somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুশোচনার আগুন

১৭ ই মে, ২০১৪ রাত ৮:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
হঠাৎ রাজশাহী চলে এলাম। কোন ধরনের কাজ ছাড়ায় আসা। এখানে কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে, মূলত তাদের উদ্দেশ্যেই এই আসা। তিন বছর আগে একবার এসেছিলাম। তারপর আর সময় করে উঠতে পারিনি। বিকাশ অনেক দিন থেকেই বলছে। কিন্তু আসা হয় না। সময় বড়ই বেরহম। আসি আসি করেই দিন কেটে যায়। আসা আর হয় না। সময় ঠিকই চলে যায়।
যান্ত্রিক জীবনের অবিরাম ছুটে চলা, প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখার দায়, স্বপ্ন পুরোনের আকাঙ্ক্ষা, আর সকলের প্রত্যাশার সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। হারিয়ে যাচ্ছে আমার সোনালী স্বপ্নের সজীবতার চাদরে মোড়ানো সেইসব দিনগুলো, সেইসব আড্ডা, সেইসব বন্ধুরা। এখন আর চায়লেই যেমন সময় পাওয়া যায় না, তেমনি বন্ধুদেরকেও পাওয়া যায় না। সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। সবারই কাজ আছে, ঘর-সংসার আছে। তাই কেউ কাউকে আর আগের মত সময় দিতে পারে না।
প্রতিদিন সেই একই রুটিন। ৯টা-৫টা অফিস। আর সাপ্তাহিক যে ছুটি টা থাকে তার জন্যও থাকে না কোন বিশ্রাম। নিজের সমস্ত কাজ যেন ওই ছুটির দিনের জন্যই তোলা থাকে। তাই অফিস ছুটি থাকলেও কাজ থেকে জীবনের আর ছুটি মেলেনা। বিরতিহীনভাবে এই কাজ করতে করতে আমি আজ বড় ক্লান্ত,শ্রান্ত,অবষাদগ্রস্ত। এবার কিছু দিনের জন্য ছুটি চায়। পালিয়ে যেতে চায় জীবনের সমস্ত কাজ থেকে, সমস্ত দায়ীত্ব-কর্তব্য থেকে, সমস্ত ব্যস্ততা থেকে।
বিকাশ অনেক দিন থেকেই বলছে। আর আমিও দীর্ঘদিন কোথাও বেড়াতে যায়নি। কাজের চাপও একটু কম আছে। তাই ভাবলাম কিছু দিনের ছুটি নিয়ে বিকাশের ওখান থেকে ঘুরে আসি। পাগলাটাও খুশি হবে। আমারও ভাল লাগবে।
যেমন ভাবা,তেমন কাজ। সাত দিনের ছুটি নিয়েই রাজশাহী চলে এলাম। বিকেলের ট্রেনে এসেছি। আসতে আসতে রাত ৮ বেজে গেল। ঢাকা টু রাজশাহী প্রায় তিনশ কিলোমিটার ট্রেন ভ্রমন। যদিও শরীর খুব একটা ক্লান্ত হয়নি, কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। আর বিকাশকেও আগে থেকে জানায়নি যে আমি আসছি। তাহলে পাগলাটার আর কোন হুসজ্ঞান থাকবেনা। এমনিতে বিয়েশাদী করেনি। ব্যাচেলর মানুষ। আমি আসছি জানলে নানারকম আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওকে এইসব ঝামেলায় ফেলতে চায়নি। আর আমি হঠাৎ চলে এসেছি জানলে ও খুশিই হবে। ওকে একটা সারপ্রাইজ ও দেওয়া হবে।
