somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১০ ভোর ৬:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একাত্তরে জন্ম নেয়া রিয়ান ভালো করেই জানে বাঙ্গালীর ইতিহাস ঐতিহ্য। সে জন্মেছিল এক উত্তাল সময়ে। এক দুর্যোগের সময়ে। তার নামের সঙ্গে ইতিহাস পুরোটাই জড়িয়ে আছে। যে ইতিহাসের পাতা রিয়ান বড় হয়ে একটা একটা করে পড়েছে আর চেতনার নাভীমূলে টের পেয়েছে এক তিরতিরে কষ্টের বয়ে যাওয়া স্রোতের ক্ষীণধারা। রিয়ানের জন্মই ছিলো সে ইতিহাসে আঁতুড়ঘরে। জন্মের মুহুর্তে দেখেছিলো এক কালো রাত্তির, দীর্ঘ দীর্ঘ কালো রাত্তির। তারপর বেড়ে উঠা রিয়ানের চেতনায় পুরোটাই মিশেছিলো একাত্তর। ইনঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে রিয়ান তাই ইতিহাসে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যে নাম নিজেই বহন করে ইতিহাসের উপাদান, যে জন্ম-মুহুর্তে ইতিহাস হয়ে যায়, সেতো এমন ইতিহাস প্রেমিক হবেই, জানা কথা।

উচ্চ পদস্থ বাবার সন্তান রিয়ান। বাবার ক্যারিয়ারের চরমতম মুহুর্তে রিয়ান গর্ভে আসে তার মায়ের। বাবা মাকে একা ফেলে যুদ্ধে। মায়ের ভিতরে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছিলো সে। একদিন খবর আসে সাদিক ইকবাল ইন্ডিয়া চলে গেছেন। আরো খবর আসে যে কোনভাবেই যেনো সালেহা ইকবালও ইন্ডিয়া চলে যান। অনেক কষ্টে, নিজেকে সংযত আর ধৈর্যের মুখে উত্তীর্ণ করে তবেই সালেহা ইকবাল ইন্ডিয়া যেতে পেরেছিলেন। একে তো যাওয়ার সমস্যা, তার উপর আবার স্পাইদের চোখ-কান খোলা ছিলো চতুর ঈগলের মত। কাজ নির্ধারিত করাই ছিলো। ক্যাম্পে গণ-সঙ্গীত পরিবেশন আর মক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া। সালেহা ইকবাল বেশ ভালোভাবেই করেন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব।

কিছুদিন পরেই রিয়ানের জন্ম। বাবা তখন যুদ্ধের ময়দানে নিজেকে জীবন মৃত্যুর খেলায় প্রতিনিয়ত বাজি রাখছেন। বাংলাদেশের কোন এক গহন অরণ্যে। রিয়ান জন্মেই দেখেনি বাবাকে। আর কোনদিনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। তাই বাবা মানে তার কাছে এক মৃত-স্মৃতি শুধু। কেবল ফ্রেমে আঁটা কিছু ছবি মায়ের সঙ্গে, যুদ্ধের পুরোটা গেছে যেই ছবির উপর দিয়ে। সেটাই তার বাবার আদল।

রিয়ান অক্সফোর্ডের ছাত্র। মা তাকে সোনার চামচ মুখে রেখে বড় করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু লেখাপড়ার বিষয়ে কোনদিন ছাড় দেননি। রিয়ান
বরাবর ভালো ছাত্র এবং অনেক কষ্টে-সৃষ্টে মা তাকে ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছেন। মায়ের স্বপ্ন পূরণে রিয়ান নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে যতটুকু পারা ততটুকুই। মায়ের ইচ্ছে ছিলো বিশ্বের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছাত্রের মা হিসাবে নিজেকে দেখবেন। রিয়ান তাই নিজেকে গড়েছে সেরকম করেই। আর কিছু না পারুক মায়ের স্বপ্ন সে পূরণ করবে, এ স্বপ্ন সেও দেখত। তাই সে মনে প্রাণে মায়ের স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত থেকেছে।

