somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈদূল আযহায় আমাদের করণীয়

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পৃথিবীর সকল জাতিই তাদের আনন্দ-উৎসব প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট দিবসকে পালন করে থাকে। এ সকল দিবস স্ব স্ব ধর্মের কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা অথবা কারো জন্ম বা মৃত্যু দিন অথবা কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত করা হয়েছে। এ দিবসসমূহে প্রত্যেক জাতি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়।

বিভিন্ন জাতির উৎসব ও উৎসব দিবস

সারা বিশ্বের প্রায় দুই কোটি খৃস্টান যীশুখৃস্টের জন্মদিন উপলক্ষে ২৫ ডিসেম্বরকে তাদের উৎসবের দিন ‘বড়দিন' (ঢসধং ফধু) হিসেবে পালন করে। প্রায় সত্তর পঁচাত্তর লাখ বৌদ্ধ গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন উপলক্ষে ২২ মে কে তাদের উৎসবের দিন ‘শুভবুদ্ধ পূর্ণিমা' হিসেবে পালন করে থাকে। সারা বিশ্বের প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমান মাহে রমযান শেষে সাওয়ালের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর (রোযা ভঙের ঈদ) এবং আরবী জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখকে ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ হিসেবে পালন করে থাকে। মুসলমানদের উৎসবের রয়েছে একটি ঐতিহ্য ও সুদীর্ঘ ইতিহাস। সবচেয়ে বেশি উৎসবের দিন হলো হিন্দু জাতির। তারা ১২ মাসে ১৩টি উৎসব দিবস পালন করে থাকে। তবে এর মধ্যে লক্ষ্মীপূজা ও দুর্গাপূজা (বিজয়া দশমী) অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালন করে থাকে।

মুসলমানদের ঈদ উৎসব

মুসলমানদের ঈদ উৎসব দু'টি। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহা। এক মাস রোযাব্রত পালন শেষে শাওয়াল মাসের ১ম দিন ঈদুল ফিতর উৎযাপন করা হয়। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর কুরবানীর ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ্বকে ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ উৎযাপন করা হয়। একই সময়ে হজ্ব পালন করা হয়।

ঈদুল আযহা

আজকের মূল আলোচ্য বিষয় ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা ও হজ্ব এ দু'টি বিষয় একটি ঘটনাকে সামনে রেখেই চালু হয়েছে।

ঈদুল আযহা ও কুরবানীর অর্থ

মুসলমানদের উৎসবসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আরবী ঈদ শব্দের অর্থ ফিরে আসা, বারবার আসা। এর আরেক অর্থ আনন্দ, ফূর্তি, খুশী ইত্যাদি। আর আযহা এর শাব্দিক অর্থ রক্ত প্রবাহিত করা। এর আরেক অর্থ ত্যাগ তিতিক্ষা। ঈদুল আযহাকে কুরবানীর ঈদও বলা হয়। কুরবানী আরবী শব্দ। এর অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা। সবগুলো শব্দের এক সাথে অর্থ করলে দাঁড়ায়- প্রাণপ্রিয় বস্তুকে আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করার লক্ষ্যে রক্ত প্রবাহিত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় যে দিবস বারবার আমাদের মাঝে খুশি ও আনন্দ দিতে ফিরে আসে তাই ঈদুল আযহা। যে অবিস্মরণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে ঈদুল আযহা প্রতি বছর উদযাপিত হয় তার সূত্রপাত ঘটেছিল প্রায় তিন হাজার আটশত বছর বা প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে। ঈদুল আযহার মৌলিক শিক্ষা হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি ও খোদাপ্রীতি। শুধু পশু কুরবানী নয় বরং নিজেদের মধ্যে যত পশুত্ব, পাশবিকতা ও কুপ্রবৃত্তি আছে সেগুলোকে কতল করে এমন সংকল্প করা যে প্রয়োজনে প্রাণাধিক প্রিয়বস্তুকে আল্লাহর রাহে কুরবানী করতে সদা প্রস্তুত থাকবে। সূরা আল হজ্বের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘এ কুরবানীর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের অবস্খা বা তাকওয়া।' চির বিদ্রোহী কবি নজরুল কত সুন্দর কথা বলেছেন :

এলো স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুজ্জোহার এই সে চাঁদ

তোরা ভোগের পাত্র ফেলে ছুঁড়ে ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।