ট্রেন থেকে নেমেই আমি ভাল কোন রেস্তোরায় খুঁজতে লাগলাম। খুববেশি ঘুরতে হল না। কাছেই পেয়ে গেলাম ধানসিড়ি রেস্তোরায়। ঢুকে পড়লাম। একটা নিরিবিলি খালি টেবিল দেখে বসে পড়াম। প্রথমে হালাকা কিছু খেলাম। তারপর বেয়ারাকে এককাপ কফি দিতে বললাম।
আমি কফির জন্য অপেক্ষা করছি। আর আশেপাশে দেখছি, তিন বছরের মধ্য রাজশাহীর কি কি পরিবর্তন হয়েছে। এমন সময় আমার সামনের টেবিলের কয়েক টেবিলে পরে বসা এক ভদ্রমহিলার দিকে আমার চোখ পড়ল। কিছুটা বিষণ্ন ও অন্যমনস্ক ভাবে বসে আছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে। পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়স হবে। দূর থেকে দেখে মনে হল মহিলাকে আমি চিনি। একটু সময় লাগলো,কিন্তু আমার চিনতে ভুল হলো না। অরণী আপু,সেই অরণী আপু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উত্তাল দিনগুলিতে কিছু স্মরণীয় সময় যার সাথে কাটিয়েছি। কতদিন তার হাতের রান্না করা খাবার খেয়েছি। ক্যান্টিনের পচা খাবার খেতে খেতে যখন মুখের স্বাদ নষ্ট হবার যোগাড়, তখন যার সুস্বাদু রান্না আবার মুখের রুচি ফিরিয়ে দিত, এই সেই অরণী আপু। কত আড্ডাবাজি, কত আষাঢ়ে গল্প হত আমাদের মধ্যে। কত চমৎকার ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো!
তারপর কি থেকে যে কি হয়ে গেল। হঠাৎ করে অরণী আপু আর কনি ভাইয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল। কালবৈশাখীর ঝড়ে পাখির নীড়ের মত ভেঙ্গে গেল আমাদের সেই আড্ডা। আমাদের রূপকথার সেই রাজ্য হারিয়ে গেল কোন এক বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। যার তল আর কোনদিনই খুঁজে পেলাম না।
কিছুদিন পরে জানতে পারলাম, অরণী আপুর বিয়ে হয়েগেছে কোন এক এএসপির সাথে। কনি ভাই তখনও ভবঘুরে বেকার। পকেটে টাকা নেই। একটা চাকরির প্রত্যাশায় প্রতিনিয়ত গ্রহন্থাগারে বসে একটানা পড়ে যাওয়া, আর ভালোবাসা হারানোর বেদনায় সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রতিনিয়ত নিজেকে নিঃশেষ করা। চাকরির জন্য কোনকালেই কনি ভাইয়ের তাড়া ছিলনা। তিনি কবিতা লিখতেন,গল্প লিখতেন। -‘চাকরি করবেন না?’ জানতে চাইলে বলতেন, যে কোন একটা চাকরি হলেই হবে, তা সেটা তাড়াতাড়িই হোক বা দেরিতে হোক। যিনি কখনও চাকরির কথা ভাবেননি। আর আজ সেই তিনি চাকরির পেছনে ছুটছেন। এখন তার একটাই লক্ষ্য, ভাল কোন চাকরি। তার কথা শুনে মনে হত কাউকে দেখানোর জন্যই তিনি চাকরি করতে চান। তিনি আর কবিতা লেখেন না,গল্প লেখেন না। ‘কেন লেখেন না?’ জানতে চাইলে, বলতেন,-“ লিখে কি হবে? আর কার জন্যই বা লিখবো?
-আগে কার জন্য লিখতেন?