রিয়ানের বান্ধবী শেলী। ইংল্যান্ডেই জন্ম। দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না ও বাঙ্গালী। যেমন গায়ের রঙ তেমনি উচ্চতা। কিন্তু বাঙালিয়ানার পুরোটা ধারণ করে আছে শেলী।

রিয়ান খুশী হয় শেলীর এমন গুন মুগ্ধতায়। মাকে সে প্রতিটি চিঠিতে লিখত শেলীর কথা। মা শুনে খুশী হতেন। এমন একটা মেয়েকে পেয়েছে রিয়ান, কপাল ভালো তার ছেলের। এবং ছাত্রী হিসেবেও শেলী তুখোড়। ইউনিভার্সিটিতে সেরা ছাত্রী হিসাবে শেলীর নাম সবার আগে।

পড়ালেখা শেষের দিকে। রিয়ানও কম ভালো না ছাত্র হিসেবে! ইউনিভার্সিটি তাদের দুজনকেই অফার দিয়েছে পড়ানোর জন্য। কিন্তু রিয়ান থাকবে না। কারণ সে দেশ ছেড়ে থাকতে পারবে না। এতদিন কষ্ট করে শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পরে ছিলো। এখন আর সে পরিস্থতি নেই। দেশে মা আছে। যে মা তাকে নিয়ে এতবড় একটা যুদ্ধ সামাল দিলেন সে মাকে ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হিসাবে তার প্রচুর দায়িত্ব নিতে হবে দেশের। মাকে সে চিঠি লিখে সব বলে। আর শেলীকে বলার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু শেলী তাকে শুনায় অন্য এক অধ্যায়ের কালো ইতিহাসের বয়ান। যা শুনতে কোনদিনও চাইত না রিয়ান।

শেলীর মা পাকিস্তানি। বাবা বাঙ্গালী। ইংল্যান্ডে স্থায়ী শেলীর বাবা প্রেমে পড়েন পাকিস্তানি তরুণী মীরার। কলেজ লাইফে বন্ধুত্ব, প্রেম, তারপর পরিবারের কথা অমান্য করে বিয়ে। ভালোই চলছিলো সংসার। কিন্তু বাঁধ সাধল একাত্তর। একাত্তরের এমন ভয়াল দিনে রাফিক নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারলেন না। কিন্তু ভুল ততদিনে করে ফেলেছেন তারা। তাদের ভালোবাসার সন্তান শেলী তখন মাতৃগর্ভে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্তনা দিয়ে দিয়ে শেলীর জন্ম পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো তাদের সংসার। তারপর আলাদা সংসারের গেরস্থালি। কেউ কাউকে ঘৃণা পর্যন্ত করতে পারেননি। কেবল সত্ত্বার ভিতরে, রক্তের ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলছিলো আগুনের লেলিহান শিখা রাফিক সাহেবের। যে পাক-আর্মিরা গুলি করে মারছে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে, সেই পাক-আর্মিদের মেয়েকে নিয়ে তিনি সংসার করবেন এ তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব ছিলো। তিনি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেন নাই এরকম সংসারের দুটানা মনোভাব। ভালোবেসে বিয়ে করা এক জিনিস, আর নিজের স্বজাতির রক্তে হুলি খেলা আরেক জিনিস। নিজের জ্ঞাতি ভাইকে যে পাক বাহিনী পাখিদের থেকে বেশী নির্মম ভাবে গুলি করে মারছে, সেই পাক বাহিনীর এক রক্তের উত্তরাধিকারী নিয়ে তিনি সংসার করতে পারবেন না। এ যে নিজের সঙ্গে বেইমানী করা! নিজের জাতির সঙ্গে বেঈমানী করা !

