ইডেন কলেজ নিয়ে কিছুদিন হলো অনেক সমালোচনা হচ্ছে তাই কথাগুলো বলার কিছুটা সাহস পেলাম।সেজন্যই লিখছি। আমি খুবই সাধারণ একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। দক্ষিণাঞ্চলের একটা জেলা থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করে ইডেনে ভর্তির সুযোগ পাই। অনেক খুশি ছিলাম দেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়বো বলে। দর্শন বিভাগে ভর্তি হই। হলে সিট পাই কয়েকমাস পর একজন বড় আপুর মাধ্যমে। লিগ্যালভাবে আবেদন করেছিলাম কিন্তু সিট খালি নেই বলেছিল ম্যাডাম।
তারপর বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে উঠলাম ফাইনালি। প্রথম দিকে ফ্লোরে থাকতে হত। এডজাস্ট করতে অনেক কষ্ট হত। আস্তে আস্তে মানিয়ে নিলাম। তারপর সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম। তখন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাছলিমা আপু ছিল। আর বর্তমান সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ছিল যুগ্ম আহ্বায়ক। মোট ১৪ জন ছিল যুগ্ম আহ্বায়ক। তো মাঝে মাঝে লক্ষ্য করতাম আমার রুমের অন্যান্য মেয়েরা খুব চুপচাপ থাকে, কথাও কম বলে। কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলে শরীরটা ভালো না বা মেয়েদের পিরিয়ড হলে যা হয় তাই। তো আমিও আর এতটা গুরুত্ব দেই নি। এরপর একদিন দুপুরে তাছলিমা আপু ডেকে পাঠালো।
গিয়ে কথা বললাম কিছুক্ষণ। তো আপু বললো যে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক সহ একটা মিটিং আছে কাল বিকালে। আমরা কয়েকজন যাবো। তুমিও সাথে যাবে। আমি ইচ্ছা না থাকলেও না করতে পারিনি হলে থাকি বলে। পরেরদিন আমি সহ মাত্র ৩ জন মিলে আপু একটা ৬ তলা ফ্ল্যাট বাসায় গেলাম। আমি একটু অবাক হই এখানে আবার কিসের মিটিং। ওখানে যাওয়ার পরে ছাত্রলীগের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা আর আমার সাথে আসা বাকি দুইজন একটু বাহিরে গেল। আমি বসে ফোন বের করে দেখছিলাম। তখন ভিতর থেকে একজন আসে। বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ হবে। আমার মাথায় পি-স্ত-ল ধরে আমাকে বলে ভিতরে চল।
জোরপূর্বক আমাকে একটা রুমের ভিতর নিয়ে যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে আমার সাথে অমানবিক কাজ করে। আমাকে বলা হয় তুমি আজকে প্রথম না। তোমার মত অনেকেই এখানে আসে আবার চলেও যায়। আমাকে আরো হুমকি দেয় কোথাও যদি এই ঘটনা নিয়ে কিছু বলি তাহলে আমাকে গু-ম করে দিবে। আরো ভয় পাই যখন বলে তোমার সাথে যা হয়েছে সব ভিডিও রেকর্ড করা আছে। এই বলে ল্যাপটপ থেকে আগে হলের অন্যান্য রুমের কয়েকজন মেয়ের সাথে ফিজিকাল করার ভিডিও টেনে টেনে দেখায়। আরো বলে তুমি চুপ থাকলে আমিও চুপ থাকবো। ভিডিও নিয়ে কোনো চিন্তা করিও না। আমার সাথে যা হয়েছে সেটার ভিডিও দেখায় নি। তারপর অনেকদিন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম।
একটা ট্রমার ভিতর ছিলাম। হলে থাকতাম ঠিকই কিন্তু নিজেকে খুব ছোট মনে হত। ভয়ে রাতে ঘুম ভেংগে যেত। কত রাত ঘুমাতে পারি নি নিজেও জানি না।
আমিও তো সাধারণ শিক্ষার্থী ছিলাম। আমার কি দোষ ছিল বলতে পারেন? হলের কিছু মেয়েরা সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে দেখলাম মানববন্ধন করেছে ইডেনের সামনে দুইদিন আগে। তারাও জানে ইডেনের হলে থাকা মেয়েদের সাথে কি হয়, কিন্তু কোনো মেয়েই স্বীকার করবে না এসব। আজ যদি আমি থাকতাম সেখানে আমিও হয়ত বলতাম আমি ৪ বছর হলে থেকেছি কিন্তু কখনো মেয়েদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো হয় শুনি নাই। কোনো মেয়ে কখনোই মিডিয়ার সামনে এসে তার সাথে কি ঘটেছে এগুলো পাবলিকলি বলবে না। আমার সাথে যা ঘটেছে সেটা কোনোদিন কাউকে বলার সাহস হয়নি।
একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় বিষয় তার সম্ভ্রম। আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে। দুটো বাচ্চাও আছে। শ্বশুর বাড়িতে ভালোই আছি। কিন্তু আমার সাথে ঘটা অতীতের এই কালো দাগ কখনোই মুছবে না। অনার্স শেষ করে মাস্টার্স আর ইডেনে করি নি। একই ভুল দ্বিতীয়বার কেনো করবো বলেন?
অনেকেই বলবে প্রতিবাদ করা উচিত, কিংবা আমি কেনো বিচার চাই নি, থানায় যাই নি। একবারও কি ভেবে দেখেছেন যদি থানায় যেতাম, বিচার চাইতাম তাহলে আমাকে কি কেউ বিয়ে করতো? আমার পরিচয় সবাই জেনে যেত তাহলে। এই ইডেন থেকেই অনেক মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জন্য পিছনে ফেলে আসা কালো অতীত কেউ জানতে পারে না কখনোই।
অনেক সময় নিয়ে লিখলাম। আমি চাই না আর কোনো মেয়ের সাথে এমনটা ঘটুক। আমার বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়স্বজন বা কেউ যেন না বোঝে তাই কিছু বিষয় গোপন রেখেছি। ছদ্মনাম ব্যবহার করছি আর আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট গোপন রেখেছি। আমার নিরাপত্তা কেউ দিতে পারবে না। তাই আর কোনো তথ্য দিচ্ছি না। আমার বর্তমান স্বামী বিয়ের আগে আমার প্রেমিক ছিল। আমার এই ঘটনার কথা তাকে কোনোদিন বলতে পারি নি। কখনো বলবোও না। যদি সে জানতে পারে তাহলে আমার আ/ত্ম/হ/ত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না। আজ চার বছর পর এই ঘটনা আপনাদের কাছে বলতে পেরে কিছুটা হালকা লাগছে। ভালো থাকুক ইডেন।
- জান্নাতুল ফেরদৌস নিশি (ছদ্মনাম)
দর্শন বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ
(ঘটনা সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের উপায় নেই, কিন্তু এরকম ভুক্তভোগী আছে নিশ্চিত, নাহলে তাদের নিজেদের সদস্যরা ই অভিযোগ করত না। ভাবা যায়? এই চিত্র শুধুমাত্র ইডেনের না , অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও হয়, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। এটা যদি অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে থাকে তাহলে মেয়েকে/বোনকে এসব প্রতিষ্ঠানে দেয়ার আগে আরেকটি বার ভাববেন)
@ফেসবুক
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২২ রাত ১১:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