সকল যুগেই কুরবানীর বিধান ছিল

ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সকল যুগে সকল উম্মতের উপর কুরবানীর বিধান ছিল। সূরা আল হজ্বের ৩৪নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেনো তারা আমার দেয়া পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে। (অহফ ভড়ৎ বাবৎু হধ:রড়হ বি যধাব ধঢ়ঢ়ড়রহ:বফ ৎবষরমরড়ঁং পবৎবসড়হরবং, :যধ: :যবু সধু সবহ:রড়হ :যব হধসব ড়ভ অষষধয ড়াবৎ :যব নবধং: ড়ভ পধ::ষব :যধ: ঐব যধং মরাবহ :যবস ভড়ৎ ভড়ড়ফ). তবে সকল সময় সকলের উপর এক রকম বিধান ছিল না। আদম (আ.)-এর যুগে কবুলকৃত কুরবানীর পশুকে উপর থেকে একটি আগুন এসে পুড়ে ফেলতো। আর কবুল না হলে যেভাবে যবেহ করেছে সেভাবেই পড়ে থাকতো। ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরবর্তীতে কুরবানীর পশুকে যবেহ করে কাবার সামনে অথবা উপসনালয়ের সামনে রেখে দিত।

বর্ণিত আছে, হযরত নূহ (আ.) জন্তু যবাই করার জন্য একটি কুরবানীগাহ নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে তিনি জবাইকৃত জন্তু আগুন দ্বারা জ্বালিয়ে দিতেন। আরব দেশেও প্রাচীনকালে আতিয়া ও ফারা নামক দু' শ্রেণীর বলি উৎসর্গ বা এক বিশেষ ধরনের কুরবানী প্রথা চালু ছিল। রজব মাসে অনুষ্ঠিত হতো বলে এ কুরবানীকে রাজাবিয়াহও বলা হতো। যে দেবতার নামে এই বলিদান অনুষ্ঠিত হতো বলিদানের পর নিহত পশুর রক্ত তার উপর নিক্ষেপ বা লেপন করা হতো। (বোখারী ও মুসলিম)

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে রয়েছে, ‘অমাবস্যাতে গো বৎস বলি দিয়ে ব্রত পালন করবে (ঋগেðদ)। আরো রয়েছে- হিন্দু ধর্মে রণ্ডিদেব নামে এক মহান মনীষী ছিলেন। তিনি একবার এক বিরাট যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে আগত ও অভ্যাগতদের সংখ্যা খাবার যোগাড়ের তুলনায় এত বেশি হয়েছিল যে, তিনি বিপাকে পড়েছিলেন। তাই তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘অভ্যাগতবৃন্দ, আপনারা প্রত্যেকে অল্প পরিমাণে গো মাংস ভক্ষণ করুন। কেননা মাত্র সাঁইত্রিশ হাজার গরু জবাই করা হয়েছে (যর্জুবেদ)।

সর্বপ্রথম কুরবানী হাবিল ও কাবিলের কুরবানী

পৃথিবীর ইতিহাস যত পুরাতন কুরবানীর ইতিহাসও ততো পুরাতন। আদি পিতা আদম (আ.)-এর দু' সন্তান হাবিল ও কাবিলের কুরবানীই সর্বপ্রথম কুরবানী। সূরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- ‘তাদেরকে আদমের দু' পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দাও। তা হচ্ছে এই যে, তারা দু'জনই কুরবানী করলো। একজনের কুরবানী কবুল করা হলো আরেকজনের কুরবানী কবুল করা হলো না। সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবো। উত্তরে সে বলল, আল্লাহতো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন।'