শেলী তার মায়ের সঙ্গে চলে যায়। কিছুদিন পরে শেলীর মা শেলীকে ফেরত দিয়ে দেন রাফিকের কাছে। তিনি জানতেন শেলী কতটা প্রিয় রাফিকের কাছে। তার ভিতরে ভিতরে এক ধরণের গ্লানি কাজ করত। তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবতেন। যদিও তার কিছু করার নাই, তবুও নিজের দেশকে তিনি মনে মনে একটু হলেও ঘৃণা করতে শিখেছিলেন। যে দেশ কেড়ে নেয় তার ভালোবাসা, তার সংসার, তার জীবনকে তছনছ করে দেয় সেই দেশকে তিনি মনে মনে ভুলে যেতে থাকেন। প্রথমে রাফিককে বুঝতে কষ্ট হলেও পরে তিনি ঠিকই বুঝেন কেন রাফিক সংসার করতে পারেনি তাকে নিয়ে। অথচ আজও তাদের মধ্যে ভালোবাসা কমতি নেই, নেই কোন মনোমালিন্য। তাদের সন্তান শেলীকে নিজের কাছে আনার কথা পর্যন্ত ভাবেননি রাফিক, পাছে তিনি কষ্ট পান। তিনি রাফিকের কষ্টটা বুঝতে পারতেন। তাই তিনি মেনে নেন রাফিকের এই এক তরফা সংসার ভাঙ্গার খেলা। তাই তিনি শেলীকে নিজের কাছে না রেখে রাফিকের কাছে দিয়ে দেন যাতে রাফিক কিছুটা হলেও শান্তি পায়। মীরাকে ভালোবাসতে না পারার যন্ত্রণা শেলীকে ভালোবেসে ভুলতে চান রাফিক। এ যে তারই রক্তের উত্তরাধিকারী। এ যে তার সত্ত্বার ভিতরে আরেক সত্ত্বা।

কিছুদিন পরে মীরা মারা যান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। হঠাৎ করেই। শেলী তখন কলেজ শেষ করেছে মাত্র। রাফিক ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলেন তখন। সংসার না থাকলেও মীরা পুরোটাই আগলে রেখেছিলেন যেনো। কেউই তারা কাউকে ভুলতে পারেননি। দুজের ভালোবাসা দুজনকে গোপনে গোপনে কাঁদাত। শেলী ছিলো মাঝখানে এক সেঁতু। দুই পাড়ে আটকে পড়া দুই যাত্রীর ভুল জীবন যাপনের। যুদ্ধের দামামা কত মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিয়ে যায় ভৌগলিক সীমারেখার বাইরেও, সে খবর কি রাখে যুদ্ধ!

রিয়ান মাকে জানায় সব কিছু। মা শুনে আকাশ থেকে পড়েন! এ কি শুনছেন তিনি। তিনি নিশ্চুপ বসে থাকেন। এ অসম্ভব! এ একেবারে অসম্ভব! এ তিনি কোনদিন মেনে নিতে পারবেন না। যে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রিয়ানের বাবা মারা গেলেন সেই পাক বাহিনীর আরেক রক্তের ধারা তিনি কি করে মেনে নিবেন তার ঘরে। তার আপন ঘরে। যে পাক বাহিনীর জন্য রিয়ানের জন্ম নিজের দেশে হতে পারেনি, তিনি ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিজের জীবন কাটালেন এতটা দিন! সেই পাক-মেয়ে! তিনি কোনদিনই মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু তার ছেলে! যে এতদিন থেকে ভালোবাসলো শেলীকে, এত এত ভালোবাসা শেলীর প্রতি তার ছেলের, আর শেলী যে পরদেশী সংস্কৃতিতে বড় হয়েও পুরোটাই ধারণ করেছে বাঙ্গালীত্ব, নিজেকে পুরোপুরি সঁপে রেখেছে বাঙালিয়ানায়, আর শেলীর বাবা, যার এক জনম কেটেছে যুদ্ধের তুমুল হট্টগোলের ভিতর, সারাটা জীবনভর শুধু ত্যাগ আর ত্যাগের ভিতরে বসবাস, তার কি হবে!!!

********************



সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:০৪
৫৫টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×