলে।আমার সব মনে আছে বুঝলে।
তোমার জন্য অনেক বকা খেয়েছি,বাবা মা,টিচার,পরীক্ষায় ফেল করেছি,আবার পাশ করে তোমাকে উপহার পেয়েছি,পেয়েছি জন্মদিনে।একটা বারের জন্য তোমাকে ছাড়ি নি।আর আজ তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে?
সবাই তোমাকে কষ্ট দিবে, তোমাকে শুধু এমন একজনকে খুঁজে নিতে হবে, যার দেয়া কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে।অনেক কষ্ট সহ্য করেছ তুমি হুমায়ুন।তার ফলও পেয়েছ।তবু বলি তোমার ছুটি হয় নি।বোকা হুমায়ুন মানুষকে শুধু দিয়েই গেলে।তোমাকে তো আমি জানি।তোমার বাসা খুজতে খুজতে আমি পেরেশান।দারোয়ান ঢুকতে দিবে না।আমিও তো বন্ধুকে না দেখে যাবো না।শেষে এলে।লুংগি দেখে আমার হাসিই পেয়েছিল।তুমিও হাসলে।বলেছিলে এমন অনেক পাগলই নাকি হরহামেশা তোমার কাছে আসে,আমি বুঝি না আমার মত এত এত পাগলকে কিভাবো তোমার ছোট্ট বুকটাতে ঠাই দিয়েছিলে?
তোমার উপর যে আমি একটু বেজার ছিলাম না তা না।ওটা আমি বলব না।আমি শুধু আজকের চলে যাওয়া নিয়ে বলব।হুমায়ূন তুমি হয়ত কিছু অন্যায় করেছ,কিন্তু আজ চলে গিয়ে তুমি যে অন্যায় করলে আমি তোমাকে ক্ষমা করব না।
হুমায়ূন তুমি জানবেও না,এই ঢাকা শহরের কোন একটা বারান্দায় রাতের কালো আকাশের দিকে চেয়ে একটা ছেলে আপন মনে কাদবে।সারা রাত কাদবে।তোমার বিভিন্ন দিবসের মত এই ছেলেটাও ১৯ জুলাইকে কান্না দিবস হিসেবে ঘোষনা করল।
হুমায়ূন তুমি কি জানবে তোমার ঐ উড়লচণ্ডী হিমু হতে গিয়ে,রাস্তায় খালি পায়ে হাটতে গিয়ে আমাকে কত জনের হাসির পাত্র হতে হয়েছে।তাতে আমার বয়েই গেল।শুধু পারতাম না ভবিষত বলতে।তোমার বৃষ্টিবিলাস আমাকে ভালোই পেয়েছে।বৃষ্টি হলে আমি কেমন আনমনা হয়ে যাই।হয়ত তোমার মত শিং মাছের ঝোল খুজে বেড়াই পাতে।বা একটু খানি ঘি।আহ অমৃত।
হুমায়ূন কোন জায়গায় স্বার্থপর হতে দেখিনি তোমায়,তবু কেন আজ এতটা স্বার্থপর হলে?আমি কিচুতেই মেনে নিতে পারছি না।জানি না কতদিন তোমার চলে যাওয়া আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।জেনো তুমি,এই আমি তোমাকে কখনই ভুলবো ন।কখনো ঝুম বৃষ্টিতে,কখনো জোসনার প্লাবনে আমি ঠিকই তোমাকে খুজে নেব।
আর লিখতে পারছি না।চোখের পানি অনেকক্ষন আটকে রেখেছি।ল্যাপটপের স্ক্রীন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।হুমায়ূন তোমার বই গুলো আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল।যতদিন থাকব তোমার এই স্মৃতিগুলো নিয়েই থাকব। হয়ত আর বইমেলায় যাওয়া হবে না। নতুন কোন বাংলা বই হাতে নেওয়া হবে না।বাসার সবাই একসাথে বসে দেখা হবে না তোমার কোন নাটক কিংবা সিনেমা।হবে না গুনগুনিয়ে গাওয়া ও কারিগর দয়ার সাগর,ওগো দয়াময়,চান্নিপশর রাইতে যেন আমার মরন হয়।
হুমায়ূন যেখানে গেছ ভালো থেক।তোমার এই অন্ধ ভক্তের দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।তোমাকে কখনও ভুলবো না।কখনও না।আমি খুজবো তোমাকে।ভালো থেকো।
প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার
আকাশের দিকে তাকাই।
গৃহত্যাগী হবার মত জোছনা কি উঠেছে?
বালিকা ভুলানো জোছনা নয়,
যে জোছনায় বালিকারা ছাদের
রেলিং ধরে ছুটোছুটি করতে করতে বলবে,
ও মাগো! কি সুন্দর চাঁদ!
নব দম্পতির জোছনাও নয়,
যে জোছনা দেখে স্বামী গাড়
স্বরে স্ত্রীকে বলবে;
দেখো দেখো,
চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর।
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাঁতে
জোছনা নয়,
যে জোছনা বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয়
আকাশে।
কবির জোছনা নয়,
যে জোছনা দেখে কবি বলবেন,
কি আশ্চর্য রুপোর থালার মত চাঁদ।
আমি সিদ্ধার্থের মত
গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি।
যে জোছনা দেখা মাত্র গৃহের সমস্ত
দরজা খুলে যাবে।
ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব, আর হাঁটব।
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে,
চারিদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ
ডাকবে ..... আয়, আয়, আয় ।
- হুমায়ূন আহমেদ
ডায়েরীর পাতা থেকে (১৯ জুলাই ২০১২)