জুলাই ২০১৬, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য এক অশনী সংকেত বহন করে নিয়ে এসেছে যা তছনছ করে দিয়েছে বছরের পর বছরধরে গড়ে উঠা সমাজ-সংস্কৃতির এবং অর্থনীতি ও রাজনীতি-কেন্দ্রিক ধারনাগুলোকে। এই মাসের শেষ নাগাদ আমরা বড় ধরনের তিনটি জঙ্গীকার্যক্রমের কথা জানতে পারি যা যথাক্রমে গুলশান ক্যাফে হলি আর্টিজেন ও শোলাকিয়া ইদগাহে সংঘটিত হয় এবং সর্বশেষটিতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী রাজধানীর কল্যানপুরের এক বাসায় ৯ সন্দেহভাজন জঙ্গীকে হত্যা করে কোনধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই। প্রথম ঘটনায়, জঙ্গীরা ১লা জুলাই গুলশানের সুরক্ষীত দুতাবাস এলাকায় অবস্থিত হলি আর্টিজেন রেস্তোরায় হামলা চালিয়ে ৩ বাংলদেশীসহ ২০ জনকে হত্যা করে যাদের ৯জন ইতালীয়, ৭জন জাপানী, এবং ১জন ভারতীয়। ইরাক-সিরিয়া ভিত্তিক জঙ্গী গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (যার আরবী অর্থের সংক্ষীপ্তরূপ দায়েশ যা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়) ওই হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে বৃবতি দেয় এবং ৫ জঙ্গীর ছবি প্রচার করে, যা গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গীদের রক্তাত্ত ছবির সাথে মিলে যায়।
গত ৭ জুলাই (ঈদের দিন) সকালে শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে টহলরত পুলিশের ওপর বোমা, গুলি ও চাপাতি নিয়ে জঙ্গি হামলা করা হয়। এতে দুই পুলিশ, এক নারীসহ চারজন নিহত হয়। আহত হয় ১০ পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জন। হামলাকারীদের মধ্যে একজন গুলিতে নিহত হন। হামলাকারী সন্দেহে শরিফুল ইসলাম ও জাহিদুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর গত ২৬ তারিখে রাজধানীর কল্যাণপুর একটি বাসার অভিযান চালিয়ে পুলিশ-সোয়াট টিম ৯ জঙ্গিকে হত্যা করে যা ‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’ নামে পরিচিত।
লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, গুলশান এবং শোলাকিয়া হামলায় জড়িত এবং কল্যানপুরে নিহত সবাই বয়সে তরুন এবং শিক্ষাগতভাবে মাদ্রাসা পড়ুয়া নয় এবং অর্থনীতিকভাবে সমাজের উচ্চবিত্ত সমাজের। এদের দুজন বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক-বর্তমান মিলে ২৬ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের নাম এসেছে জঙ্গী সম্পৃক্ততায়।
কল্যাণপুর ৯ কথিত-জঙ্গী হত্যারপর মহানগর পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের জানান, নিহতদের নাম, ঠিকানা, পরিচয় এখনো জানা যায়নি৷ প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের নাম, ঠিকানা, পরিচয় এখনো পুলিশ জানে না, তাদের জঙ্গি পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গুলশান হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত হলো পুলিশ? নিহতরা আসলে কারা?পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, কথিত জঙ্গিরা পুলিশের দিকে কমপক্ষে ১১টি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে, আর রাতভর মুহুর্মুহু গুলি ছুড়েছে৷ অভিযানের পর চারটি পিস্তল, ২২ রাউন্ড গুলি, ২৩টি গ্রেনেড, কিছু চাকু ও তলোয়াড় এবং পাঁচ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷ উদ্ধারের এই তালিকা থেকে পরিষ্কার যে, জঙ্গিদের কাছে গুলি ছোড়ার মতো পিস্তল ছিল চারটি৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এই চার পিস্তল দিয়ে হাজার খানেক পুলিশের সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই সম্ভব? ছবি দেখাছে দুটি চাপাতি, একটি পিস্তল? বাপক সংঘর্ষ কি ভাবে হয়? আর সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে পুলিশের দিকে এত গ্রেনেড, গুলি ছোড়া হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হওয়ার কথা৷ পুলিশের সেটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে তা আরো বিস্তারিত প্রকাশ হওয়া উচিত।