-আগে কবিতা লিখতাম আমার কবিতার জন্য। এখন আমার সেই কবিতা আর নেই। হারিয়ে গেছে। তাই এখন আর কবিতা লিখি না।
-আগে কবিতা লিখেছেন আপনার কবিতার জন্যে,আমাদের জন্যে তো কখনো লেখেননি। এখন না হয় আমাদের জন্যই লেখেন।
-হয় না। এখন আর কবিতা হয় না। লিখতে চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু পারিনি। আমার মনের কবিতার সাথে আমার কবি মনও হারিয়ে গেছে। আমি আর কোন কবি নই। আমি এখন অকবি। আমার মস্তিষ্ক এখন অনুর্বর,ঊষর। এখানে আর কোন কবিতার চাষ হয় না, জন্ম নেয় না আর কোন নতুন কবিতা। আর যদি কোনদিন আবার নতুন করে নতুন কোন কবিতা এখানে জন্মাতে চাই,আমি তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করব। আমি তাকে জন্মাতে দেব না। আমি আমার মস্তিষ্কে টাকার চাষ করতে চাই। আমার অনেক টাকার প্রয়োজন। তাই আমার মস্তিষ্কে আমি টাকার বীজ বুনতে শুরু করেছি। কিছু দিন পরে এখানে টাকার চারা জন্মগ্রহণ করবে। আমি তাকে সার-পানি দিয়ে পরিচর্যা করব। আর অনেক টাকা ফলাব। আর সেই টাকা দান করে দেব যত সব বেকার প্রেমিক কবিদের, যেন টাকার জন্য আর কোন কবিকে তার কবিতা হারাতে না হয়।
-কিন্তু বিচ্ছেদ থেকেই তো বড় বড় কবি ও কবিতার সৃষ্টি হয়েছে।
-তা হয়তো হয়েছে। আমার বেলায় না হয় ব্যতিক্রম হল। বিচ্ছেদ থেকে কবিতার সৃষ্টি না হয়ে টাকার গাছ তৈরি হল।
-আমি আর কিছু বলতে পারিনি বা পারলেও কিছু বলিনি। শুধু কষ্ট পেয়েছিলাম হারিয়ে যাওয়া কবি ও কবিতার জন্য। তাই চুপ করে চলে এসেছিলাম।
কিন্তু কবি তার কথা রাখতে পারিনি। চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কবিতা ছেড়ে থাকতে পারিনি। তাকে আবার ফিরতে হয়েছে কবিতার জগতে। কোন কবি কী তার কবিতা ছেড়ে থাকতে পারে? কনি ভাই ও পারেনি।

আমি একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ অরণী আপুর ডাকে বাস্তব জগতে ফিরে এলাম।
-তুই এখানে?
-হ্যাঁ, আমি এখানে। বেড়াতে এসেছি। কিন্তু তুমি...?
-কি? আমি কি? এখনে কেন?
-হ্যাঁ;
-মেয়েকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হয়েছি।
-ও, এটা তোমার মেয়ে? অনেক বড় হয়ে গেছে তো।
-হ্যাঁ, ছয় বছর বয়স হতে চললো। তুই আমাকে চিনতে পারিসনি?
-পেরেছি, কিন্তু সেদিনের সেই ব্যবহারের পর আমার সাথে আর কথা বলবে কিনা বা এত দিন পর আমাকে চিনতে পারবে কিনা, আমাদের কথা মনে আছে কিনা তাই ভেবেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব হচ্ছিল।
-কত দিন পরে আবার দেখা হল আমাদের, তাই না? আর তোরা হয়তো আমাকে ভুলে গেছিস। কিন্তু আমি তোদের কাউকে ভুলিনি। কোনদিন ভুলতে পারবও না।
-আমি কিন্তু ভাবতেও পারিনি তোমার সাথে এই ভাবে এখানে দেখা হয়ে যাবে।
-আমি কি ভেবেছিলাম। যাক কি খবর তোদের? কেমন আসিস তোরা সব?
-তোরা বলতে আমি! যদি আমার কথা বল তো আমি ভাল আছি। আমার অন্যসব বন্ধুরা যাদের সাথে যোগাযোগ আছে, তারাও মোটামুটি সব ভাল আছে। তো তোমার খবর কী?
-এই যে, এখানেই আছি। আমার স্বামী এখানকার এসপি হিসেবে আছে।
-ও, তাহলে তো রাজশাহীতে আমি নিশ্চিন্ত। কোন ঝামেলা হলে এসপি সাহেব তো আছেন।
-তা বটেই। তা তুই কার কাছে এসেছিস? থাকবি কোথায়?
