somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাল শিকড়

২৭ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অইতো শাওন, কোপা শালারে! শ্লেষ্মা আর হিংস্রতা মেশানো গলায় নোমান উৎসাহ দেয় মনিকে, চাপাতিটাও ছুড়ে দেয় ওর হাতে। মনি আর শাওন স্কুল বন্ধু, আর সবাই ভেঙে পড়া কাঁচের টুকরোর মত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভাবে এক এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ওরা দু'জন কীভাবে যেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, কিন্তু বিভাগ ভিন্ন। ভর্তির পর হলে উঠার সময়টা ছাড়া আর কখনো বিচ্ছিন্ন হয় নি ওরা। মনিকে হলে তোলার ব্যাপারে সাহায্য করার কথা ছিল পাশের বাড়ির বড় ভাইয়ের, ভর্তির পর পরই তার সাথে যোগাযোগ করে ও, ভাই সাহায্যও করেছিল। শাওন ও হলে উঠে পরে বিভাগের বড় ভাইদের কাছে ধর্ণা দিয়ে। হলে উঠার পর তারা দু'জন পরস্পরকে আবিষ্কার করে পাশাপাশি দুটো রুমে, দুটো ভিন্ন দলের গনরুমে। মনি ছাত্তার গ্রুপ এবং শাওন মিলন গ্রুপ।
মনি আবার শুনতে পায় কোপা মাদারচোদতারে, মনির শিরা উপশিরায় একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়, রক্তের মধ্যে হিংসার একটা তীব্র স্রোত বয়ে যায়। রাত আড়াইটার ঘন অন্ধকারটা এতক্ষণে চোখে সয়ে আসছে ওর, মনি শাওনের রুমের দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই পুকুর পাড়ে জ্বলতে থাকা হ্যালোজেন বাল্বের আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়ে অন্ধকার রুমের বিছানায়। ঘুমন্ত শাওনের মুখের ভিতর সে আলোকের শীর্ণধারা প্রবাহিত হয়। মুখের অবয়বটা অস্পষ্টভাবে ধরা দেয় মনির কাছে। ছ্যাত করে বুকের ভিতরটায়, মনে পড়ে বাপমরা শাওনের মায়ের মলিন মুখটা। প্রায়ই স্কুলে যাবার সময় শাওনের বাসা হয়ে যাওয়ার বেলায় মনিকেও হাতে তুলে খায়িয়ে দিত ওর মা, শাওনের প্লেট থেকেই। একটা সময় অনুভব করে শাওনের মায়ের হাতের খাওয়া তার গলার মধ্যে আটকে যাচ্ছে, তবুও সে যেন পরম মমতায় ওকে ভাঁজা ইলিশের কাটা বেছে একটু হলুদ তেলে মাখানো ভাতের দলাটা ওর মুখে পুরে দিচ্ছে। ওর গলা দিয়ে নামতে চাইছে না!
