
কুড়ি-একুশ বছরের এক মেয়ে প্রায় প্রতিদিন রাতে একটা স্বপ্ন দেখত— সমুদ্রতীরে কালো পাথরের এক মন্দিরের পেছনে একটা সিঁড়িতে সে বসে আছে আর সমুদ্রের ঢেউ এসে তার পা ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মা’কে এই স্বপ্নের কথা জানাতে মা বলেছিলেন— ‘ভগবান তোকে আশীর্বাদ করছেন, একদিন তুই অনেক বড় হবি’। মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল। কিছু দিনের মধ্যেই মেয়েটি অসংখ্য শ্রোতার নয়নের মণি হয়ে উঠল। তার গান ও নাম লোকের মুখে-মুখে ফিরতে লাগল। লতা মঙ্গেশকর। এই শিল্পীর চার সপ্তকব্যাপী কণ্ঠে সুরের অপরিমেয় দাক্ষিণ্য, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলির কথায়— ‘এ কখনই বেসুরো গাইতে পারবে না’। গলার নিখুঁত ‘পিচ’, স্পষ্ট উচ্চারণ, অনুভব আর সনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের সমবায়েই বুঝি তৈরি হতে পারে লতার মতো শিল্পী। আলোচ্য প্রথম গ্রন্থে সংগীত সমর্পিত প্রাণ জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পীর জীবন ও গানের নানা প্রসঙ্গ উঠে এল এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়। ১৯৯১ সালে লণ্ডনে একটি টিভি চ্যানেলের জন্য নাসরিন মুন্নি কবিরের তোলা ছ-ভাগে বিভক্ত একটি তথ্যচিত্র এ-গ্রন্থের উৎস। বইটিতে প্রশ্নকর্ত্রী নাসরিনই, উত্তরদাত্রী লতা। লতা আত্মজীবনী লিখতে চান না জানালেও এই গ্রন্থে নিজের জবানিতেই ধরা রইল তাঁর সংগীতময় জীবনের অনেকটাই। ‘এলাম দেখলাম আর জয় করলাম’— লতার জীবনটা মোটেও এ রকম নয়। পেছনে অনেক স্বেদ, রক্ত। গায়ক-অভিনেতা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের কন্যা হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই লতা গানের আবহে মানুষ, বাবার কাছেই প্রথম সংগীত-দীক্ষা।
কিন্তু অকস্মাৎ ১৯৪২-এ বাবার মৃত্যু লতাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল। তার আগেই অবশ্য ন’বছর বয়সে বাবার থিয়েটার কোম্পানির সঙ্গে কোলাপুরে গিয়ে প্রকাশ্যে প্রথম অনুষ্ঠান করেছেন, এগারো বছর বয়সে রেডিয়োতে গেয়েছেন বাবার সঙ্গে। বাবার প্রয়াণে ত্রয়োদশী লতা কিন্তু দমে যাননি, তাঁর জীবনসংগ্রামের সেই শুরু। বাড়িতে মা, তা ছাড়া ছোট তিন বোন, এক ভাই। তখন ছবিতে নেপথ্য-গানের তেমন সুযোগ না থাকায়, অভিনয় ভাল না লাগলেও লতা অভিনয় করতেই যোগ দিলেন প্রথমে ‘নবযুগ চিত্রপট’-এ, পরে ‘প্রফুল্ল পিকচার্স’-এ বিখ্যাত অভিনেতা-প্রযোজক মাস্টার বিনায়কের সূত্রে। ‘পহলি মঙ্গলাগাউর’, ‘গজাভাউ’ প্রভতি মরাঠি ছবিতে কাজ করলেন।