-আমার বন্ধু বিকাশ ছিলনা, ওর কাছেই এসেছি। আর ওর কাছেই থাকব।
-ও হো! ও তো কবিতা লেখে। তা ও কি রাজশাহীতে থাকে?
-সে তো অনেকদিন থেকেই এখানে থাকে।
-আমি ওর কবিতা পড়েছি। কিন্তু ও যে এখানে থাকে জানতাম না।
-আপু, তোমাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল। আমি তোমাকে বলেছিলাম, আবার যদি কখনও দেখা হয় তবে জানতে চাইব। আমার মনে হয় সেই প্রশ্ন করার সময় হয়ে গেছে। আমি সেই প্রশ্নগুলো আবার করতে চাই।
-আজ উঠিরে। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে; বলেই আপু উঠে দাঁড়াল।
-কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
-আমার স্বামী ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। আজ আমাকে যেতে হবে। তুই এখানে আছিস না। কাল দুপুরে আমার বাসায় আয়। তোর সাথে আমারও অনেক কথা আছে। আমার বাসার ঠিকানা লিখে নে।
-কিন্তু আমাকে তো ঢুকতে দেবে না।
-আমি বলে রাখব। আর তোর ফোন নাম্বারটা দে।
-আমার আগের সেই নাম্বারটাই আছে।
-সেই জিপি নাম্বারটা?
-হ্যাঁ, তোমার নাম্বারটা আমাকে দাও।
ফোন নাম্বারটা দিয়ে অরণী আপু চলে গেল। আমিও বিকাশের বাসায় চলে আসলাম। কিন্তু রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারলাম না। আমি শুধুই ভেবেছি। আগামীকাল দেখা হলে অরণী আপুর কাছে কি কি জানতে চাইব। কি জানতে চাইব? কনি ভাই কে দুঃখ দিল কেন? তার সাথে প্রতারণা করল কেন? না, সে সবের কিছুই আমি জানতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই, কনি ভাই কে ছেড়ে সে সুখী হতে পেরেছে কিনা।

দুই
পরের দিন দুপুরের পরপরই আমি অরণী আপুর বাসায় চলে গেলাম। আপু দারোয়ানকে আগেই বলে রেখেছিল। আমাকে আটকাল না। আমি এসপি সাহেবের বাংলোতে ঢুকে পড়লাম। দরোজার কলিং বেল চাপতেই অরণী আপু দরোজা খুলে দিল। আমার মনে হল, আপু যেন দরোজার ওপাশেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দরোজা খুলতে একটুও দেরি হল না।
-আয়, ভেতরে আয়। আমি তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। আপু আমাকে নিয়ে সোজা ওনার ব্যালকনিতে নিয়ে গেলে। সামনা-সামনি দুটি চেয়ারে আমরা বসলাম। আপু আমার জন্য খাবার আনতে যাচ্ছিল। আমি বাঁধা দিলাম। বললাম, আমি খেয়ে এসেছি।
-ঠিক আছে। চা বা কফি তো চলবে। তোর তো আবার বেশি বেশি কফি খাওয়ার অভ্যাস ছিল।
-শুধু ছিলনা। এখনও আছে।
-তাহলে তুই পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর। বসে বসে আমার ফুল গাছ গুলো দেখতে থাক, আমি তোর জন্য কফি বানিয়ে আনছি।
আপু কফি আনতে চলে গেল। আমি বসে বসে ব্যালকনিতে টবে লাগানো ফুল গাছ গুলো দেখতে লাগলাম। কিছু অর্কিড ফুল গাছ আছে। আমার খুব প্রিয় একটা ফুল। হঠাৎ মনে হল এটা তো কনি ভাইয়ের ও প্রিয় ফুল। কিছুটা অবাক হলাম। আপু কফি নিয়ে চলে এসেছে।
সামনাসামনি দুটো চেয়ারে বসে আছি আমরা। গরম কফির ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাসে। কফির পেয়ালাতে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। কয়েকটি চুমুকও দিলাম। চেয়ারে হেলান দিয়ে কফির পেয়ালার দিকে তাকিয়ে আছি। কিভাবে, কি কথা দিয়ে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
-তুমি খুব ভালই আছো, না?
