যদিও পৃথিবীর লোক তাঁকে মার্ক টোয়েন নামেই চেনে, তাঁর আসল নাম কিন্তু স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স, জন্ম 1834 সালে 30 এ নভেম্বর, শীতের এক বিষন্ন সন্ধ্যায় মিসৌরির প্রদেশের অন্তর্গত ছোট্ট শহর ফ্লোরিডাতে । বাবা, ভার্জিনিয়ান বংশোদ্ভুত জন মার্শাল ক্লিমেন্স প্রথমে ছিলেন উকিল ও পরে স্থানীয় বিচারক-জাস্টিস অভ দ্য পিস । মার্ক টোয়েন পরে বড়াই করে বলেছেন তিনি জন্ম নিয়ে ফ্লোরিডা শহরের জনসংখ্যা শতকরা এক শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন (মানে শহরের জনসংখ্যা ছিল একশো!) । স্যামের বাবা জন মার্শাল ক্লিমেন্স, তাঁর ভায়রাভাই জন কোয়ারলেসের আমন্ত্রণে পার্টনারশিপে দোকান চালাতে এসেছিলেন ফ্লোরিডা শহরে ।
সে সময় সীমান্ত এলাকাতে (মিসৌরি তখন সীমান্তেই অবস্থিত ছিলো ) দোকান চালাতে হলে দোকানদারকে তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি আর হিউমারের দরকার ছিলো, খদ্দের কিছু একটা কিনলেই ফাও পাবার আশা করত, যেমন প্রাণ ভরে পাইপে তামাক ধ্বংস করার, বা পিপে থেকে দরাজ হাতে মদ ঢেলে নেবার অধিকার। ব্যাপারটা বেরসিক জন ক্লিমেন্সের খুবই অনূচিত ও অন্যায় মনে হল (হাজার হোক একে ভার্জিনিয়ান তার উপর উকিল !) । তিনি তাঁর লজিক আর বিশুদ্ধ ভার্জিনিয়ান ভাষা নিয়ে ক্রেতাদের থেকে কিছুটা উঁচু স্তরেই রয়ে গেলেন । শিগগিরই লালবাতি জ্বলল দোকানে, কিন্তু দুই ভায়রাভাইয়ের বন্ধুত্বে একমুহুতের্র জন্যও ভাঁটা পড়ল না তাতে ।
স্যামির খালু জন কোয়ারলেস তাঁর দাসদাসী নিয়ে চাষবাষে লেগে পড়লেন আর ক্লিমেন্স ভাগ্য পরীক্ষার জন্য চলে এলেন ছোট্ট মিসিসিপি নদীর তীরে হ্যানিবাল শহরে। বাচ্চা স্যামির কাছে হ্যানিবাল শহরটা ভালোই লাগত, বাড়িতে ছিলো বড় বোন পামেলা আর ছোট ভাই হেনরি, বড় ভাই ওরাইওন সেইন্ট লুইতে ছাপাখানার কাজ শিখছিল । বাবা জন মার্শাল ক্লিমেন্স হানিবালের জাস্টিস অভ দ্য পিস হলেন । অ্যাডভেঞ্চার অভ টম সয়্যার বইটা পড়েছেন হ্যানিবাল শহরটা তাঁদের পরিচিত (বইতে কাল্পনিক সেইন্ট পিটার্সবুর্গ) । মার্ক টোয়েনের ছোটবেলাটা কেটেছে মিসিসিপি নদীর তীরে । এই মহানদী তাঁর রচনায় গভীর ছাপ রেখে গেছে । পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মিসিসিপি নদীর বাঁকে অবস্থিত হ্যানিবাল শহর । নদীর উপরে চলে এসেছে পাহাড়ের দুটো চুড়ো হলিডে হিল আর লাভার্স লিপ (টম সয়্যারের পুরোটা আর হাকলবেরি ফিন প্রথম অংশের পটভুমি ) ।
মিসিসিপির তীরে দাপিয়ে বেড়ান প্রায় সব বালকেরই স্বপ্ন ছিল স্টিমারের পাইলট হবার । সত্যি বলতে কি, হ্যানিবালের মতো ছোট্ট শহরে কোন স্টিমারের আসাটা ছিল একটা মস্ত ঘটনা । মুহুর্তে সরগরম হয়ে উঠত গোটা শহর, ছেলে বুড়ো সবাই ছুটতে আরম্ভ করত স্টিমার ঘাটের দিকে । 'চিমনি দিয়ে ঘন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে, এঞ্জিন রুমের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ফারনেসের গনগনে আগুন, স্টেট রুমগুলোর ঝকঝকে স্ফটিকের ঝাড় বাতি, ঘন্টার শব্দ, খালাসিদের হাঁকডাক, হালে দাড়াঁনো সারেঙ এবং সবার উপর হারিকেন ডেকে দাড়িঁয়ে আছেন ধীরস্থির ক্যাপ্টেন, সব আমরা খেয়াল করতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে' এভাবেই পরবর্তীকালে বর্ননা করেছেন মার্ক টোয়েন আত্মজীবনীতে । বলা বাহুল্য স্যাম ক্লিমেন্স আর দলবল ও সেখানে গিয়ে হাজির । জাহাজের প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার লক্ষ্য করত তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে । অবাক হবার কোন কারন নেই যে এই ছেলেদের অনেকেই বড় হয়ে স্টিমারের পাইলট হবার স্বপ্ন দেখত । অতো বড় একটা জাহাজের হাল ধরে বসা, আহা ভাবতেও কেমন লাগে!
টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিনের চরিত্রগুলো বেশিরভাগই বাস্তব থেকে নেয়া । জো হার্পারকে (টেরর অভ দ্য সীজ )টোয়েন নিয়েছেন তাঁর বন্ধু জন ব্রিগস আর উইল বোয়েনকে মডেল করে । আর হাকলবেরি ফিনকে তিনি নিয়েছেন টম ব্ল্যান্কেনশিপকে. টমের বাবা উডসান ব্ল্যান্কেনশিপ ছিল শহরের অন্যতম প্রধান মাতাল ও ভবঘুরে । পরিত্যক্ত এক চামড়ার একপাল শুয়োরের সাথে দিব্যি পড়ে থাকত সে । নেশা না করলে, মাছধরে আর শিকার করে দিন কাটাত সে । উডসান ব্ল্যান্কেনশিপই যে হাক ফিনের বাবা চরিত্র তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় কারোর (যদিও ছেলেকে টাকার জন্য অপহরন করেনি সে বাস্তবে, যেমন করেছিলো হাক ফিনের বাবা (!!!) ।
স্কুল স্যামির ভালো লাগতনা মোটেই, তবে স্কুলেই তার পরিচয় হয় উইল বোয়েন, টমি ব্রিগসদের সাথে । এদের নিয়ে স্যাম ক্লিমেন্স দল গড়ে তোলে, স্কুল পালিয়ে মাছ ধরতে যেত, জলদস্যু-জলদস্যু খেলত কিংবা সাঁতরে নদীর মাঝখানের জ্যাকসনের দ্বীপে চলে যেত । জ্যাকসন্স আইল্যান্ড কাল্পনিক নয়, আসলেই আছে ওটা মিসিসিপি নদীর মাঝখানে, দ্বীপের মাঝে আছে বাদুর ভর্তি গুহাটাও, যার ভেতরে টম সয়্যার আর বেকি থ্যাচার গল্প করতে করতে হারিয়ে গিয়েছিলো, সেটাও সম্পুর্ণ বাস্তব । আসলে টম সয়্যার আরহাকলবেরি ফিনে যে চরিত্রগুলো আছে তার প্রায় সবই বাস্তব থেকে নেয়া ।
টম ব্ল্যান্কেনশিপের বড় ভাই বেন ব্ল্যান্কেনশিপকেও ব্যাবহার করেছেন টোয়েন । বেন একবার এক পলাতক ক্রীতদাসকে আবিস্কার করেছিলো মিসিসিপি নদীর চরে । পঞ্চাশ ডলার পুরস্কারের লোভ সত্বেও বেন তাকে ধরিয়ে দেয়নি, বরং তাকে মাছ ধরার বড়ঁশি ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করেছিল সে । শেষ পর্যন্ত একদল কাঠুরের চোখে পড়ে যায় এই পলাতক ক্রীতদাস, তাড়া খেয়ে সাঁতরে মিসিসিপি নদী পার হতে গিয়ে ডুবে মরে সে । এই ঘটনাটাই হাকলবেরি ফিনের মধ্যে আছে, পলাতক ক্রীতদাস জিমকে ধরিয়ে দেবার ব্যাপারে হাকের মানসিক অন্তর্দন্দ্ব ।
বাবার অকাল মৃত্যুর পর স্কুল ছাড়তে হয় স্যামিকে । কিছুদিন এটা ওটা করবার পর শিক্ষানবিশ কম্পোজিটর মিসৌরি কুরিয়ার পত্রিকায় ঠাঁই হয় তার । মালিক ছিলেন পি. ই, আমেন্ট নামে এক বিরাট বপু ভদ্রলোক, মজুরি হিসেবে মালিকের ফেলে দেয়া জামাকাপড় আর যৎসামান্য খাবারদাবার জুটত কপালে, কিন্তু নগদ একটা পয়সাও না ! এখানেই যা সাড়ে আট বছরের স্কুল জীবনে সম্ভব হয়নি, তা সম্ভব হল, স্যাম কষ্ট করে পড়তে শিখল । আব্রাহাম লিংকন যথার্থই বলেছেন 'ছাপাখানা হচ্ছে গরীবের কলেজ' আর একজন কম্পোজিটরের পক্ষে দিনের পর দিন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কম্পোজ করে সম্পুর্ণ নিরক্ষর থাকা অসম্ভব ব্যাপার ।