ঈদুল আযহা ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নত

জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে কুরবানী করা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল নবীকে পরীক্ষা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরে ইব্রাহীম (আ.)কেই সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা করেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রাথমিক জীবনে কোন সন্তান হচ্ছিল না। বর্ণনায় পাওয়া যায়, হযরত ইব্রাহীম (আ.) ১৬৫ বছর বেঁচে ছিলেন। তার বয়স যখন পঁচাশি তিনি আল্লাহর কাছে পুত্রের জন্য দোয়া করেন এবং আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। ৮৭ বছর বয়সে আল্লাহ তাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। মা হাজেরার গর্ভে ইসমাঈল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। ইসমাঈলের বয়স এগার মতান্তরে তের মতান্তরে চৌদ্দ বা সতের বছর হলে তাকে কুরবানীর নির্দেশ দেয়া হয়। একে তো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সন্তান লাভ। তারপর কৈশরে পরিণত হওয়া। ঠিক এ মুহূর্তে স্বীয় প্রাণাধিক প্রিয়পুত্রকে কুরবানীর নির্দেশ নি:সন্দেহে ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্য এটা ছিল বিরাট ও বিশাল পরীক্ষা। ইব্রাহীম (আ.) নির্দ্বিধায় এ আদেশ মেনে নেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বীয় পুত্রকে কুরবানী করার মানসে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। অত:পর বৃদ্ধ পিতা স্বীয় পুত্রকে উপুর করে শুইয়ে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পুত্র ছুরির নিচে ঘাড় পেতে দিয়েছে। পিতাপুত্রের এ মর্মস্পর্শী দৃশ্য অবলোকনে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। সূরা আছ-ছফফাত এর ১০০ থেকে ১১১ পর্যন্ত এর ঘটনাকে চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সে বলল, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান কর। সুতরাং আমি তার ডাকে সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অত:পর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কি? সে বলল, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন, আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্য শায়িত করলো, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবে সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু (ফিদিয়া) প্রদান করলাম। আর ভবিষ্যতের জন্য ইব্রাহীমের এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। অর্থাৎ যে ফিদিয়া বা বিনিময় দ্বারা ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত সেই ফিদিয়ার কুরবানী চলবে। এভাবে আত্মোৎসর্গের নিদর্শনস্বরূপ কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানেরা আল্লাহর নামে শুধু কুরবানী করবে।

রাসূল (সা.)-এর সময়ে কুরবানীর প্রবর্তন

জাহেলী সমাজের বাতিল আনন্দ-উৎসব ও সংস্কৃতি পরিহার করে ইসলাম তার আদর্শের ভিত্তিতে দুই ঈদ প্রবর্তন করেছে। হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা.) মদীনায় আগমনের পর দেখলেন মদীনাবাসীদের দু'টি উৎসবের দিন রয়েছে যাতে তারা খেলাধুলা করে। তিনি তাদের জিজ্ঞাস করলেন, এ দু'টি দিন কি? তারা বলল, জাহেলী যুগে আমরা এই দিনে আনন্দ, উৎসব ও খেলাধুলা করতাম। রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা সেই দু'দিনের পরিবর্তে সেগুলো অপেক্ষা উত্তম দু'টি দিন তোমাদের দান করেছেন। একটি হলো ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ আর অপরটি হল ঈদুল ফিতরের দিন (আবু দাউদ)। সেই থেকে মুসলমানদের বার্ষিক উৎসবের দিন হিসেবে এই দুইদিন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়ে আসছে। মক্কায় ওকাব মেলার সময়ও মক্কাবাসী আনন্দ উৎসব করতো এবং পশু কুরবানী করে কাবার সামনে রেখে দিতো।

পবিত্র কুরআনে নবী করীম (সা.)কে নামাযের মত কুরবানী করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তোমার রবের জন্য নামায পড়ো এবং কুরবানী করো' (সূরা কাউসার-২)। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত ‘নবী (সা.) মদীনায় দশ বছর অবস্খান করেন। এ সময় তিনি প্রতি বছর কুরবানী করতেন।' অপর স্খানে বলা হয়েছে, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের দিকে না আসে।' এ থেকে বোঝা যায় নবী করীম (সা.)কে কুরবানীর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি কুরবানী করেছেন এবং উম্মতকে কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছেন।

ঈদের দিনের সুন্নাত কাজ

হাদিসের মাধ্যমে যে সকল করণীয় পাওয়া যায় সেগুলো হলো :

১. খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা ২. মিসওয়াক করা ৩. সাধ্যমত নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড় পরা ৪. ফজরের নামাযের পর ঈদের নামাযের জন্য গোসল করা ৫. সুগি ব্যবহার করা ৬. সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া ৭. ঈদুল আযহার দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং কুরবানীর পশুর কলিজা বা গোস্ত দিয়ে খাওয়া আরম্ভ করা ৮. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া ও আসা ৯. ঈদগাহে একপথে যাওয়া অন্য পথে আসা ১০. ঈদের নামায ঈদগাহে পরা। নবী (সা.) কেবলমাত্র বৃষ্টির দিন ঈদের নামায মসজিদে পড়েছেন ১১. ঈদগাহে যাবার সময় তাকবীর বলা : আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ ১২. ঈদুল আযহায় উচ্চস্বরে তাকবীর বলা ১৩. ঈদুল আযহার চাঁদ দেখার পর কুরবানীর পূর্বে চুল-নখ না কাটা ১৪. ঈদের নামাযের পর খুতবা দেয়া সুন্নাত আর শোনা ওয়াজিব।