-মানে?
-মানে সুখেই আছো তো?
আপু কোন কথা বলছেন না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। তারপর নরম সুরে বললেন, হ্যাঁ, সুখে আছি, খুব সুখে আছি। দেখছিস না আমার কোন কিছুরই অভাব নেই।
-তোমাকে দেখে কিন্তু তা মনে হয় না।
আপু যেন কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। একটু নরম সুরে জানতে চায়লো, আমাকে দেখে কি মনে হয় না?
-ওই যে বললে, তুমি খুব সুখে আছো। তোমাকে দেখে মনে হয় না, তুমি খুব সুখে আছো।
-কেন? মনে হয় না কেন?
-দেখ আপু, আমি কিন্তু তোমাকে খুব ভাল করেই চিনতাম। তুমি কত হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিলে। আর আজ কি রকম যেন হয়ে গেছ।
-আমি কি রকম হয়ে গেছি। মানে? কি রকম হয়ে গেছি আমি?
-সেটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না। তবে তোমার চোখে-মুখে কিসের যেন একটা অভাববোধ আছে। আগের সেই উচ্ছল ভাবটা আর নেই। কেমন যেন বিষণ্ণ আর মনমরা ভাব আছে। যেটা আগে ছিল না।
-তাই নাকি? জানতাম না তো?
-যাক আমি কি তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে পারি? না, মানে তেমন কিছু না। আমি আগেও তোমাকে বলেছি। কিন্তু এতদিন পরে তোমার সাথে দেখা হল। আর দেখা হবে কি না। তাই ভাবলাম...............।
-কফি কেমন হয়েছে, বললি না তো?
-কফি ভালো হয়েছে। কিন্তু তুমি কি আমাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছো?
-কই, নাতো। বল, তোর কি প্রশ্ন আছে আমার কাছে।
-কনি ভাইকে ছেড়ে তুমি কি প্রকৃতই সুখী হতে পেরেছ?
-একটু আগে তুই তো বললি, আমাকে দেখে মনে হয় না, আমি খুব বেশি সুখে আছি। তাহলে আবার নতুন করে জানতে চাচ্ছিস কেন?
-সেটা তো আমার ধারণা, আমি বলেছি। কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
-তাই? আমার মুখ থেকেই শুনতে হবে?
-হ্যাঁ। তোমার মুখ থেকেই আমি শুনতে চায়।
-শোন, কোন মানুষই তার জীবনের সকল আশা আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে না। কোন না কোন ক্ষেত্রে তা অপূর্ণতা থেকেই যায়। পরিপূর্ণভাবে কেউ সুখি হতে পারে না। প্রত্যাশা অনুযায়ী সকলে সব কিছু পায় না। আর এই পাওয়া না পাওয়ার মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। আমদের সুখী হতে হয়। সে দিক থেকে আমি ভালোই আছি। বলতে পারিস সুখেই আছি।
-কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছ। তুমি কোন দিক থেকেই সুখে নেই। তোমার মুখ দেখে আমি সেটা বুঝতে পারছি। শুধু বুঝতে পারছি বললে ভুল হবে। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।
-আমি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি? কে বলল তোকে?
-হ্যাঁ। তুমি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছ। সুখী না হয়েও আমার সামনে সুখী সাজার চেষ্টা করছ।
-তোর ধারনা ভুল। আমি মোটেও নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি না। আমি বেশ ভালোই আছি। সুখেই আছি। কিসের অভাব আমার? কি নেই আমার যে আমি সুখী হতে পারব না।
-আমি মানছি, তোমার টাকা-পয়সা, মান-সম্মান,প্রতিপত্তি কোন কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু তার পরও আমার মনে হচ্ছে তুমি সুখী হতে পারনি।
-কেন তোর এমন মনে হচ্ছে?
