বাসন্তী
বাপ্পী পাল
উচাটন ভাবটা কমে আসার পর যখন সে অফিসের নিচে এসে দাঁড়ালো, প্রকৃতিতে তখন চিরায়ত ভালো লাগার লগ্ন, গোধূলি। পঞ্জিকার প্রতিফলন আজ প্রকৃতিতে। চারদিকের উঁচু উঁচু দালানের মাঝখানে পার্কের নামে গড়ে তোলা গাছগুলোর সবুজাভ পাতাগুলো সে ঘোষণাই যেন দিল। কিন্তু দৃষ্টি যখন গাছদের ফাঁক গলে আকাশে পৌঁছে গেল, সেখানকার রক্তাভ মেঘগুলো মনটাকে আবার এলোমেলো করে দিল। ছাড়া ছাড়া মেঘগুলোকে খানিকক্ষণ আগে অফিসের জানালা দিয়ে জ্বলতে দেখা গিয়েছিল, এখন যেন নিভে আসা টুকরো টুকরো অঙ্গার। তন্ময় হয়ে দেখতে লাগলো সে।
প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে সদ্য। চারদিকে বসন্ত আর ভালোবাসা দিবস টিবস মিলে এমন এক আবহ সৃষ্টি হয়েছে যে, তার অংশীদার হতে না পারাটা যেন ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতাবোধ থেকেই হয়তো খানিকক্ষণ আগে ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাস দিল কাব্যিক ঢঙে, ‘আজ এই দিনে/ আমি অফিসের কোণে/ আমার বাসন্তী কই’? দিয়ে হাসলো, পাগলামি হলো না তো! হলে হোক। মাঝে মধ্যে পাগলামিও সই।
অফিসের কোণে অবশ্য বেশিক্ষণ থাকল না, অনির্দিষ্ট গন্তব্যের খোঁজে নেমে এলো নিচে। দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত এলাকাটিতেও ইদানীং যানজট সাধারণ বিষয়। গুলশান দুই আর এক এর মাঝামাঝি অঞ্চলে তার কর্মস্থল। দুই মোড়ের মাঝে মাইলখানেক দূরত্ব পাড়ি দিতে বিশেষত সন্ধ্যার দিকে আধ ঘণ্টাও পেরিয়ে যায়। এক পলক তাকালে যেন মনে হয়, বাসা ভেঙে পিঁপড়ার মত বেরিয়ে এসেছে প্রাইভেট গাড়িগুলো। জটে পড়ে পুরো রাস্তাটাই স্থবির হয়ে আছে, এমন দৃশ্যও বিরল নয়।
এখন যদিও সে রকম কোনো যানজট নেই। সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। যানজট ছাড়া পাবলিক বাস মাঝখানে দাঁড়াবে না, সেক্ষেত্রে হয় দু’নম্বর নয়তো এক নাম্বার মোড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে। তার আগে ঠিক করা দরকার গন্তব্য। ভাবলো সে, বইমেলার দিকে গেলে কেমন হয়, কাঁধে ঝুলে থাকা ল্যাপটপটার কথা ভেবে দোনোমোনো করছিল সে। হালকা মেজাজে মেলায় ঘোরার পক্ষে পিঠে লেপ্টে থাকা কয়েক কেজি ওজন হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু অবশ্যই স্বাভাবিক স্বস্তির বিষয়ও নয়। ঘাড় কাত করে অফিসের দিকে তাকালো সে। ল্যাপটপটা অফিসের ডেস্কে রেখে এলে কেমন হয়, ভাবলো একবার। এ সময়ে চকচকে গাড়িটা এসে দাঁড়ালো তার সামনে।
ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে এক পলক তাকিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসলো সে। দাঁড়ানোর আর জায়গা পেলো না, মনে মনে একবার ভাবলোও। কিন্তু যখন ড্রাইভারের পাশের জানালার কাচটা নেমে গেল, আর সে ফাঁকে ‘স্যার স্যার’শব্দ দুটো ভেসে এল, আশপাশে সে ডাকে সাড়া দেয়ার দূরত্বে আর কেউ নেই, বিস্মিত সে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালো।