এই ‘গজাভাউ’ (১৯৪৪) ছবিতেই লতার প্রথম নেপথ্য হিন্দি গান ‘হিন্দুস্তান কে লোগো’। মাস্টার বিনায়কের সহায়তায় তালিম নিলেন উস্তাদ আমন আলি খান ভেনডিবাজারওয়ালে ও আমন আলি খান দেবসওয়াল-এর কাছে। ১৯৪৭-এ মাস্টার বিনায়কের মৃত্যুতে লতা আবার ধাক্কা খেলেন। ঘটনাচক্রে সংগীত পরিচালক হরিশচন্দ্র বালী আর গুলাম হায়দারের সঙ্গে পরিচয় হল। গুলাম হায়দারকে গান শোনাতে গিয়ে বেসুরো গেয়ে ফেলেছিলেন লতা— নিজেই জানাচ্ছেন। লতা-ও তা হলে বেসুরে গাইতে পারেন! গুলাম হায়দার অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন লতার মধ্যে প্রতিভা আছে। ‘মজবুর’ ছবিতে লতাকে গাওয়ালেন। সে গান শুনে অন্যান্য সংগীত-পরিচালক লতা সম্পর্কে আগ্রহী হলেন, যেমন— খেমচাঁদ প্রকাশ, অনিল বিশ্বাস প্রমুখ। খেমচাঁদের সুরে ‘মহল’ (১৯৪৯) ছবিতে লতার ‘আয়েগা আনেয়ালা’ দারুণ ভাবে সমাদৃত হল এবং এখনও চিত্তাকর্ষক। নৌশাদের সুরে গাইলেন ‘চাঁদনি বার’ ছবিতে, অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘আনোখা প্যার’-এ, শংকর জয়কিষানের সুরে ‘বরসাত’-এ। তার পর শুধুই এগিয়ে চলা। সারাদিন রেকর্ডিং। অমানুষিক পরিশ্রম করে চললেন লতা, তার ফলও ফলল।
গানের কথা লতার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ— গুলাম হায়দারের কাছে তিনি এই শিক্ষা পেয়েছেন। চটুল কথা-সুরের গান লতার একেবারেই অপছন্দ। গাইতে গিয়ে কী ভাবে নিশ্বাস নিতে হবে, ছাড়তে হবে, নির্দিষ্ট কোনও স্বরের ওপর কী ভাবে জোর দেওয়া যেতে পারে— এ-সব খুঁটিনাটি শিখেছিলেন অনিল বিশ্বাসের কাছে। রেকর্ডিং-এর আগে লতা জেনে নিতেন কোন নায়িকার লিপে আছে গান— সে ভাবেই রেকর্ড করতেন। এই পথেই সাফল্যের শীর্ষে উঠেছেন, পাঁচ দশক জুড়ে সমান দাপটে গেয়েছেন, বিভিন্ন প্রজন্মের নায়িকার কণ্ঠে তাঁর গান কখনও বেমানান মনে হয়নি। মেলডি-ভিত্তিক, লোকসংগীত কিংবা রাগ-নির্ভর— সবেতেই লতা সার্থক। কথাপ্রসঙ্গে লতা তাঁর পূর্বসূরিদের কথা স্মরণ করেছেন সশ্রদ্ধ ভাবে-- নূরজাহান, সামসাদ বেগম, সুরাইয়া প্রমুখ। বিশেষ ভাবে বলেছেন কে এল সায়গল-এর কথা। ১৯৪৭-এ প্রথম রেডিয়ো কিনে রেডিয়ো খুলেই শোনেন সায়গলের মৃত্যুসংবাদ; দু’দিন বাদে সেই রেডিয়ো দোকানে ফেরত দিয়ে আসেন। সহ-শিল্পী মুকেশ, তালাত মাহমুদ, মহম্মদ রফি, কিশোরকুমার, মান্না দে, মহেন্দ্র কপূর, হেমন্তকুমার, গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলে প্রমুখের সম্পর্কে সপ্রশংস ভাবে বিস্তারিত বলেছেন। নাসরিন অবশ্য লতাকে একটু উস্কে দেন বোন আশার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা তুলে। আশা’কে ‘ভার্সেটাইল আর্টিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে লতা শান্ত ভাবে জানান, আশার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বরাবরই ভাল, এখনও তা-ই। সাজগোজ, রান্নাবান্না, বিয়ে— এ সমস্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গেও লতা অকপট। ২৫টির বেশি দেশীয় ভাষায় এবং দু’-তিনটি বিদেশি ভাষায় গান গাইলেও লতার প্রধান ক্ষেত্র হিন্দি সিনেমা। পূর্ব-উল্লিখিত সুরকাররা ছাড়া শচীন দেববর্মন, মদনমোহন, রোশন, জয়দেব, সলিল চৌধুরি, হেমন্তকুমার, লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল, কল্যাণজি আনন্দজি, রবীন্দ্র জৈন প্রমুখের সুরে লতা গেয়েছেন