-কারন আমার মনে হচ্ছে তোমার ভালোবাসার অভাব আছে। টাকা পয়সা না থাকলেও মানুষ সুখী হতে পারে। কিন্তু ভালোবাসা না থাকলে কোটি কোটি টাকাও মানুষকে সুখী করতে পারে না। মনে শান্তি এনে দিতে পারে না।
আপু কোন কথা বলছেন না। মাথা নিচু করে আছেন। পৃথিবীর সমস্ত বিষণ্ণতা যেন তার মুখে এসে পড়েছে। আমি চুপ করে আছি। চারিদিকে থমথমে নিরাবতা বিরাজ করছে। আপু ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন-
গতকাল যখন তোর সাথে আমার দেখা হয়, তুই যখন বলেছিলি আমার কাছে তোর কিছু জানার আছে, তখনই আমি অনুমান করেছিলাম, তুই এটাই জানতে চাইবি। তখন থেকেই আমি ভাবছি, কি বলব তোকে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি বলব। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিছুই বলব না। কিন্তু তোর সাথে পারলাম না।
যাক শোন তাহলে। আমার কোনকিছুরই অভাব নেই। টাকা-পয়সা,শাড়ী বাড়ি গাড়ি,গহনা,মান-সন্মান,প্রতিপত্তি, কোনকিছুরই অভাব নেই। তারপরও আমার মনে শান্তি নেই। আমার স্বামী সারাদিনই ব্যস্ত থাকে। আমাকে দেবার মত সময় তার নেই। দুজনে একজাগায় বসে দুটো কথা বলব, সেই সময়ও তার হয় না। সকালে বের হয়ে যায়। আর অনেক রাতে ফিরে। ফিরেই মরার মত ঘুম। আমাকে দেখার সময় তার নেই। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, আমার কোন সমস্যা আছে কিনা, আমার কিছু লাগবে কিনা, এসব দিকে তার নজর দেবার সময় নেই।
আমি কোন কিছু বলতে গেলেই রেগে যায়, বাজে কথা বলে। আমি একটু ভাল কথা বা ভাল ব্যবহার তো তার কাছে আশা করতে পারি। কিন্তু সেটাও আমি পায়না। সবসময় তার মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে থাকে। মনখুলে কথা বলতে পারি না। আমি সারাদিন একা একা বাসায় থাকি। কিছুই ভালো লাগে না আমার। নিজেকে বড় একা একা লাগে।
এখানে তেমন কোন মানুষও নেই যে তার সাথে দুটো মনের কথা বলব। ইচ্ছা মত ঘুরতেও পারি না।
-তুমি চাকরি করলে না কেন? তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছ। চাকরি করলে তো কিছুটা হলেও একাকীত্ব দূর হত।
-আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে চাকরি করতে দেওয়া হয়নি। শুধু চাকরি না। আমি আরও অনেক কিছু করতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আগে তো আমি কবিতা লিখতাম। কিন্তু এখন তাও লিখতে পারনা। কবিতা লিখলে আমার স্বামী কি বলে জানিস? বলে, “মেয়েদের আবার কবিতা লেখা। মহিলারা আবার কবি হতে পারে নাকি?”। যদি আমি কোন কবিতা লিখে তাকে দেখায়, জানতে চাই, ‘কেমন হয়েছে বলো তো’। তখন আমাকে কি বলে জানিস? বলে, “বেগম রোকেয়া হবার শখ হয়েছে নাকি?” এই সব কারণে এখন কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না।
জানিস, কনির সমস্ত লেখা,সমস্ত গল্প,কবিতা আমি পড়ি। ওর নতুন কোন বই বের হলেই আমি কিনে ফেলি। আমি ওর প্রতিটি লেখার মাঝে আমাকে খুঁজেছি। দেখতে চেয়েছি আমি আছি কি না। ওর কোন লেখার মাঝে যখন আমাকে খুঁজে পায়, তখন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। কি বাজে আচরণটাই না ওর সাথে আমি করেছিলাম। তখন ওর টাকা ছিল না। বেকার ছিল। আমার খরচ বহন করার সামর্থ ছিল না। তাই চলে এসেছিলাম। আসলে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। আমার পরিবার থেকে ওকে মানতে পারত না। আর ও তো নিজে কিছু করার চেষ্টাও করত না। শুধু কবিতা,গল্প দিয়ে কি আর জীবন চলে। তারপর ও ভাবি কত বড় প্রতারণা আমি করেছি। যখনই ভাবি নিজের উপর নিজেরই ঘৃণা হতে থাকে। আমি অনুশোচনার আগুনে পুড়তে থাকি।