উদ্দিষ্ট সে-ই, ড্রাইভারের বিনীত দৃষ্টি তাই বোঝালো। উঠানো রঙিন কাচের ভিতরে পেছনের সিটে কেউ আছে কি-না বোঝা গেল না। বলুন, কোমর বেঁকিয়ে ড্রাইভারের সমান্তরালে আনলো দৃষ্টি। জবাবে শারীরিক কসরত দেখিয়ে হাত বদল করে তার হাতে একটি ভিজিটিং কার্ড ধরালো ড্রাইভার, স্যার এটা কোথায়? অ, তাই বলুন! নিজের অজান্তেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। ঢাকায় কয়েক মাস হয়ে গেলো, তবুও এ শহরকে আপন ভাবা হয়ে উঠছে না। এখনো অল্পতেই চমক জাগে। চারপাশের যাবতীয় নেতিবাচকতার মাঝে থিতু হওয়ারই যেন সুযোগ মিলছে না।
হাত বাড়িয়ে ড্রাইভারের হাত থেকে কার্ডটা নিল সে। ‘মঙ্গল গ্রহ চেনার মতই চিনি এ শহর’ যদিও মনে মনে ভাবলো সে। ভাবলেশহীন চোখে কয়েক সেকেন্ড পড়লো ঠিকানাটা, তারপর যা বলার উদ্দেশ্য নিয়ে কার্ডটা দেখা, ঠোঁট উল্টে তাই বলতে গেল। হঠাৎই তখন বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়লো সপ্তাহ খানেক আগে তার সহকর্মীর সাথে যাওয়া অফিসটার কথা। যার পাশে কার্ডে লেখা ঠিকানার সাইনবোর্ড ছিল।
ওই যে, ওই দিকে। আঙুল উঁচিয়ে দিক নির্দেশ করলো সে। যুতসই কোন সূচক হাতড়ালো কয়েক সেকেন্ড, না পেয়ে উঠানো আঙুলটা নাড়লো আবার, ঐ দিকে মোড়টার পরে কদ্দুর গেলে হাতের বাঁ পাশে। ‘শ্যুটিং ক্লাবের ওখানে নাকি’। ড্রাইভারের প্রশ্নে বিব্রত হলো সে, শ্যুটিং ক্লাব তো চিনি না। অফিসটা আমি চিনি কিন্তু লোকেশনটা ঠিক বলতে পারবো না।
এরপর যা ঘটলো তার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। স্বয়ংক্রিয়তার শব্দ তুলে রঙিন আড়াল সরালো পেছনের জানালা। সেখানে যে মুখটা দেখা গেল, কনে দেখা আলোর মোহনীয়তাকে আড়ালে ফেলে দিল তা। এ মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় প্রকৃতিতে এখন বসন্ত চলছে। এক পলক দেখলে মনে হতে পারে এ যে রীতিমত ট্যারা সুন্দরী!
মাদকতার ছোঁয়া লাগানো গলায় সিদ্ধান্ত শুনলো সে, আপনি তো ওদিকেই যাচ্ছেন, আসেন এক সাথে যাবো’! এ যে জিজ্ঞাসা নয়, অনুরোধ নয়, আহবানও নয়, যেন সিদ্ধান্ত। তাকে যেতেই হবে। সে গেল।
মনে থাকলো না এতো এতো নেতিবাচক খবর শুনে ক্ষণে ক্ষণে তার চমকিত হওয়ার অভ্যাসের কথা। এ শহরের সবকিছুতে দ্বিতীয় কোন মানে খোঁজার চর্চা ও ভুলে গেল। মনে রইলো না সেদিন ফোনে করা এক পুরনো সহকর্মীর রসিকতার কথা, ‘ঢাকায় সাবধানে থাকবেন, সেখানে ছদ্মবেশী পরীরা ঘুরে বেড়ায়’।
খট্ করে শব্দ তুলে যখন পেছনের দরজাটা খুলে গেল, সে দেখল তাকে ঢোকার সুযোগ করে দিতে সেখানকার একমাত্র আরোহীটির সরে যাওয়া। সিটের দিকে তাকিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকলো সে, চেষ্টা করলো যেন আরোহীর দিকে দৃষ্টি না পড়ে। এমন সুন্দরীদের দিকেই বার বার তাকালে চোখ ট্যারা হয়ে যায়। ছাত্রজীবনে বহু চর্চিত রসিকতাটা স্মরণ করলো সে, যদিও বাহ্যিক চেতনা তখন প্রায় স্থগিতের কাছাকাছি।
ইয়ে, একদিন ঐ অফিসের কাছে গিয়েছিলাম বলে অফিসটি চিনি, নইলে আমি এদিককার রাস্তাঘাট খুব একটা চিনি না, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের অবস্থাটা ব্যাখ্যা করলো সে। উত্তর এলো একটি বাক্যে, তাই!