তবে প্রয়াত জন মার্শাল ক্লিমেন্সের অনেক স্বপ্নের মধ্যে পারিবারিকভাবে একটা পত্রিকা বের করার স্বপ্নও অন্যতম । স্যামের মা জেইন ল্যাম্পটন ক্লিমেন্স স্বপ্নটা মনে রেখেছিলেন । ক্লিমেন্সদের একেবারে নিজস্ব হ্যানিবাল জার্নাল পত্রিকা বের করার জন্য স্যামের বড়ভাই ওরাইওন ক্লিমেন্স তার সেইন্ট লুইয়ের চাকুরি ছেড়ে হ্যানিবলে চলে এলো দেখে মা ভারি খুশি হলেন । পত্রিকার অফিস হলো ক্লিমেন্সদের হিল স্ট্রিটের বাড়ির বৈঠকখানা । স্যামিকে ছাড়িয়ে আনা হলো "কুরিয়ার" থেকে পদোন্নতি সহকারে, অবৈতনিক কম্পোজিটর কাম সহকারি সম্পাদক হয়ে উঠলো সে নতুন কাগজের । তবে ওরাইওনের বেশি ভালোমানুষি আর ম্যাড়মেড়ে সম্পাদনার জন্য হ্যানিবাল জার্নাল খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি প্রথম থেকেই ।
সেসময় (1850 এর দশকে) আমেরিকার পশ্চিমে পত্রিকা চালানো ছিলো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার, মানষের হাতে টাকা ছিলো কম, অনেকসময় চাঁদা ব্যবদ অনেক সময় গ্রাহকের কাছ থেকে ডিম বা আলুও নিতে হত । ওরাইওন যদি স্যামের বুদ্ধি ধার নিতেন এব্যাপারে, তাহলে হয়তো আরেকটু বেশি পাঠক টানতে পারত জার্নাল । স্যামের পরামর্শ ছিল পাঠকের কৌতুহল আছে বা মনোযোগ আকর্ষিত হবে এমন সব জিনিস ছাপানো । কোন কারনে ওরাইওন শহরের বাইরে গেলে স্যাম সম্পাদক হয়ে বসত । তখনই কেবল নিজ নামে কিছু ছাপানোর সুযোগ ঘটত তার । অবশ্য ওরাইওন শহরে ফিরলে আগের পদে ফিরতে করতে হতো তাকে ।
স্যাম ক্লিমেন্সের একটা প্রতিদন্দ্বী পত্রিকার সম্পাদক প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মিসিসিপি নদীতে আত্বহত্যা করতে গিয়েছিলেন । হ্যানিবাল জার্নালে খবরটা ফলাও করে ছাপা হলো (স্যাম সাময়িকভাবে সম্পাদকের চেয়ারে ) । হ্যান্ডবিল ছাপানোর যে বড় কাঠের ব্লক ছিল, তার একটাতে খোদাইকরে ছবি ছাপানো হলো, আত্বহননেচ্ছু সম্পাদক লাঠি হাতে (পানি মাপতে !) নদীতে নামছেন । সে সংখ্যা জার্নাল ছাপিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারা গেলনা । ক্ষিপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পাদক জার্নাল অফিসে এসে ক্লিমেন্সদের সবকটাকে পিটিয়ে যাবার হুমকি দিলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলের হাসির খোরাক হয়ে বেচারাকে শহর ছাড়তে হলো ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০০৭ ভোর ৪:৩৭