নাহ ! এখানে শাওনের মা নেই, তার পরম মমতায় বুলানো হাত নাই, নেই প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া ভাতের থালায় নিঃশেষিত মাছের পেটি থেকে বেরিয়ে থাকা কাটা। সামনে শুয়ে আছে শাওন, সম্পাদক। কথাটা মনে হতেই আরেকটা স্রোত এসে ধাক্কা দেয় ওর শরীরে, মুঠোর মধ্যে চাপাতির হাতলটা আরো দৃঢ় হয়।
দরজায় আচানক ধাক্কার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শাওনের, পরিস্থিতির কিছুই বুঝতে পারে না সে, ঘুম জড়ানো চোখে মনে হয় দুঃস্বপ্ন্বের ভিতর তাড়া করছে কিছু, কিংবা রাতের কড়া মদের রেশটা লেগে আছে,একটু উঠে পানি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে সব। মনে পড়ে খুব ব্যাস্ততার ভিতর আজ কথা বলা হয় নি বৃষ্টির সাথে। কয়টা বাজে এখন, ফোন দিব নাকি? ঘুম জড়ানো চোখের ঝাপসা ভাবটা সেকেন্ডের মধ্যেই পরিষ্কার হতেই ক্ষীণ আলোয় একটা কিছুর ঝলকানি দেখতে পায়, বিদ্যুৎ খেলে যায় মাথার মধ্যে, সেকেন্ডের ক্ষুদ্রতম সময়ে বুঝতে পারে স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। মনে পড়ে আজকের মিটিং এর কথা, কত দিনের লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে , সেই হলে এসে বুঝবার পর থেকে লালিত। অনেক লাল নীল নকশা কেটে, অনেক পরিকল্পনা করে, অনেক বড় ভাইয়ের সাথে গোপন বৈঠক করে, তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দীকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আকাংক্ষা পূরণ করেছে সে।
মাদারচোদ! গলাটা চিনতে পারে শাওন, মনির । মাথার ঘোর কাটতে থাকে, গলাটা শুকিয়ে আসে, সিগারেট আর ঘুমের তেতো লালায় ভিজানোর চেষ্টা করে, সব ফাঁকা লাগে, মনে পড়ে একই শব্দটা মনি উচ্চারণ করেছিল ওকে বৃষ্টির কথা জানানোর পর, কী আহ্লাদ আর ভালবাসায় সিক্ত ছিল। আজকের রাতে সেই একই শব্দ ওর সমস্ত পৃথিবীটাকে শূন্য করে দিচ্ছে। বাইরে প্রচণ্ড চিৎকার, আর্তনাদ আর উল্লাস। বুঝতে বাকি রয় না কী ঘটছে। কামাল ভাই এর সাবধান বাণীটা মনে পড়ে যায়। পাত্তা দেয় নি, একটা পরম পাওয়া, একটা বিজয়ের উল্লাস ভিতরে আন্দোলিত করেছিল। বিছানার নিচে রাখা একটা চকচকে, খুব হাল্কা কিন্তু ভীষণ কাজের চাপাতির কথা মনে পড়েছিল। হাসির একটা রেখা ঠোঁটের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে খেলেছিল।
নিজেকে অনেক শান্ত করে, বিন্দুমাত্র গলাটাকে না কাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ছোটবেলার বন্ধুত্বের সমস্ত আবেগকে পুঞ্জীভূত করে ডাক দেয়, মনি!
মনি উত্তর দেয় না, শুধু একটা ক্রোধ দুটো শব্দ উগড়ে দেয়, সম্পাদক হইছোস? নোমান পিঠে সজোরে ধাক্কা দেয়, পিরীত করতে আইছোস খানকির পোলা ! যখন তোর পোস্টটা লইয়া লইলো তখন পিরীত কই ছিল, তোর চেয়ে বেশি প্রোগ্রাম ও করছিল এই হলে? ইতঃপূর্বে আঘাত হানা ক্রোধের স্রোতটা পূনর্বার তীরভাঙ্গা ঢেউয়ের মত আঘাত হানে। শক্ত হওয়া মুঠিটা নিচে নেমে আসে শাওনের জামাহীন খালি বুকটায়, যৌবনের গড়তে থাকা পেশী ভেদ করে গাঢ় লাল একটা রেখা অংকন করে। মনে পড়ে স্কুলে থাকতে শাওন ওর লাল কলম