কুরবানী কার উপর ওয়াজিব

হজব্রত পালনকারীদের জন্য কুরবানী ওয়াজিব। এ ছাড়া অন্যান্য মুসলমানের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবার শর্ত দু'টি। এক. তাকে সাহেবে নিসাব হতে হবে। অর্থাৎ যার উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে মুকীম হতে হবে। মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। মুসাফির যদি ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বে মুকীম হন তবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।

কুরবানীর পশু

উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু ও মহিষ এই ছয় প্রকারের পশু ছাড়া অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী করলে কুরবানী হবে না। কুরবানীর জন্য উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু-মহিষ অন্তত দুই বছর আর দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া অন্তত এক বছরের হতে হবে। কুরবানীর পশু মোটাতাজা এবং দেখতে মাননসই হওয়া দরকার। দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ, এক পা খোঁড়া, গোড়া থেকে শিং ভাংগা, কান ও লেজ অনেকটা কাটা ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী হয় না।

কুরবানীর অংশীদার

উট, মহিষ ও গরুর মধ্যে ঊর্ধ্বপক্ষে সাতজন পর্যন্ত অংশীদার হতে পারবে। এরকম হলেও ক্ষতি নেই। ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল এক জনের পক্ষ থেকে একটাই কুরবানী করতে হবে। একই পশুকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কুরবানী করার জন্য দু'টি শর্ত রয়েছে।

১. সকল অংশীদারেরই কুরবানী বা আকীকার নিয়ত থাকতে হবে। কোন অংশীদারের কেবল গোশত খাওয়া বা অন্য কোন নিয়ত থাকলে সকলের কুরবানীই বরবাদ হয়ে যাবে।

২. ভাগের প্রতিটি অংশ অবশ্যই সমান হতে হবে।

কুরবানীর তারিখ ও সময়

যিলহজ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানীর সময়। এ ৩ দিনের যে কোন দিন কুরবানী করা যাবে। কুরবানী করতে হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর।

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা

সচ্ছল অবস্খায় লোকেরা নিজের ওয়াজিব কুরবানী ছাড়াও নিজ মুরব্বী ও উস্তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করতে পারেন। যেহেতু কুরবানীতে অফুরন্ত সওয়াব রয়েছে, তা যতো বেশি করে করা যায় ততোই সওয়াব লাভ করা যাবে। নবী করীম (সা.) এবং উম্মুল মুমেনিনগণের পক্ষ থেকেও কুরবানী করা যায়।

কুরবানীর পশু যবেহ করার নিয়ম

পশুকে বামবাহুর উপর শুইয়ে কেবলামুখী করে যবেহ করতে হবে। কেবল উটের বেলায় এনিয়ম প্রযোজ্য নয়। নিজের কুরবানী নিজেই করা উত্তম। যবেহ করায় অক্ষম ব্যক্তি এবং নারীরা নিজ নিজ কুরবানী অবলোকন করবে। ভাগের পশুকে সকল অংশীদার একত্রে ধরে শুইয়ে যবেহ করবেন।

কুরবানীর গোশত

সূরা আল হজ্বের ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরবানীর গোশত কি করতে হবে সে সম্পর্কে বলেন, ‘কুরবানীর পর যখন পশু নির্জীব হয়ে যায়, তখন তা থেকে তোমরা নিজেরা খাও এবং ওই সব লোকদের খেতে দাও, যারা অল্পে তুষ্ট এবং যারা কারো কাছে হাত পাতে না। আর ওইসব লোকদেরও দাও যারা নিজেদের প্রয়োজন পেশ করে।' কুরবানীর গোশত খাওয়া যায়, আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-দু:খীদের মধ্যে বন্টনও করা যায়। এক-তৃতীয়াংশ ফকির-মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে বাকিটা নিজেরা, আত্মীয়-স্বজন ও বু-বাব মিলে খাওয়া যায়। কিন্তু এটা কোন ধরাবাধা নিয়ম নয়। কুরবানীর গোশত অমুসলিমদেরও দেয়া যায়। কিন্তু মজুরী বাবদ দেয়া যাবে না।

