somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাগর মোহ

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘সমুদ্র আমার মোটেই ভাল্লাগে না, জানো! কি বিশাল, কি ভীষণ! সারাক্ষণ কানে তালা লাগানো হু হু শব্দে বড়ো বড়ো ঢেউগুলো কুলে আছড়ে পড়ছে! কেবলি মনে হয়, কোন এক মন্ত্রবলে কেউ বুঝি অদৃশ্য কোন শেকলে ওকে বেঁধে রেখেছে। ও হুঙ্কার দিয়ে, গর্জন করে ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। একবার ছাড়িয়ে নিতে পারলেই মানুষ লোকালয় সব নিমেষেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ওর সামনে দাঁড়ালেই নিজেকে কি যে ছোট মনে হয়! কি তুচ্ছ! আমার খুব ভয় করে।‘
এটুকু পড়েই বীথির চিঠিটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। বীথি আমার স্ত্রী। সবে মাস তিনেক হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমরা দুজনেই ভাটি অঞ্চলের মানুষ। পাহাড় সমুদ্র তেমন ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখা হয়নি। বীথি বোধকরি বার দুয়েক এসেছিলো এদিকে। আমি একেবারেই নতুন। একটা সরকারি চাকুরি করি। বিয়ের এক মাসের মাথায় দেশের একেবারে দক্ষিণের এই থানা শহরে ট্রান্সফার অর্ডার পেলাম। নতুন এলাকা, কোথায় উঠবো, কি খাবো, কিছুই ঠিক নেই বলে বীথিকে রেখে আমি একা এসেছি। একটা ভদ্রগোছের থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে ওকে নিয়ে আসবো। অথচ, এখানে আসা অব্দি মাস চারেক হয়ে এলো, এখনো বাসার ব্যবস্থা কিছু করতে পারি নাই। সত্যি বলতে কি, তেমন গা লাগিয়ে চেষ্টাও করি নাই। আরও দুজন সিনিয়র কলিগের সাথে অফিসের সাথে লাগোয়া একটা ঘরে মেসের মতো থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ওঁরাও স্বপরিবারে থাকার ব্যাপারে ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত করছেন। উনাদের মতে, বাসা না খুঁজে চেষ্টা তদবির করে একেবারে প্রান্তিক এই থানা সদর থেকে সরে পড়াটাই উত্তম। এদিকে বীথি প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখছে। প্রকারান্তরে সেও চাইছে আমি এ জায়গা ছেড়ে চলে আসি। প্রতিটা চিঠিতেই সমুদ্র নিয়ে ওর শঙ্কা, ওর ভয় নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কতো কথা! বীথি কিংবা আমার পরিবারে কেউ জানে না, আমি নিজেই উপরমহলে অনেক ধরাধরি করে এ জায়গায় এসেছি। আমি কখনো সমুদ্র দেখিনি। ছাত্র বয়সে টাকার অভাবে আর চাকরিতে ঢুকে সময়ের অভাবে আমার সমুদ্র দেখা হয়নি। অথচ, ছোট বেলা থেকেই সমুদ্র আমার কাছে একটা ফ্যান্টাসি। আমি চোখ বন্ধ করে সমুদ্র দেখতাম। সমুদ্রে গা ভাসিয়ে দিতাম, সমুদ্রের সাথে কথা বলতাম। মনে মনে কতো স্বপ্ন দেখেছি, বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে আসবো। দুজনে হাত ধরে সমুদ্রের জলে নামবো। সমুদ্র তার দিগন্তব্যাপী বিশালতা নিয়ে, ঢেউ ভাঙার বিরামহীন শব্দ নিয়ে আমাদের অবগাহনের নিমন্ত্রণ জানাবে। আমরা সমুদ্রের জলে সাঁতার কাটবো। কি অদ্ভুত নিয়তি, আমার স্ত্রী বীথির সমুদ্রে ভীষণ ভয়। ও সমুদ্র পছন্দই করে না। যতটুকু ভালোবাসায় আমি সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরতে চাই, ও ঠিক ততটুকু ভয়ে সমুদ্র থেকে দূরে পালায়।



এখানে এসে, আমি আমার মতো করেই সমুদ্রকে পেলাম। সমুদ্রও যেনো আমাকে পেলো। আমাদের দুটো আলাদা সত্বা একই সুরে বেজে উঠলো। অফিস শেষ করে আমি ঘরে ফিরিনা। সম্মোহিত পা ফেলে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকি। অফিসের কোল ঘেঁষে জেলে পাড়াটা আড়াআড়ি ডিঙোলেই সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। এটা ট্যুরিস্ট স্পট না। শেষ বিকেলের দিকে তেমন কেউ থাকে না। আমি যখন সমুদ্রের কাছে যাই, তখন ভাটা থাকে। অনেকদূর অব্দি হেঁটে জলের দেখা মেলে। কিছু বড় বড় পাথরের বোল্ডার এদিক সেদিক ছড়ানো আছে। আমি তেমন একটা পাথরে বসি। আমার গোড়ালি জলে ডুবে থাকে। আমি সমুদ্রের গল্প শুনি। সেই কবেকার আদ্যিকাল থেকে ও ইতিহাস টেনে নিয়ে আসছে। কতো রকমের গল্প! এক সময় সূর্য ডোবার ক্ষণ আসে। উহ! সে কি লাল! পুরো সমুদ্র যেনো নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায় না। মহাকালের গর্ভে আরেকটা দিন সমাহিত হলো। নিদারুণ এক বিষণ্ণতায় পুরো চরাচর ছেয়ে যায়। একটা দিন এসেছিলো, কারো আনন্দ হয়ে, কারো যন্ত্রণা হয়ে। কারো প্রেম হয়ে, কারো বিচ্ছেদ হয়ে। একটা দিন এসেছিলো। কেউ হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়েছে, কেউ ঘৃণায় দূরে ঠেলেছে। ক্ষনিকের জন্য উদ্যাম মাতামাতি, কোলাহল। তারপর সমুদ্রের বুকে আত্মাহুতি। সমুদ্র দু হাত বাড়িয়ে ওকে আলিঙ্গন করেছে। ওকে সমাহিত করেছে। তারপর অন্ধকার এসেছে। হু হু বাতাসে কেবল কান্নার শব্দ। চরাচর কাঁদছে। সে কান্নার শব্দ আমাকে ছাড়িয়ে আরও অনেক অনেক দূরে কোথাও অসীমের দিকে ভেসে যেতে থাকে। আমিও ভাসতে থাকি। আমার চোখে জলের ধারা নামে। রাত গভীর হয়। অনেক দূরে টর্চের আলো দেখে আমার ধ্যান ভাঙে। আমার কলিগরা আমাকে খুঁজছে।