দিয়ে মনির নতুন শাদা শার্টটায় একবার অনেক বড় দাগ দিয়েছিল, আজকে যেন তার একটা উপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়া গেল। গাঢ় অংকিত রেখা থেকে ছলকে উঠে উষ্ণ রক্তের প্রস্রবণ, মনির মুখে লাগে, ঠোঁটে লাগে, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটটা জিব দিয়ে ভেজানোর জন্য চাটতে গেলে উষ্ণ নোনতা অনুভূতিটা জিবের ভিতর সঞ্চারিত হয়, শরীরের ভিতর একটা ঝাকুনি খায়, মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে একটাই শব্দ- সম্পাদক, সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক। যতবার শব্দটা মাথায় আঘাত করেছে ততবার চাপাতিটা নেমে এসেছে আক্রোশে, বজ্রের মত। ছিন্ন বিছিন্ন করে গেছে শাওনের বুক, গলা, ওর মায়ের প্রিয় কালো মুখ, বৃষ্টির প্রিয় ঠোঁট, চোখ, চোখের মনি।
প্রথম আঘাতটায় শাওন ছিটকে পরে ওর বালিশের কাছে। খুব মনে পড়ে ওর মায়ের মুখ, মায়ের ভেজা চোখ। বাবার অভাব, নিদারুণ দারিদ্রকে কোনরকমে অতিক্রম করে পড়তে পাঠায় ঢাকায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পর প্রথম আসবার দিনর ওর মায়ের ভেজা চোখে সহস্র কথার স্রোত বয়ে গেছে, কয়েকটা সমুদ্র যেন ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, মা শুধু ওর নরম চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে গালে একটা চুমু একে বলেছিল, ভালো থাকিস, আমার কথা ভাবিস না। বুকের ভিতরটায় দুমড়ে মুচড়ে সব ভেঙে যাচ্ছে। চাপাতির আঘাতের চেয়েও যেন আরো বেশি কী একটা আঘাত করছে। খুব কথা বলতে ইচ্ছা হয় মায়ের সাথে। আজ রাতেও দশটার দিকে মিটিং এর ফাকে মায়ের সাথে কথা হয়েছে ওর। মাকে বলেছিল খুব পাবদা মাছের ঝোল আর গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে মা, মা হেসেছিল , বলেছিল, আয় খাওয়াবো নি।
প্রথম আঘাতের পর সেকেন্ড বিরতীতে ওর ভিতর হাজার বছর বয়ে যায়, মায়ের কথা গুলো কানে ভাসে, নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় বালিশের কোণায় রাখা মোবাইল ফোনটায়, অনেকবার ভুলে পকেট থেকে কল চলে যাবার পর ও মোবাইল লক করে রাখে না, কে জানে কী ভেবে! আঙ্গুল হাতড়ে খুঁজে বেড়াতে থাকে বোতামগুলো, কোনটায় চাপ লাগে, কোনটায় লাগে না। দ্বিতীয় আঘাত আসে, তৃতীয় আঘাত আসে এবং আরো। সব শুন্য হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির মুখটা এক ঝলক মনে পড়ে, শান্ত, নিবিড় মুখ, নবীণ বরনে পরে আসা গাঢ় নীল শাড়িটা, ও বলেছিল তোমাকে রাধিকার মত লাগছে, বৃষ্টি জলের ধারার মত হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর বিছানা, তোষক , বালিশ, যে ছারপোকাদের এতদিন কত কষ্ট করে সুযোগ খুঁজে রক্তের সন্ধান করতে হত তারা আজ রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। কয়েকবার রক্ত দিয়েছে ও, তেমন অনুভূতি হচ্ছিল প্রথমটায়, আস্তে আস্তে সব ফাঁকা হয়ে আসে, মায়ের কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়ছে যেন, মা মাথায় আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছে। এক সময় রোদ্দুরে ঘুড়ে বেড়ানো জ্বলজ্বলে শাওনের চোখের মনিটা ক্রমশই নিভে আসে, লীন হয়।



