কবিতা মানুষের মত, মাঝে মাঝে তার নিজের একটি রাষ্ট্র, একটি দেশের বাড়ী অথবা একটি ঋতু এমন নানান কিছুর প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন সে হয়ত নিজেকে গণ্য করে কোন বিশেষ গোত্রের একজন সদস্য হিসেবে অথবা কখনো কখনো নিজেই একটি গোত্র তৈরি করতে চায়, গোত্রের দলপতিও হতে চায় মাঝেসাঝে। একটি কবিতা অন্য একটি কবিতার সাথে কথা বলে; প্রতিবেশীর মত দুঃখ সুখ ভাগাভাগি করে নেয়, প্রতিযোগীতা করে, ঈর্ষা করে, ভালোবাসে আবার একাও থাকে। এ সবকিছুর পরও কবিতা আসলে কথা বলতে চায়, অন্য মানুষের সাথে যেমন কবিতার সাথেও। প্রতিটি মানুষ আলাদা, অনন্য তার কবিতাও তেমনি আলাদা, অনন্য। কারো সাথে কারোটা মেলানো যায় না, আবার চাইলে মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। আমার ভাবতে ভাল লাগে যে হয়ত একদিন সবাই নিজের অনন্য কবিতাটি লিখবেন, অথবা অন্যকে জানাবেন। কথা বলতে শুরু করবেন।
আমি কথা বলতে শুরু করি উনিশ বছর বয়স থেকে, এর আগেও আমি কবিতা লিখেছিলাম কিন্তু কথা বলতে পেরেছিলাম বলে আত্মবিশ্বাস জাগেনি। ‘নিরক্ষরতার কবিতা’ লিখতে যেয়ে প্রথমবার মনে হয়েছিল আমি হয়ত কথা বলতে শুরু করেছি। কবিতাটি দীর্ঘ, কথা বলার জন্য আমার দীর্ঘ কবিতার দরকার হয়েছিল। তবে সবসময় আমার দীর্ঘ কবিতার প্রয়োজন হয়নি।
কবিতায় কথা বলার বিশেষ একটা ধরন রয়েছে, যেটাকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি বলে অনুমান করি। কবি, পাঠক, সমালোচক যেটাকে কাব্যময়তা বলেন, পরিশেষে অনুভূতিই যেটার বিচারক। মানুষের ভালোবাসার যেমন বিচার করা সম্ভব হয় না তারপরও আমরা যেমন সেটার বিচার করি। তেমনি কবিতারও বিচার হয়, মানুষের মতই। সময়ের সাথে সাথে আইন আর বিচার পাল্টায় কেউ শাস্তি পান, কেউ সম্মানিত হন। কবিতা উত্তীর্ণ হয়, কবিতা বাতিল হয়ে যায়। কেউ কেউ ভাষাকে, কাব্যময়তাকে, ব্যাকরণকে আমূল পাল্টে দেন আর আমরা নতুন একটি বিশ্বে প্রবেশ করি। নতুন বিশ্বের আনন্দ, উত্তেজনা, ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে মেতে উঠি।
আবার একই ঘরে থাকতে থাকতে আমাদের কান্তি আসে, আমরা পরস্পরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেই। তখন আর আলাপ গল্পগুলো জমে ওঠে না, আমরা অনুসন্ধান বন্ধ করে দেই। পরিশ্রমী শ্রমিকের খুঁজে পাওয়া খনিতেই বারবার যাই, তাকে উপাসনা করি। অনুসন্ধানহীন থাকা মানুষের জন্য একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যদিও আমাদের অনেকেই এই পরিস্থিতিতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠি।
মানুষ যেহেতু কেবল কবিতা নিয়েই বসবাস করেনা সেহেতু নতুন উপলব্ধি নতুন বিশ্লেষণ কখনো কখনো কবিতার অস্তিত্ব, কবিতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই প্রশ্নগুলো আমার কাছে অন্য ধরণের গুরুত্ব বহন করে, কখনো কবিতার রসদ হয়ে ওঠে। আমি কবিতার সদা অস্তিত্বমানতায় বিশ্বাস করি। কবিতার বেঁচে থাকায় বিশ্বাস করি। বিশ্বাস, কল্পনার মত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, দুরূহ স্বপ্নকেও কবিতার অরে বন্দি করে। কবিতার সাথে কবিতার, শিল্পের সাথে শিল্পের, মানুষের সাথে মানুষের, কথা শুরু হয়।
প্রতিটি নতুন কবিতা লিখতে যেয়ে আমার একই সাথে দুটো অনুভূতি হয়। প্রথমটি হল, মনে হয় যেন জীবনে প্রথমবার কবিতা লিখছি, দ্বিতীয়টি হল আর কোনদিনই আমাকে দিয়ে কবিতা লেখা সম্ভব হবে না। এভাবেই আমি লিখি, পরস্পর বিরোধী উপলব্ধি নিয়ে।
পুরো একটা দশকের কবিতাকে মিলিয়ে কবিতার নিজস্ব কোন মাতৃভূমি তৈরি নাও হতে পারে। তবে কবিতার পড়তে পড়তে জমতে থাকা অরসমূহ ভরা জোয়ারেও চর তৈরির ইঙ্গিত দেয়। সেই অর্থে এই বই আমার কবিতা সমূহের সংকলনও বটে। কবিতা সমূহের বিন্যাস ও ধারাবাহিকতায় এই অভিযাত্রার ছাপ থাকবে বলে প্রত্যাশা করি।
পরিশেষে বইয়ের সমস্ত কবিতা কথা বলতে চাওয়ার পুরোনো আকাঙ্খার প্রকাশ। আশা করছি এই অভিযাত্রায় কবিতার মিথষ্ক্রীয়া জমে উঠবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১:৫৩