তাতে কিছুই বোঝা গেল না। বিশ্বাস করলো না নাকি নিজের চেয়েও বড় বেকুবের সাহায্য চেয়ে নিজের ওপর বিরক্তি দেখাচ্ছে পরিষ্কার হলো না। উত্তরের আশায় মুখের দিকে তাকালো সে। রহস্যের হাসি সেখানে।
অবশ্য মিনিট খানিকের বেশি তাকে রহস্য নিয়ে ভাবতে হলো না। ‘ওয়েল, আমি . . .’ কি যেন একটা নাম বলে মেয়েটি নিজের পরিচয় জানালো। উচ্চারণের ব্যতিক্রমের কারণেই হয়তো নামটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। দ্বিতীয়বার গুনতে চাওয়ার আগ্রহ জানালো না সে। সেই ‘কি একটা’, তাই সই। ততক্ষণে মোড়ের আগের সিগন্যালে জমে ওঠা জ্যামটা দীর্ঘতার আভাস দিল।
অন্য যে কোন সময়ে বিরক্তিকর মনে হওয়া জ্যাম এখন তাকে স্বর্গীয় স্বস্তি দিল, এ শহরের সবচেয়ে অসহ্য বৈশিষ্ট্যটাও আজ ইতিবাচকতার ছোঁয়া আনলো। সেদিক তাকিয়ে নড়ে চড়ে বসলো সে। গলায় যদ্দুর গাম্ভীর্য আনা সম্ভব এনে নিজের নাম জানালো অপরপক্ষ তার মত না শুনে অ’ বলে পরিচিতির ইতি টানলো না, বরং প্রাসঙ্গিকভাবে এলো তার পেশাদারিত্ব আর কর্মপদ্ধতি। বলতে ভালো লাগলো।
একেবারে অপরিচিত বা অল্প পরিচিত কারো কাছে পেশা নিয়ে কথা বলাটা অস্বস্তিকর। অথচ এখন হয়তো কথা বলার উপলক্ষ ধরে একেবারেই অপরিচিত একজনের কাছে অকপট হয়ে গেল সে। এমন কি পেশার ক্ষেত্র পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা নিয়েও কথা বললো, বলতে বলতে সতর্কও হলো একবার, আমি আপনাকে বিরক্ত করছি না তো! না না বলুন, প্লিজ। নতুন অনেক কিছুই জানছি, ‘কানে যেন সুধা ঢুকলো। আর তাতে প্রসঙ্গ পাল্টে স্বভাব বিরুদ্ধ প্রগলভতা দেখালো সে, আপনার গলাটা খুব মিষ্টি! প্রতিক্রিয়া হিসেবে চমকে তাকানো অবাক দৃষ্টিটা অপরাধী করলো তাকে, সরি!
রোদ বৃষ্টির খেলা যেন অপরপক্ষের প্রতিক্রিয়ায়। তার অপরাধী মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি ফুটলো সেখানে। ‘সরি বললেন কেন, তার মানে কথাটা ঠিক নয়, তাই তো!’ আর পরিবেশ সচেতনতা বোঝাতেই যেন বিরক্ত মুখে জ্যামের দিকে তাকিয়ে থাকা ড্রাইভারের দিকে তাকালো এক পলক।
নাহ্ ইয়ে, ধাতস্থ হতে চেষ্টা করলো সে, কথাটা তো একশ বার সত্যি কিন্তু বলাটা হয়তো ঠিক হয় নি, বলে তাকালো সে অনুমোদনের হাসি দেখে আরেক ধাপ এগোলো, আপনি দেখতেও খুব . . ., বলেই আবার আবার ঢঙে থেমে গেল।
তবে এবার আর সরি বলল না, চোখে চোখে তাকানো মুখটার নিঃশব্দ হাসিতে ভেঙে পড়া তাকে সাহস যোগালো। বিষয়টাতে স্থিরতা বোঝাতে পাতা উল্টে যাওয়ার মত সে স্বাভাবিক কৌতূহলটা দেখালো, এ সময়ে ঐ অফিসে কেন যাচ্ছেন, এতক্ষণে তো সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।
অফিসিয়াল প্রয়োজনে যাচ্ছি না। ওখানে আমার মামাতো বোন কাজ করে, ওর গাড়িটা আজ গড়বড় করছে, আর এ গাড়িটা মামার আমি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আমিও ঢাকায় থাকি না, যে কারণে এখানকার অনেক কিছু চিনি না। আর এ গাড়িটা যিনি চালাচ্ছেন, বলে ড্রাইভারের দিকে ইঙ্গিত করল, উনিও এ কাজে যোগ দিয়েছেন মাসখানেক, আগে দেশের বাইরে কাজ করতেন। সেI বুঝতেই পারছেন কেন আপনার সাহায্য নিতে হলো’।