উন্মত্ত ক্রোধ আর একটা বিজয় মনিকে দরজার বাইরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, যাবার সময় শাওনের টেবিলের ঊপর রাখা মদের বোতলে চোখ আটকে যায়। বাইরের চিৎকার, আকাশ ভেদ করা হর্ষধ্বনি, গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। ও বোতলটায় হাত দেয়। মনে পড়ে যায় ওরা দুজনেই জীবনের প্রথম মদ একসাথে খেয়েছিল। হলে উঠাবার পর, এক রাজনৈতিক আড্ডায়, হলের ছাদে। কী উথাল পাথাল ঢেউ বয়ে গিয়েছিল সেদিন দুজনের ভিতর। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সামান্য খাওয়া বোতলটার মুখ খুলতে খুলতে বেড়িয়ে যায়। নোমান আরো আগেই বেড়িয়েছে, অনেক মুরগি বাকি। হাত পিছলে যাচ্ছে রক্তে, চেষ্টা থামায় না, বুকের ভিতর আগুনটাকে আরো একটু চেতিয়ে দিতে খুব প্রয়োজন ভিতরকাত স্বচ্ছ জলের ধারা। ঝাপাঝাপি, দৌড়াদৌড়ি , কাকে যেন উপরতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। একটা হৃদয়বিদারক শব্দ করে থেমে গেল নিচের কংক্রিটে। হাঁটতে থাকে রুম এগারশো দশের দিকে, আরো অনেকগুলা কুত্তার বাচ্চা বাকি, এই তিনটা রুমের দায়িত্ব ওর আর নোমানের। দুটো চাপাতি, সমস্যা হলে একটা বিচি ভর্তি রিভলবার।
অবশেষে খুলতে পারে বোতলের মুখ, হাঁটতে হাঁটতে গলায় ঢেলে দেয়, ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত নির্জলা তরলটা পুড়ে পুড়ে নামতে থাকে।
পিঠের মেরুদণ্ড ভেদ করে বুকের দিক দিয়ে কিছু একটা বেড়িয়ে যায়, বুঝতেই পারে না আগুনের ফুলকির মত বত্রিশ ক্যালিবারের একটা গুলি ওকে ভেদ করে ক্লান্ত হয়ে সামনে করিডোরে আছড়ে পড়েছে।মদের বোতলটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে মনিও। ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখের সামনে ভীড় করে কত মুখ। শেষ মুহূর্তে একাই আসে শাওনের মুখ। কানে বাজে একটা চেনা ডাক, দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, মনি। কী হত আজ হল কমিটিটা না ঘোষণা করলে!!



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের বাসায় প্রতিরাতের মত আজও জমজমাট জলীয় আড্ডা। বিদেশি পানীয়। প্রোক্টর ড. জুলহাস খান এ বয়সে নাকি খুব বেশি গিলতে পারেন না, আজ তার সঙ্গী বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির উচ্চ পদস্থ ছাত্র নেতারা, নির্দ্বিধায় সরকারী দলের। বেসরকারী ছাত্র নেতাদের সাথেও তার পানাসর হয়, তবে সেটা গোপনে। রাত আড়াইটার একটু পরে তার মোবাইল ফোনে অদ্ভুত সাংকেতিক চিহ্ন সম্বলিত নামের কল আসে। শহীদুল্লাহ হলে নিযুক্ত তার টিকটিকির । জড়ানো গলায় বলে কী হইছে, এত রাতে ফোন দিছোস কেন? একটু শান্তি কইরা কি মালটাও খাইতে দিবি না? অপর প্রান্ত থেকে গলা ভেসে আসে স্যার শহীদুল্লায় আজকে কমিটি দিছিল, শেষ করার আগেই প্রোক্টর উত্তর দেয়, তো কী বাল হইছে? স্যার দুই গ্রুপ মারামারি লাগছে, গুলিও হইতাছে, মনে হয় অনেক গুলা পইড়া যাইবো।
হউক, শেষ হইতে কতক্ষণ লাগবো?