গুলশান হামলার সময় জঙ্গিরা রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল সাধারণ পোশাকে৷ সিরিয়া, ইরাক এবং সংশ্লিষ্ট দেশ দু'টির আশেপাশে ছাড়া অন্য কোথাও ‘ইসলামিক স্টেট'-এর জঙ্গিরা কালো পাঞ্জাবি পরে হামলায় অংশ নিয়েছে এমন তথ্যপ্রমাণ তেমন একটা নেই৷ বরং স্থানীয় জনতার সঙ্গে মিশে যাওয়া যায় এমন পোশাকে তাদের হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়৷ কল্যাণপুরে নিহতদের তাই রাতেরবেলা কালো পোশাক পড়ে থাকাটা সন্দেহের উদ্রেক করছে কারো কারো মনে৷ প্রশ্ন জেগেছে, এটা কি তাদের ঘুমানোর পোশাক? পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, নিহত জঙ্গিরা জেএমবির সদস্য ছিল৷ তবে পুলিশের উদ্ধারকৃত আলামতে যে পতাকা, কালো পোশাক ও পাগড়ি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর মতো পোশাক ও পাগড়ি পরা গুলশানের হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করেছিল ‘ইসলামিক স্টেট'-এর সংবাদসংস্থা ‘আমাক'৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এই কথিত জঙ্গিরা কি ইসলামিক স্টেটের জন্য কাজ করতো? কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে যদি সত্যিই নয়জন জঙ্গি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর গুলিতে নিহত হয়ে থাকে, তাহলে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশে উগ্রপন্থিরা তাদের শক্তি সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে৷ আর এ রকম পরিস্থিতি একেবারে নিঁখুতভাবে মোকাবিলার কৃতিত্ব অবশ্যই পুলিশ পেতে পারে, যদি উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে৷
এসব জঙ্গী কার্যক্রমের সাথে শান্তির ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া ইস্যু দিয়ে জঙ্গীদের ব্রেন ওয়াশ করা হয়। একটা কারণ হতে পারে যেহেতু তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক বেশি সায়েন্স অরিয়েন্টেড তারা অনেক বেশি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, যে দুই যোগ দুই চারই হবে বা কোনো সূত্র দিলে ওই ধরনের কাজই হবে। এই সব তরুণের প্রায় সবাই সমাজের এমনসব পরিবার থেকে এসেছে যেখানে পারিবারিক বন্ধন খুব শিথীল এবং পরিবারগুলো তাদের শিশুদের ন্যূনতম ইসলাম শিক্ষা দেয়নি। ফলে ইসলামের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে এদেরকে দানব বানানো হয়েছে এমন মত দেশের জ্ঞানী-গুনীজনের। বিশ্বব্যাপি দায়েশের প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিবৃদ্ধি ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নতুন হূমকি নিয়ে এসেছে। অনেকে একে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ ধ্বংস করার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন ঘড়যন্ত্র বলেও অভিহিত করছে। তবে বাহ্যিক যত ষড়যন্ত্রই হোক সমাজ এ রাষ্ট্র যদি সুসংহত না হয় বাহিরের যে কোন শক্তি তা দখল করতে পারে।
আমাদের সমাজে-রাজনীতিতে একটি শূন্যতা বিরাজ করছে তা হচ্ছে আদর্শের বড় অভাব। বড় দুই দলের রাজনীতির ধারা কিন্তু এই তরুণদের আকর্ষণ করেনা। কেননা এদের মধ্যে কোনো আদর্শবাদ নাই। এদের যে রাজনীতি সেটা হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদল ক্ষমতায় আছে আরেকদল ক্ষমতায় যেতে চায়। এদের প্রতিদ্বন্দ্বীতা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীতা। এখন এই তরুণরা যে দুঃসাহসিক কাজ চায়, স্বপ্নের বাস্তবায়ন চায় এই জায়গাটাতেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হোক বা গোপন পরামর্শের মাধ্যমে হোক তরুণরা ঐদিকে চলে যাচ্ছে। একটা অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে।