হিন্দি ছবিতে। এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলেছেন, তবে কল্যাণজি আনন্দজির কথা তুলনায় কম। লক্ষণীয় যে, বইটিতে অজস্র ছবি থাকলেও কল্যাণজি-আনন্দজির নেই। মনে পড়ছে এই জুটির সুরে লতার একটি অসামান্য গান— ‘ও শ্যামা’ (যব যব ফুল খিলেঁ)। ও পি নাইয়ার-এর সুরে কোনও গান করেননি লতা, কেননা তাঁর মতে নাইয়ারের সুর ঠিক মানায় না তাঁর গলায়। গানের বাণীকে মর্যাদা দিয়েছেন লতা সব সময়, সুতরাং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন সাহির লুধিয়ানভি, শৈলেন্দ্র, মজরু সুলতানপুরি, গুলজার, আনন্দ বক্সি প্রমুখ গীতিকারকে। নতুন প্রজন্মের শিল্পী-সুরকারের প্রসঙ্গে লতা সোনু নিগম, উদিতনারায়ণ, অলকা ইয়াগনিক, পি সুশীলা, সুনীধি চহ্বাণ, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, এ আর রহমানের কথা বললেও বিস্ময়কর ভাবে অনুল্লিখিত কুমার শানু, নাদিম শ্রাবণ কিংবা শ্রেয়া ঘোষাল। শুধু গান নয়, সুর-ও করেছেন লতা। ‘আনন্দঘন’ ছদ্মনামে চারটি মরাঠি ছবিতে সুর দেন। কিশোরকুমারের দু’টি বাংলা বেসিক গানে সুর করেছিলেন ১৯৭৪-এ: ‘আমি নেই’ ও ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’। এখানেই উল্লেখ্য যে, শারদীয় পুজোয় বেরনো বাংলা বেসিক গান সম্পর্কে তাঁর ভাল লাগার কথা জানাতে ভোলেন না লতা, বাংলা গান প্রসঙ্গে।
ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ প্রভতি অজস্র পুরস্কারে ভূষিত লতা ঠিক ক’টা গান গেয়েছেন? দু’-একটি সূত্র উদ্ধৃত করে লতা জানাচ্ছেন— ২৭ কিংবা ২৮ হাজার! এটা আরও অনুসন্ধানসাপেক্ষ।
বইটির শেষ পর্যায়ে কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মতামত সন্নিবেশিত। নৌশাদ, তালাত মাহমুদ, মান্না দে, দিলীপকুমার, জাভেদ আখতার, আশা ভোঁসলে-রা লতা সম্পর্কে তাঁদের মুগ্ধতার কথা ব্যক্ত করেছেন। আছে লতার পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং বিভিন্ন ভাষায় গান গাওয়ার খবর। দামি কাগজে ছাপা এই শোভন-সুছাঁদ বইটির অন্যতম সম্পদ লতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নানা ছবি।
লতা গীতকোষ- খণ্ড ১ গ্রন্থে স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় লতা মঙ্গেশকরের সমস্ত বাংলা গান (বেসিক ও চলচ্চিত্র) সংকলিত করেছেন প্রাসঙ্গিক তথ্যসমেত। তাঁর শ্রম ও অধ্যবসায় সাধুবাদযোগ্য। বইটিতে লতার সংক্ষিপ্ত জীবনীতে উল্লিখিত হয়েছে, জন্মের সময় লতার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হেমা’, লতা কিন্তু নাসরিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই তথ্য ভুল বলে জানিয়েছেন (পৃ: ২৫)। লতার ‘কি লিখি তোমায়’ গানটির পাঠ যেখানে আছে, সেখানে গীতিকার-সুরকার হিসেবে সলিল চৌধুরির নাম অনবধানতাবশতই উল্লিখিত, তথ্যের জায়গায় সঠিক জানানো হয়েছে যে, গীতিকার মুকুল দত্ত, সুরকার কিশোরকুমার।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



