সেই রাত্রির দমকা ঝড়ে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া বা গোলাপের মতো রক্তলাল কোটি কোটি শব্দ দিয়ে মালা গেঁথে শ্রদ্ধা জানিয়ে বকুল গাছটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেমন আছো গো?'
সে কোন উত্তর করল না।
বাড়ির সামনের ফুটপাথে শুয়ে থাকা নেড়ে কুত্তাটির কাছে জানতে চাইলাম, 'ক্যামন কাটছে ভায়া দিনকাল?'
সেও কোন উত্তর করল না।
একটা শ্যেন দৃষ্টি হেনে জানিয়ে দিল, 'আমি মানুষকে ঘৃণা করি।'
এই না বলা কথাটি জানান দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। সামনে সৈন্যদের পাল, রাইফেল পাশে রেখে বিশ্রাম করছে। তাদের আর কোন কাজ নেই, বুলেটও ফুরিয়ে গেছে। বুলেটের লাল ধোঁয়ায় রাইফেলের নলের ভেতরটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এগুলো পরিষ্কার করে মলখানায় জমা দিতে হবে। একটু পরই কর্নেল বাঁশি বাজাবেন-
'কোম্পানি লাইনে দাঁড়াও'
'কোম্পানি ডিশমিশ'
তারপর সৈন্যরা বুটের টকটক শব্দ করে চলে যাবে।
এখানে কেউ কোন কথা বলে না
এখানে পাখিদের কিচিরমিচির নেই
কেবল ইঁদুরের মতো গর্ত থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে ৩২ নম্বরের বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে কেউ কেউ। পরক্ষণেই আবার দ্রম্নত স্থান ত্যাগ করছে।
তবে একজন একেবারে আলাদা কোথাও যায়নি ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষকে ডেকে ডেকে কবিতা শোনাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের মতো সাদা লম্বা চুল, দাড়ি, মোটা গোপ, হাঁটুর নিচ পর্যনত্ম ঝোলানো জোব্বা, দরবেশ মার্কা এবং রবীন্দ্রনাথের মতই তীক্ষ্ম ভাসা ভাসা দুটি চোখ। ইশারায় কাছে ডেকে একটা চিরকুট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। যাবার সময় কানে কানে বলে গেলেন, 'আমার নাম নির্মলেন্দু গূণ, আমি করি না মানুষ খুন।'
বুলেট বিদ্ধ এবং লাল রক্তে লেখা_ 'সেই রাত্রির কল্পকাহিনী'
"তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,
তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতে মেহেদি রঙ,
...........................................
"তারপর গেছেন তোমার বাল্য বিবাহিত পত্নী,
আমাদের নির্যাতিতা মা।
........................................
"তুমি হাত উঁচু করে দাঁড়ালে, বুক প্রসারিত করে কী আশ্চর্য
আহ্বান জানালেন আমাদের। আর আমরা তখন?
আমরা তখন রম্নটিন মাফিক ট্রিগার টিপলাম।
তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করে হাজার পাখির ঝাঁক
পাখা মেলে উড়ে গেল বেহেশতের দিক
.......... তারপর ডেভস্টপ।"
কল্পকাহিনীর এখানেই সমাপ্তি।
যে বকুল গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে হাজারও লাখো মানুষ দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে তুলনাহীন ৭ মার্চের মহাকাব্যের কবি মুখে কবিতা শুনতে তাদের কেউ আজ আর এখানে আসেনি। কেবল বকুল গাছটি 'কাহারও বিরম্নদ্ধে কোন অভিযোগ না তুলিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।' তার অপেক্ষা, একদিন ফিরে আসবেনই কবি। ঘোষণা করবেন-
'স্বাধীনতা এনেছি
স্বাধীনতা রাখব'
সে নাম শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী 'বঙ্গবন্ধু' 'জাতির জনক' বাংলার কৃষক-শ্রমিক মানুষের 'শেখের বেটা' মধ্যবিত্তের 'শেখ সাব' 'মুজিব ভাই।'
এই মানুষটিকেই হত্যা করেছে একদল হায়েনা সৈনিক এই আগস্ট মাসেই। ১৫ তাং রাতে।
তারপর একে একে হত্যা করল তার পত্নী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনি্নসা মুজিবকে।
হত্যা করল শেখ রাসেলকে, জাতির জনকের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মাত্র ৯ বছর বয়স, হাতে থাকত ক্রিকেট ব্যাট।
হত্যা করল শেখ কামালকে, জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ পুত্র যে একাধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সংগঠক তথা আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ছাত্র-যুব নেতা।
হত্যা করল শেখ কামালের নব পরিণিতা বধূ সুলতানা কামালকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ও আনত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রীড়াবিদ, মাত্র একমাস আগে বিয়ে হয়েছিল, যার হাতের মেহেদির রঙ তখনও মুছে যায়নি।
হত্যা করল শেখ জামালকে, জাতির জনকের মেঝো পুত্র, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ আর্মির কমিশনপ্রাপ্ত তরম্নণ অফিসার, ইংল্যান্ডের স্যান্ডহাস্ট থেকেও উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত।
হত্যা করল শেখ জামালের নবপরিণিতা বধূ রোজী জামালকে, সপ্তাহখানেক আগে যার বিয়ে হয়েছিল এবং তখনও মেহেদির রঙ জলজল করছিল।
হত্যা করল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ নাসেরকে। খুলনা থাকতেন, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতেন, ভাই-ভাবীর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।
হত্যা করল কর্নেল জামিলকে, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার।
হত্যা করল বাড়ির প্রিয় কাজের ছেলেটিকে।