কেন এই বেশী সংখ্যায় তরুনরা উগ্রবাদের দিকে যাচ্ছে তার একটা অকাট্য কারন নির্ণয় করা অপরিহার্য। আমরা যদি এইসব জঙ্গীদের শিক্ষাগত, রাজনীতিক, ধর্মীয় অাচার অনুশীলন ও অর্থনীতিক অবস্থান পর্যালোচন করি তাহলে আমরা দেখবো এদের বেশীরভাগই এসেছে অর্থণীতিকভাবে ধনীক শ্রেণী থেকে যাদের কাছে ভোগের সব উপকরন হাতের নাগালে ছিল, জীবনের চ্যালেজ্ঞ বলতে এরা বুঝতো কতবেশী ভোগ করা যায়। আর তাই তারুণ্যের প্রতিনিয়ত চ্যালেজ্ঞ গ্রহণের আগ্রহ এরা এদের পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোয় খুঁজে পায়নি।এই শূন্যতা পূরন করতঃ সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন করার মরন নেশায় এরা জঙ্গী কার্যক্রমের চ্যালেজ্ঞে জড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, এই সব তরুনদের একটা বড় অংশ ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা গ্রহণ করেছে, ইউরোপ-আমেরিকায় পড়েছে অথবা দেশের এলিট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে যেখানে পড়ার জন্য অঢ়েল অর্থের প্রয়োজন হয়। শিক্ষাকার্যক্রমে কোন পর্যায়ে অথবা পারিবারিক কাঠামোয় এদের ইসলাম সম্পর্কে, এদেশ সম্পর্কে অথবা এখানকার সামাজিক পরিগঠন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়নি, মাটি আর মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। এরা একধরনের ভাসা-ভাসা জ্ঞান নিয়ে বড় হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় ভূল ব্যাক্যা দিয়ে জঙ্গীরা এদের ব্রেন ওয়াশ করেছে সহজে।আবার এদের অনেকের পারিবারিক সম্পর্কও মজবুত নয়, সন্তান বাবা-মা'র ভালবাসা ছাড়াই বড় হয়েছে, কেননা অনেক অর্থ উপার্জনের জন্য বাবা-মা এদের সময় দিতে পারেনি। তার উপর আছে অামাদের উচ্চশ্রেণীর সোসাইটি মেইনটেইন-এর নামে ক্লাব বা অন্যত্র গমন যা পারিবারিক, সামজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে ক্ষয় করে দিয়েছে।
পারিবারিক অনুশাসন বর্জিত এই তরুনরা তাই যেখানে তাদের মূল্যায়ন পেয়েছে সেখানে জড়িত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করার জন্য কেবল পারিবারিক অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র কাজ নয়, তবে এ্টা মৌলিক কাজ তাতে সন্দেহ নাই।আজকের বা-মা'দের বুজতে হবে সন্তানকে সময় দেয়া তার জন্য অর্থ ইপার্জন করা থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ন।
এর পাশাপাশি সমাজের মধ্যে একটা আদর্শবাদী সামজিক-রাজনীতিক ধারা থাকতে হবে যারা তরুণদের কাছে সমাজ-গঠনের জন্য, ইনসাফের সমাজ কায়েমের জন্য নিত্য-নতুন চ্যালেজ্ঞ দিতে পারবে। সরকারকেও বুজতে হবে এই ধরনের প্ল্যাটফরম না থাকলে তাতে তরূনরা জঙ্গী হয়ে উঠবে এবং তাতে শাপে বর হবে।
এটাতো অস্বীকার করা যাবেনা, ইনসাফ, ন্যায়-বিচার, সমতা এবং জুলুম প্রতিরোধে ইসলামের একটা শ্বাশ্বত অবেদন আছে মুসলিম তরুনদের কাছে।এখন এই ইনষাফের সমাজ কায়েম করার জন্য দুনিয়া ব্যাপি মুসলিমদের মধ্যে নানা ফেরকা আছে, তবে রাজনীতিক ইসলামের ধারাটিই বেশী জনপ্রিয় যদিও তারাই সবচেয়ে বেশী রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুখে।বাংলাদেশে রাজনীতিক ইসলাম কোনঠাসা হয়ে আছে সরকারের নানাধরনের নিবর্তনমূলক কাজের কারনে এবং সেসব রাজনীতিক দলের বালখিল্য কার্যক্রমের জন্যও বটে। এখন দু-পক্ষকেই দেশের এই ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসতে হবে, কেননা এদের কাছে ইসলামের একটা মধ্যপন্থী ব্যাখ্যা আছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু বিচ্যু্তি ছাড়া এ্ররা ইসলামের এই ধারার চর্চা করে আসছে। তরূণদের জঙ্গী কার্যক্রম থেকে সরাতে সরকারের উচিৎ এদের ব্যাবহার করা, আলেমদের ব্যাবহার করা আর পাশাপাশি সুষ্ঠু রাজনীতিক পরিবেশ নিশ্চত করা। অন্যথায়, আমাদের আশংকা এই দেশকে বাঁচানো যাবেনা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:২৭