বীর মুক্তিযোদ্ধা পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলার বদান্যতায় গত ২৩ জুলাই এক ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠান তথা শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সমাবেশে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অনুষ্ঠানস্থল সিলেট সিটি করপোরেশনের সভাকক্ষ। অনুষ্ঠানটির আয়োজক সানন্দা খেলাঘর আসর, তোপখানা সিলেট। সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিরাজ মাধব চক্রবর্তী, প্রধান অতিথি সিলেটের জননন্দিত মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জহির চৌধুরী সুফিয়ান, বীর মুক্তিযোদ্ধা পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মন রানা, অরূপ শ্যাম বাফফা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানকে ব্যতিক্রমধর্মী বললাম এ কারণে যে, এখানে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যাই আলোচনা হোক না কেন এর ভেতরের আদর্শ-উদ্দেশ্য-বক্তব্য সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রমী। অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে সানন্দা খেলাঘর আসর তোপখানার এসএসসি ও এইচএসসির উত্তীর্ণ সব ছাত্রছাত্রীকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেয়া হয়। আমাদের সমাজে সাধারণত দেখা যায়, যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করে অর্থাৎ 'এ' প্লাস পায় তাদেরই আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন সংগঠন/সংস্থার মাধ্যমে সংবর্ধনা দেওয়ার রেওয়াজ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, এখানে অন্যরকম। সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আমার তো মনে হয়, তোপখানা এলাকায় এবার উল্লেখিত পরীক্ষাগুলোতে কেউই অকৃতকার্য হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেউ যদি ফেল করে থাকে তবে খেলাঘরের সদস্যরা তাদের বাসায় গিয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের সান্ত্বনা দিয়ে আগামী পরীক্ষার জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা একান্ত জরুরি। এবং আমার বিশ্বাস, খেলাঘরের সদস্যরা এমন কোন দুঃখজনক পরিস্থিতিতে তাই করবেন।
অনুষ্ঠানে বিজ্ঞ বক্তারা খেলাঘরের শিশু-কিশোরদের সামনে গতানুগতিক কোন বক্তব্য পেশ করে নিজেদের জ্ঞান প্রকাশে প্রয়াসী হননি। যে যা বলেছেন তা একান্তভাবেই অন্তরের তাগিদ থেকেই বলেছেন। বর্ষীয়ান এবং স্বচ্ছ ও চিন্তা-চেতনার অধিকারী রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেয় জহির চৌধুরী সুফিয়ান স্বল্প সময়ের ভাষণে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের সামনে খুবই সহজ-সরল-সুন্দর আকর্ষণীয় ভাষায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেন। মনে হয়েছে, শিশু-কিশোররা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে।
জানতে পেরেছে, মুক্তিযুদ্ধের খানিকটা ইতিহাস। সিলেটের জননন্দিত মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বারবার উচ্চারণ করেছেন। এর ফলে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তিনি এ কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সহজ-সরল ভাষায় যুদ্ধাপরাধী কারা এবং কেন তারা যুদ্ধপরাধে অপরাধী, সহজ ভাষায় তিনি ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা পুরঞ্জয় চক্রবর্তী বাবলা চিন্তা-চেতনা-আদর্শে যদিও বাম ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী; কিন্তু তিনি তার বক্তব্যে দুটি বিষয়ে উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু' আর 'জয় বাংলা' সেস্নাগান কোন রাজনৈতিক দলের একক সম্পদ নয়। বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলা আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। জাতীয় সম্পদ। যদিও অনেকে মনে করেন 'জয় বাংলা' এবং 'বঙ্গবন্ধু' শুধু আওয়ামী লীগেরই। মুক্তিযোদ্ধা বাবলা উপস্থিত শিশু-কিশোরদের জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন, একাত্তরে এ দেশের দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দানে জয় বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলা উচ্চারণ করেই জীবনবাজি রেখে বর্বর পাকসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গুটিকয় বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দেশের আপামর জনগণও সুযোগ পেলেই জয় বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলা বলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতেন। মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মন রানা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন। সভাপতির ভাষণে শিক্ষাবিদ বিরাজ মাধব চক্রবর্তী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে আদর্শ শিক্ষার আলো জ্বালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, সার্টিফিকেট প্রাপ্তির শিক্ষাই যথাযর্থ শিক্ষা নয়।
ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনা দেওয়ার এ জাতীয় অনুষ্ঠানে সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের মেধার প্রশংসাই করা হয়ে থাকে। দেয়া হয়ে থাকে নানা উপদেশ। কিন্তু সানন্দা খেলাঘর আয়োজিত অনুষ্ঠানটি যেন একেবারেই অন্য রকম। অন্য এক আদলে গড়া। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পিনপতন নীরবতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা এবং জানানোর সুরের আবেশে আচ্ছন্ন ছিল পুরো অনুষ্ঠানটি। কোন প্রকার কৃত্রিমতা কাউকে স্পর্শ করতে পারেনি। যারা জানাতে এসেছেন তারা যেমন আন্তরিক তেমনি যারা জানতে এসেছে তাদের জানার গভীর আগ্রহও উপস্থিত সবার নজর কাড়ে। এ যেন জানা-জানানোর এক মেলবন্ধন। শেকড় সন্ধানী এক সাহসী প্রয়াস। এ প্রয়াসের প্রসার ঘটলেই আপন বলে বলীয়ান হয়ে উঠবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস।
অনুষ্ঠান শেষে সভাস্থল ত্যাগ করছি, এমন সময় অনুষ্ঠান আয়োজনে সদা ব্যস্ত ছিল যে তপতী সেই চঞ্চলা মেয়েটি পেছনে এসে দরদী কণ্ঠে আমাকে বলল, কাকু আমাদের অনুষ্ঠানে সব সময় আসবেন। একটু থমকে দাঁড়ালাম, মনে মনে ভাবলাম_ কখনো চিনি না জানি না, এবারই প্রথম দেখা। ও ওমন কথা হঠাৎ করে বলতে গেল কেন! ভেতরে ভেতরে আন্দাজ করে নিজেকে নিজেই বলতে বাধ্য হলাম_ না, সে তো ব্যক্তি 'আমার' উদ্দেশে এ কথা বলেনি। বলেছে এক মুক্তিযোদ্ধাকে। একান্ত আপন মনে তৃপ্তির হাসিটি হাসি আর নিজের অজান্তেই অতীতের মতো সাহসী হয়ে উঠলাম, কারণ নতুন প্রজন্ম আজ গভীর আগ্রহ ভরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। সে তো শুধুই গল্প নয়, সে গল্প যে জাতীয় চেতনায় শক্তি জোগায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