ব্যাখ্যাটা সন্তুষ্ট করলো তাকে, অবশ্য আপনি সরাসরি তাকে ফোন করেও দিক নির্দেশনা নিতে পারতেন। তার মন্তব্য শুনে পলকের জন্য থমকাল অপরপক্ষ। বোঝা গেল ঠিক এ দিকটা তার মাথায় আসেনি। অবশ্য তা ঠিক তবে তাকে তার অফিস থেকে তুলে নেব বলেছিলাম আমিই, ভিজিটিং কার্ড একটা ছিল, এরপর আর খোঁজ করতে অসুবিধা হবে মনে করি নি। অবশ্য আমার অনুমানটা উল্টো হয়েছে, মোড়ের এদিকে ভেবেছিলাম’।
‘এদিক-ওদিক একই কথা, জ্যাম না হলে দু’তিন মিনিটের রাস্তা। এখন যেটা ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে’। বলল সে, আমি তো এক নাম্বার থেকে হেঁটেই চলে আসি। তার এই স্বগতোক্তিতে হাসির কিছু ছিল না অথচ হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। প্রথমে হেসে ফেললো মেয়েটি, অবাক চোখে সেদিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো সে। হাসি বড় সংক্রামক। এমনকি ড্রাইভারের ঠোঁটেও হাসির আভাস মিললো।
পাতা উল্টে গেলেও পরের পৃষ্ঠায় কাহিনির রেশ থাকে, বুঝলো সে, হাসাহাসির বিষয়টা পারম্পর্য মেনেই হয়েছে। অতএব সেও ফিরলো আগের মুডে।
আপনাদের বাড়ি কোথায়, কথা চালিয়ে যেতে চাইল সে। কোনটা বাপের বাড়ি নাকি শ্বশুর বাড়ি, নিচু গলায় উচ্চারিত পাল্টা প্রশ্নটা তাকে চমকিত করলো, আর তাতে আবারো নিঃশব্দ হাসিতে ভেঙে পড়লো মেয়েটি।
‘আপনি একদম . . .’ হাসি থামিয়ে বললো মেয়েটি। যুতসই শব্দের অভাবে থামলো কয়েক সেকেন্ড, তারপর পেয়ে গিয়ে বাক্যটা সম্পূর্ণ করলো, ‘আপনি একদম ইনোসেন্ট টাইপ’।
কথাটা কোন সেন্সে বললেন বুঝতে পারছি না, কপাল কুঁচকাল সে। সেজন্যই তো বললাম, মৃদু হাসির সঙ্গে জবাব এলো, বেশি জানতে চাইলে পরে বলবো!
পরে . . . তার অবাক চাউনিতেও হাসির কারণ ঘটলো, ‘কেন সমস্যা আছে’। সমস্যার কি আছে, কিন্তু আমাকে পাবেন কোথায়?
তাইতো! এতো সাংঘাতিক সমস্যার বিষয়! দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো মেয়েটি, ঐ অবস্থায় কৌণিক চোখে তাকালো তারপর, ‘আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড বের করুন তো!’
অ, সে আদেশ পালন করলো। নাম্বার মিলিয়ে মিস কল দিল মেয়েটি, নাম্বারটা সেভ করুন নইলে তো আবার চিনতে পারবেন না। বলেই আবার হাসলো।
উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে মামাতো বোনটার মুখোমুখি হওয়ার আগে নেমে গেল সে। খানিকটা উল্টো চলে আসায় পিছু ফিরতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে। মোবাইলে একটি ফোন নাম্বার আর সদ্য অতীত হওয়া খানিকটা সময় তাকে যেন আরেক দুনিয়ায় পৌঁছে দিল। ইতোমধ্যে আঁধার হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে রোমাঞ্চিত হলো সে, প্রকৃতিতে এখন বসন্তই এসেছে।
17.02.2011