হত্যা করল (অন্য বাড়িতে) শেখ ফজলুল হক মণিকে, (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে) মেধাবী ছাত্র ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা, লেখক, সাংবাদিক এবং তৎকালীন দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক।
হত্যা করল শেখ ফজুলুল হক মণির অনত্মঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে (তিনিও বঙ্গবন্ধুর ভাগি্ন ছিলেন)।
হত্যা করল (অন্য বাড়িতে) আবদুর রব সেরানিয়াবাতকে, (বঙ্গবন্ধুর ভগি্নপতি) মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য, তার চেয়েও অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন কৃষক নেতা হিসেবে।
সে রাতে হত্যা করা হয় সুকানত্ম বাবুকে, আবদুর রব সেরানিয়াবাতের নাতি ও আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর পুত্র, বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর।
এ বাড়িতে সে রাতে আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়।
সেই একই হায়েনা সৈনিকের দল যারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর অত্যনত্ম ঘনিষ্ঠ সহকর্মী যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরম্নজ্জামানকে।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তার অল্প ক'দিন আগে শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত অণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার (মরহুম) সঙ্গে জার্মানী গিয়েছিলেন বলে আলস্নাহর রহমতে বেঁচে যান। ড. ওয়াজেদ তখন সেখানে পোস্ট ডক্টরাল করছিলেন।
ইতিহাসের এই নজিরবিহীন জঘন্য হত্যাকা- ঘটিয়ে হায়েনার দল ভেবেছিল '৭১-এর প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক মিথ্যাচার হয়েছে গত ৩৫ বছর ধরে, এখনও হচ্ছে। বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তরকালে 'গণবিচ্ছিন্ন' হয়ে পড়েছিলেন, যার জন্য ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর জানাজা পর্যনত্ম হয়নি। কিন্তু তারা ভালভাবেই জানে যে হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুর মরদেহের কাছে কাউকেও যেতে দেয়নি এবং টুঙ্গিপাড়ার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেছিল। হায়েনার দল জানত বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ঢাকায় দাফন করা হলে একদিন ওই মাজারকে কেন্দ্র করেই গণবিপস্নব হবে এবং প্রতিবিপস্নবীদের কবর রচনা হবে। তাদের একাংশের কবর ইতোমধ্যেই রচনা হয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুর সাথে জিয়ার তুলনা করেও বলেছে যে, জিয়ার জানাজায় লোক হয়েছে। অথচ তারাও জানে, জিয়ার হত্যার পর ক্ষমতায় ছিল তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারসহ জিয়ার দল। তারপরও কথা থাকে, জিয়া হত্যার পরদিন ক্ষমতা কার হাতে যাবে বা পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, যতক্ষণ না ঠিক হয়েছে ততক্ষণ জনগণ তো দূরের কথা বিএনপির নেতা-পাতি নেতারা কেউ ঘর থেকে বেরোয়নি, হত্যার প্রতিবাদও করেনি। যখন দেখা গেল ক্ষমতা তাদের হাতেই তখন গর্ত থেকে বেরোতে শুরম্ন করে, লাশও ঢাকা এনে জানাজা শেষে দাফন করা হয় পার্লামেন্ট ভবনের পাশে স্থপতি লুইকানেন স্থাপত্য নকশাকে বিকৃত করে। যদিও ওই কফিনে জিয়ার লাশ ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি।
বলা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর না-কি কোন প্রতিবাদ হয়নি। কেউ রাজপথে বেরোয়নি। এটা মিছা কথা। আমি প্রতিবাদ দেখেছি। সেদিন আওয়ামী লীগ তথা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী জনগণ ছিল সত্মম্ভিত, কি হয়ে গেল? কে দেবে ডাক, সবাই তো বন্দুকের নলের মুখে। কেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে কেউ বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি চালাতে পারে। পক্ষানত্মরে স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী ও পাকিসত্মানে বিশ্বাসী রাজাকারের দল ছিল আতঙ্কিত, এই বুঝি আওয়ামী লীগ রাসত্মায় নামল, আর বুঝি রক্ষে নেই, এই ছিল পরিস্থিতি।
বস্তুত যে কারখানা থেকে এই সব মিথ্যের বেসাতি করা হয় তার মালিক-কারিগর হলেন ম্যাডাম ও তার দল। নিজামী-মুজাহিদের দল তো বিসমিলস্নাহ বলেও মিথ্যে বলে। আমি যদি একটা প্রশ্ন করি, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর সহযোগী চার জাতীয় নেতা এবং পরবর্তী প্রজন্মের নেতা শেখ কামাল-শেখ মণিকে হত্যা করে কি আওয়ামী লীগকে মুছে ফেলতে পেরেছে? না সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভুলেছে? নইলে দুই নির্বাচনে কেন জনগণ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বানালেন অন্যান্য কর্মসূচীর সাথে সাথে জাতির পাপ মোচনের জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করার জন্য। বিগত নির্বাচনে তো একা আওয়ামী লীগকেই তিন-চতুর্থাংশ আসন দিয়েছে। আর কি কিছু বলার দরকার আছে? আমাদের প্রিয় পলস্নী কবি জসীম উদ্দীনের ভাষায় :
"মুজিবুর রহমান!
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগি্নউগারী বান।
বাংলাদেশের এ প্রানত্ম হতে সকল প্রানত্ম ছেয়ে
জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞ্জা-অশনী বেয়ে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