আমি ফযরের নামায পইড়া আসব নি। পুলিশ ঢুকতে দিস না, খামোখা ঝামেলায় পড়মু। ফোন লাইন কেটে যায়। প্রোক্টর হাতের বোতলের অবশিষ্টাংশ গলায় ঢেলে দেয়, পুরোটা যায় না, তার অতি যত্নে লালিত সুন্নতি কায়দায় রাখা দাড়ি গড়িয়ে কিছু পড়ে। বিড়বিড় কড়ে কী যেন বলতে থাকে। মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকা কয়েক ছাত্র নেতা খুশিতে বিগলিত হয়, আত্মহারা হয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে প্রোক্টরের পা চাটতে শুরু করে। প্রোক্টর আহ্লাদিত হয়, নেশা বেড়ে চলে ।

শহীদুল্লাহ হলের বাইরে চাঁনখারপুল মোড়ের আগে পেট্রোল পাম্পের কাছে রাখা পুলেশের গাড়ির দায়িত্ব প্রাপ্ত এস. আই ফিরোজ হলের ভিতরকার প্রচণ্ড শব্দ আর গোলাগুলিতে আঁচ করে নেয় ভিতরে কী হচ্ছে! একটা বেনসন সিগারেট ধরায়, ঝিমুতে থাকা চালককে উদ্দেশ্য করে বলে গাড়িটা মেডিকেলের দিকে নিয়ে রাখ, ভোরের দিকে এদিকটায় আনিস, মনে হয় অনেক লাশ তুলতে হইবো।



শাওনের মায়ের বালিশটা হঠাত মোবাইল ফোনের কম্পনে কেঁপে উঠে। ঘুম ভেঙে যায় আজীবন সতর্ক এই নারীর। ভিতরে ঘচ করে উঠে, এত রাতে! আচানক ঘুম ভাঙ্গা চোখে খুব ভাল করে খেয়াল করে, ইংরেজি পড়তে না জানলেও প্রতিদিনকার চেনা শাওনের নামটা বুঝতে পারে।তাড়াতাড়ি রিসিভ বাটন চেপে কানের কাছে নিয়ে যায়। শাওনের সেই আদরের গলায় মা বলে অদ্ভুত শব্দটা শুনতে পায় না। একটা অস্পষ্ট গোঙানি শোনে, আর খুব ক্ষীণ ভাবে চিৎকার হইচই শোনে, হঠাত একটা গুলির শব্দ শোনে অনেক জোরে, যেটা শাওনের রুমের সামনে মনিকে ভেদ করে যায়। বুকের ভিতর একটা ঝড় ভেঙে চুড়ে খান খান করে দিচ্ছে সবকিছু। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আসে কানে ফোনটা লাগিয়ে। হঠাত মনে হয় লীন হয়ে আসা গোঙানিটা শাওনের। বুকের ভিতরটায় অসমাপ্ত ঝড়ের বেগটা কয়েকশ গুন বেড়ে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, গলার ভিতর দলা পাকায় কী একটা, সব কিছু অবশ হয়ে আসে, শাওনের গলাটা শুধু মনে পড়ে, পাবদা মাছের ঝোল! আর কিছুই মনে করতে পারে না।



শহীদুল্লাহ হলের তিনটা বিল্ডিং রক্তে ভেসে গেছে, সমস্ত রুম থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। ফাঁকা লনটায় ক্যান্টিনের উপর থেকে জ্বলতে থাকা হ্যালজেন বৃষ্টিতে কয়েকটি লাশ ভিজে যাচ্ছে। কেউ অস্ফুট গোঙানিতে কাতরাচ্ছে। এক্সটেনশন ওয়ানের তাজা রক্তের প্রবাহ গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে পুকুরের পানিতে। আজ বৈশাখের কড়কড়ে দুপুরে যে পানি জ্বলতে ছিল কাঁচের টুকরোর মত ।
ভোর হতে বেশি বাকি নেই, প্রচণ্ড শব্দে দিকভ্রান্ত পাখিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে, সব কোলাহল থেমে গেছে, অস্ফুট গোঙানি থেমে গেছে অনেক আগেই। সহস্র লাশ, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, এখন শুধুই লাশ। শহীদুল্লাহ'র পুকুরটা রক্তে ভেসে গেছে, জেলির মত থকথকে হয়ে জমে আছে।

সকালের দিকে মনির বাবা ফোন পায় শাহবাগ থানা থেকে। শহীদুল্লাহ'র জমাট বাঁধা রক্ত আবার ছল্কে উঠে ওর গ্রামের বাড়ি মধুপুরে, শিকড় ছড়ায় রক্ত, শাখা-প্রশাখা ছড়ায় রক্ত। বৈশাখের রুক্ষ মাটির ভিতর দিয়ে বাড়তে থাকে রক্তের লাল শিকড়, সারা দেশ ছেয়ে যায় রক্তের শিকড়ে, গাঢ় লাল কালির মত রক্ত।


সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১১:৪৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×