কুরবানীর চামড়া

চামড়া বিক্রি করে মূল্য এতিম, অসহায় কিংবা পুনর্বাসন প্রকল্পে দিয়ে দিতে হবে। নিজে চামড়ার টাকা ব্যবহার করতে পারবে না। তবে জায়নামায বানিয়ে চামড়াকে ব্যবহার করতে পারবে।

তাকবীরে তাশরীকের হুকুম

৯ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১৩ যিলহজ্ব আছর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্তে ফরজ নামাযের পর এই তাকবীর পড়বে। ভুলে নামাযের সময় না পড়লে অন্য সময় পড়া ওয়াজিব পালন হয়ে যাবে।

তাকবীরে তাশরীকের ইতিহাস

ইসমাঈল (আ.)কে যখন পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) কুরবানীর উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ইসমাঈল (আ.)কে শয়তান ধোকা দেয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিল, তুমি জান তোমার বাবা তোমাকে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তিনি শয়তানকে চিনতে পেরে বললেন, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। উপুড় করে যবেহ করার মুহূর্তে সকল ফেরেশতা চিৎকার করে বলতে থাকে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর। ইসমাঈলের পরিবর্তে পশু করবানী হওয়াতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) শোকরিয়া আদায় করে বলেন, আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ। আর সবগুলো সমনðয় হলো তাকবীরে তাশরীক।

জমজমের পানি

ঈদুল আযহার কুরবানীর ইতিহাস মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস। আর একই সময়ে যে হজ্বব্রত পালন করা হয় তা মা হযরত হাজেরা (আ.) ও পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর সাথে সম্পৃক্ত ঘটনা। প্রাণপ্রিয় পুত্রের প্রাণ বাঁচাতে পানির প্রত্যাশায় সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এসে ইসমাঈলের পদাঘাতে কুদরতিভাবে পদতলে যে সুমিষ্টি পানির ফুয়ারা তৈরি হয় তাই পরবর্তীতে জমজম কূপে পরিণত হয়। কোটি কোটি বনী আদম প্রতি বছর এ কূপের পানি পান করে, কন্টেইনার ভরে নিয়ে যায় পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নিজের আহাল পরিবারের জন্য।

জমজমের পানি জীবাণুমুক্ত। কোন জীবাণু পড়লে তাতে বাঁচে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দুনিয়ার মধ্যে সর্বোত্তম পানি হচ্ছে জমজমের পানি। এটা সকল রোগের ওষুধ। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সাফা ও মারওয়ার দিক থেকে আসা দু'টি পানি পথ জমজম কূপের ঠিক গভীরে এসে একটি পাথরের গায়ে মিশেছে। যাতে লেখা আছে বিইজনিল্লাহ অর্থাৎ ‘আল্লাহর নির্দেশে'। আর তাই হাজার বছর ধরে জমজম পানি দিয়ে যাচ্ছে অনবরত, ফুরাচ্ছেনা, ফুরাবেনা কোনদিন।

কুরবানী আজ প্রথাগত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কে কত বড় আর তার দামী পশু কিনলো আর যবেহ করলো এটাই আজ দেখার বিষয় (!) হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশু কুরবানী করা হবে আর অমনিতে বস্তায় বস্তায় সওয়াব দিয়ে দেয়া হবে তা কুরবানীর উদ্দেশ্য নয়। বরং তাকওয়া বা মনের অবস্খা বিবেচনা করে সওয়াবের অধিকারী হবে। নিজের পশুত্বকে কতল করতে হবে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নবীদের মতো কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। যেহেতু মুহাম্মদ (সা.)-এর পর কোন নবী আসবেন না এবং কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলে পিতা ইব্রাহীম (আ.)-এর মত উত্তীর্ণ হতে হবে। হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.) এবং মা হাজেরা (রা.) অর্থাৎ পিতা-মাতা ও ছেলের সমনðয়ে এমন এক পরিবার গড়ে তুলতে হবে যা শয়তান ও তার অনুসারীদের সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় বজ্রকঠোর হবে, শয়তানকে পরাজয় বরণে বাধ্য করা হবে। চিরবিদ্রোহী কবি নজরুলের ভাষায় :

ডুবে ইসলাম আসে আঁধার

ইব্রাহীমের মতো আবার

জবী হুল্লাহ ছেলেরা হোক

যাক সব কিছু- সত্য রোক

মা হাজেরা হোক মায়েরা সব।
১৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×