এখানে এসেছি চারমাস হয়ে গেলো। সারাদিন আমার অস্থির লাগে। ভীষণ অস্থির। মানুষের সঙ্গ আমার ভালো লাগে না। অফিসে বসে আমি ক্ষণ গুনি। কখন সময় হবে, আমি কখন সমুদ্রের কাছে যাবো। রাতে ঘরে ফিরে মৌমিতার চিঠিখানা হাতে নিলাম। এ সপ্তাহে ও দুটা চিঠি লিখেছে। আগের চিঠির জবাবও দেয়া হয় নি। চিঠিটা পড়ে, যা হোক একটা জবাব দিতে হবে। মৌমিতা লিখেছে,‘তোমাকে আজ একটা সুখবর দিবো বলে, এই সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো চিঠি লিখছি। বড় মামা তোমার ট্রান্সফার কনফার্ম করে ফেলেছে। দিন কয়েকের মধ্যেই অফিসিয়াল চিঠি পেয়ে যাবে। একেবারে ঢাকায় পোস্টিং! উফ! আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে! আমার বান্ধবি সুমির কথা তোমাকে বলেছিলামনা? ওতো এখন ঢাকায় থাকে। ওর সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে, আপাতত ওদের বাসায় সাবলেট থাকতে পারবো। কতদিন পর, দুই বন্ধু আবার একসাথে হবো! খবরটা শোনার পর থেকে আমার ঘুম চলে গেছে। আচ্ছা, তুমি কি আগে আমাদের বাসায় আসবে? নাকি সরাসরি ঢাকা অফিসে জয়েন করবে? কিছুদিন ছুটি পাবে না? তাহলে এখানে এসে আমি তুমি একসাথে ঢাকা যেতে পারতাম। নতুন বাসা নিলে কত কি কেনা কাটার আছে? আমার কেমন ভয় লাগছে জানো! আমাদের নিজেদের নতুন একটা সংসার হবে। সংসারের কিছুইতো জানি না। রান্নাটাই ভালো পারিনা এখনো। আচ্ছা, রান্না খারাপ হলে তুমি রেগে যাবে নাতো? ক’টা দিনই হয়তো খারাপ হবে। তারপর যা হোক শিখে যাবো, তাই না? শোনো, মশারী কিন্তু তুমি টাঙাবে। ওটা আমি পারবো না। ঘরের আর সব কাজ আমি করবো, আপত্তি নাই, কেবল ওটা তুমি করে দিও, প্লীজ! আচ্ছা, আমরা এখানেতো বাটা মশলা দিয়ে তরিকারি রান্না করি, ঢাকায় কি বাটা মশলা পাওয়া যাবে? মা বলেছে, প্যাকেট মশলায় ভালো রান্না হয় না। একটা পুরনো তেলের কড়াই বাসা থেকে নিয়ে যেতে হবে। মা বলেছে, তা না হলে ভাজা ভাজি করতে গেলে লেগে যাবে। আচ্ছা, ছুটির দিনে আমরা কি বেড়াতে যাবো? ছুটির দিনগুলোতে বাইরেও কোথাও খেয়েও নিতে পারি, তাই না?’ কি উচ্ছাস ভরা প্রতিটি শব্দ! অথচ, শব্দগুলো তাদের আনন্দ নিয়ে আমাকে ছুঁতে পারছে না। চিঠি হাতে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বিচ্ছেদের তীব্র একটা ছুরি আমাকে ফালি ফালি করে কাটছে। রাত গভীর। আমার চোখে ঘুম নেই। চারদিক শুনশান। কলিগরা ঘুমে অচেতন। সমুদ্রে এখন জোয়ার এসেছে। খুব কাছেই ঢেউয়ের বিরামহীন আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। চিঠিটা ওভাবেই বিছানায় ফেলে রেখে, নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। সমুদ্র আমাকে ডাকছে।


সাগর পাড়ে আজ অন্যান্য দিনের চাইতে ভিড় বেশী। প্রতিদিনকার মতো মাছের বাজার বসেনি। ছেলে বুড়ো মহিলা সবাই ভিড় করে দূরে তাকিয়ে আছে। সমুদ্রের ঢেউয়ে একজন মানুষের মৃতদেহ ভাসছে। ফুলে ওঠা শরীরটা অতোদূর থেকে চেনা যাচ্ছে না। স্রোতের টানে ক্রমশ আরও দূরে সরে যাচ্ছে লাশটা। বোধকরি সমুদ্র ওকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:১০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×