মাঝে মাঝে এও ভাবি আমিও তো কবিতা লিখতাম। আমিও তো একজন কবি ছিলাম। আর একজন কবি হয়ে কি করে আর একজন কবিকে দুঃখ দিতে পারলাম। কি করে পারলাম তার সাথে এত বড় ছলনা করতে।
আরণী আপু ছলছল চোখে বলে চলেছে-আগে জানলে আমি এই গণ্ডারটাকে বিয়ে করতাম না। আমার ফুলের মত জীবনটাকে ও নরক বানিয়ে ফেলেছে। আসলে কাউকে কষ্ট দিয়ে, কারও মন ভেঙ্গে দিয়ে কখনও সুখী হওয়া যায় না। কি এমন হত একজন কবি কে বিয়ে করলে। অভাব-অনাটন হয়তো থাকত, তবুও মনে শান্তি পেতাম। মনের শান্তি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শান্তি। মনে শান্তি না থাকলে হাজার টাকা-পয়সা থাকলেও সুখ থাকে না।
আমি বললাম, নিজেকে শক্ত কর। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর কি করবা। মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নাও।
-মানিয়ে নিয়েই তো বেঁচে আছি। এখন আমার মেয়েই তো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ওকে আমি আমার মত করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। ওকে আমি মানুষের মত মানুষ করতে চাই।
-তাই চেষ্টা কর।
আপু আর কিছু বলছে না। নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। আমি কি বলে যে সান্ত্বনা দেব তা বুঝতে পারছি না। আমি কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে মনে বললাম আপু কাঁদ। কেঁদে কেঁদে নিজেকে হালকা করো।
বেশ কিছুকক্ষণ নীরবে কেটে গেল। আপুর কান্না থেমেছে। কিন্তু কোন কথা বলছে না। চুপ করে আছে। আমি ও কিছু বলতে পারছি না। অস্বস্তি হচ্ছিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে আসছে।
আমাকে উঠতে হবে। আর দেরি করা যাবে না। অন্ধকার রাত। বললাম, আমি আজ যায় আপু। দেরি হলে বিকাশ আবার রাগ করতে পারে।
-কেন যাবি? আমার বাসায় আজ থেকে যা।
-না আপু, অন্য একদিন আসব।
-আমার বাসায় প্রথম এসেছিস। রাতে খেয়ে যা অন্তত।
- না, আজ থাক, অন্য একদিন আসব। অন্ধকার রাত। বেশি রাত হয়ে গেলে আমার ফিরতে আবার সমস্যা হতে পারে।
-ঠিক আছে, থাকবিনা যখন, তবে যা। ফোন দিস। আর রাজশাহী আসলে আমার বাসায় আসিস। আমার ভাল লাগবে।
-আসব।
আমি বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। রাস্তায় নেমে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে আমার মনে হল, কনি ভাই অনেক ভাগ্যবান একজন মানুষ। অরণী আপু এখনও কনি ভাইকে ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসাটাই কি কনি ভাইয়ের বড় সার্থকতা না? আমি মনে করি এটাই তার প্রেমের বড় সার্থকতা।
আরো মনে হল, কারো মন ভেঙ্গে দিয়ে আসলেই কেউ সুখী হতে পারে না। আর টাকা পৃথিবীর অনেক কিছুই করতে পারে, কিন্তু সব কিছু পারে না। আর শুধু টাকা থাকলেই জীবনে সুখী হওয়া যায় না। সুখী হতে হলে টাকা ছাড়াও অন্য অনেক কিছু থাকতে হয়।





১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×