কবি জিন্নাহ্ বিন্ জয়নুদ্দিন মারা গেছেন। কিভাবে মারা গেছেন জিজ্ঞেস করি নি। প্রয়োজন অনুভব ও করি নি। তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে গভীর শোকে মূহ্যমান করে তোলে নি।আমি জানি মৃত্যু একটা অনিবার্য প্রাকৃতিক বিষয়, কিন্তু তার শুন্যতা হঠাৎ আমাকে প্রগাঢ় ভাবে আকড়ে ধরে।
নির্দ্বিধায় হাঁটুর বয়েসী আমার সাথে তার সম্পর্কের গভীরতায় আমি বিলীন হতে থাকি। আনেক ছোট বেলা থেকে তাকে দেখে আসলেও পরিচয় ২০০৪ কিংবা ওই দিকটায়, আমাদের লিটল ম্যাগের লেখা নেবার সময়।'টোক' ( ঘাটাইল থেকে আমাদের প্রকাশিত লিটল ম্যাগ) নিয়ে উনার উৎসাহ ছিল সীমাহীন, আমার সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন নানা পরবর্তী সংখ্যা কবে বের করছো? ঊনাকে আমি নানা বলে ডাকতাম। একবার টোক বের করার পর প্রেস থেকে আনার সময় আমার পকেট শূন্য, মালিকের বাঁকা চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম কাল দিয়ে যাব, তখন ও জানতাম না কীভাবে দিব! রাস্তায় নানার সাথে দেখা, উনি একটা সংখ্যা পেয়ে প্রচন্ড খুশি হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখলেন, পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বললেন এটা রাখ, আমি একটু কাচুমাচু করলে উনি বললেন, নানা আমি বুঝি পত্রিকা বের করা কত ঝামেলা , তুমি এটা রাখ। নানা নিজেও একটা ছোট কাগজ বের করতেন আনেক আগে 'গাংচিল', সেটা আমার জন্মের সময়কার , গাংচিলের কোন সংখ্যা আমি দেখিনি, যারা দেখেছেন তাদের কাছ থেকে এবং নিজে উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারি ৯০ এর সময়ে একটা মফস্বল থেকে ভালো পত্রিকা বের করাটা কেমন দুঃসাধ্য ছিল। নানাকে প্রায়ই বলতাম পত্রিকাটা আবার বের করার জন্য, উনি আমাকে বলতেন নানা এবার তোমাকে নিয়ে বের করে ফেলব। প্রায় প্রত্যেকবার ভার্সিটি থেকে ঘাটাইল গেলে নানার সাথে দেখা হত, উনি আমাকে রাস্তার পাশে কোন চায়ের দোকেনে বসিয়ে চা খাওয়াতেন , নিজে একটা সিগারেট ধরাতেন, আমাদের দুজনের নিবিড় আড্ডা চলত অনির্ধারিত সময়। নানার গ্রামের বাড়ি ছিল বীরসিংহ , পড়ন্ত বিকেলে একদিন আমাকে বলছিলেন নানা তোমাকে আমি একবার আমার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবো, সেখানে শুধু সবুজ ধানের খেত, আমরা আইল ধরে ধান খেতের ভিতর দিয়ে হেঁটে নদীর পাড়ে যাবো, সেখানের উথাল পাথাল বাতাসে দেখবা তুমি হারিয়ে গেছো। বাড়ি ফেরার সময় জেলেদের কাছ থেকে ছোত মাছ কিনে নিয়ে যাব, বাড়িতে আমার ভাইয়ের মেয়েটা খুব ভালো ছোট মাছের চচ্চড়ি রান্না করে। নানা ছিলেন চিরকুমার,তার ছাত্রছাত্রীর কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ইংরেজির শিক্ষক। টোক এর সর্বশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত কবি জিন্নাহ্ বিন্ জয়নুদ্দিন এর একটা ছড়া
উড়াল
হঠাৎ করেই উড়াল দিলে তুমি
ঘরে কি আর রইতে পারি আমি?
আকাশ পাড়ের কোন ঠিকানায়
কোথায় তোমার গাঁও
বায়ুর সাগর ভেলায় চড়ে
সেই খানেতে যাও।
নতুন দেশে লাগছে ক্যামন
ক্যামন তোমার ঘর
সবাই তোমার আপন বেশি
আমরা কেবল পর।
হাওয়ায় হাওয়ায় মন উড়ে যায়
যেন উড়াল পাখি
কখনো কি হয় না মনে
একটু খানি দ্যাখি।
মনের ঘরে জ্বলছে আগুন
কে নেভাবে আর
চার দিকে শুন্য আকাশ
পোঁড়া এ সংসার।
রাতের বেলা যখন নিয়ন আলোয় হেঁটে হলে ফিরছিলাম তখন মনে হচ্ছিল- একটা সবুজ ধান খেতের ভিতর দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের মায়া মেখে কেউ একজন মাতাল হাওয়ার নদী পেরুচ্ছে, আমি নরম সবুজ ঘাসে শুয়ে বসন্তের রাতের তারায় চোখ মেলে আছি.....
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ১২:২৬