somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গন্তব্যের খোঁজে !

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রকৃত জীবনের সূচনা বলে যে দিনটার জন্য তার আশৈশব প্রতীক্ষা, সেদিনটাতেই নবনীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপের বোধটা শুধু একটা কারণে এলো না, দুই মহাদেশের ঘটনার পারম্পর্য তার মনকে বিক্ষিপ্ত করলো। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমাকে শুভ কামনা জানাতে ফোন করলাম, সাত সকালে ইথারে ভেসে এলো অরণ্যের গলা, আমার জন্যও একই কারণে দিনটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরমুহূর্তে নিজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা খোলাসা করলো, আজ আমি একটা চাকরি পেয়েছি। যদিও ব্যাপারটাকে চাকরি বলা যায় কি-না জানি না, চাকরিটা হলো পত্রিকার হকারগিরি। অবশ্য বাংলাদেশের হকারদের তুলনায় কাজটা কিছুটা আলাদা। আলাদা এ জন্য যে পয়সার বিনিময়ে পত্রিকা বিক্রির বিষয় নয় এটি। বিনামূল্যে পত্রিকা বিলানোই আমার কাজ। বাংলাদেশে লিফলেট বিলানোর মত এটি। নিউমার্কেট এলাকায় যেভাবে হারানো যৌবন ফিরে পাওয়ার জন্য অব্যর্থ ওষুধ কেনার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লিফলেট বিলানো হয় অনেকটা সেরকম।’ অরণ্য এরপর বেশ খানিক্ষণ হা হা করে হাসলো। হেসে ফেললো নবনীও। বিশাল ওভারকোট চাপিয়ে পেপার পেপার বলে চিল্লা পাল্লা করছে অরণ্য, ব্যাপারটা কল্পনা করে হাসতে হাসতে কেটে গেল সকালটা।
কিন্তু যখন দুপুরের আগে আগে সেদিন দেরি করে আসা প্রফেসরটার সাথে ইন্টার্নী জীবনের প্রথম রাউন্ডে সঙ্গী হলো, তখনই তার মন খারাপের অনুষঙ্গ মিললো। প্রথম দিনটা পড়েছে কার্ডিওলজী ডিপার্টমেন্টে। বড় মারাত্মক জায়গা। রাউন্ডে যাবার আগেই অন্তত: দুজনকে পরপারে চলে যেতে দেখলো নবনী। যদিও হাসপাতালের জন্য, বিশেষত: এ ডিপার্টমেন্টের জন্য বিষয়টা নতুন নয় তবু মনটা ভারি হয়ে গেল।
দু দুটো মৃত্যুর ঘটনা মনকে যতটা খারাপ করলো না, রাউন্ডে গিয়ে অনেক বেশি বিষণ্নবোধ করলো নবনী। ফ্লোরে শুয়ে থাকা একজনের পাশে উবু হয়ে বসলেন প্রফেসর। ফাইল দেখতে দেখতে লোকটার দিকে তাকালেন এক পলক, কি কাজ করেন?’ হকারি করি, পত্রিকা বেচি, লোকটা উঠে বসার চেষ্টা করলো। ‘অ, কখন অসুস্থ হলেন, তাকে ঠেলে শুইয়ে দিলেন প্রফেসর। তারপর দুয়েকটা গতানুগতিক প্রশ্ন করলেন তিনি, চিকিৎসার প্রয়োজনে। কিন্তু নবনীর কানে ঢুকলো না কিছু, যেন সে হঠাৎ করে বধির হয়ে গেল। কানে গেঁথে গেলো, শব্দগুলো, অনুরণন তুলতে লাগলো হকারি করি পত্রিকা বেচি, যতক্ষণ রাউন্ড চললো, অরণ্যের মুখটা বার বার মনে পড়তে লাগলো। এখানটাতেই নিণীত হতে পারে মানুষের স্বার্থপরতা। অন্যের জন্য যতই সমব্যথীতার কথা বলি না কেন, অন্যের সর্বোচ্চ কিছু ও গৌণ হয়ে যায় ন্যুনতম নিজস্বতার কাছে।
মন আর মুখের দুরত্ব এখনো খুব কম, মানসিকতা সহজেই প্রতিফলিত হয় অভিব্যক্তিতে। কিরে হঠাৎ কি হলো তোর, মুখটাকে সদ্য চুলা থেকে নামানো হাঁড়ি করে ফেললি কেন, রাউন্ড শেষে শান্তনু জিজ্ঞাসা করলো। হেসে ফেললো নবনী, শান্তনুটা বরাবরই এমন সব অদ্ভূদ কথা বলে। সদ্য চুলা থেকে নামানো হাঁড়ি, মিনিট কয়েক বিশ্লেষণ চললো কথাটা নিয়ে। কিন্তু এর উৎপত্তির উৎস যা, সেটা নিয়ে আর কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। তবু এর রেশ যে অস্বীকার করা গেল না তার প্রমাণ হেলে যাওয়া দুপুরে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসার সময় নবনীর চোখটা চলে গেল ঐ ফ্লোরে পড়ে থাকা হকারটার দিকে। সঙ্গী সাথীরা সঙ্গে থাকায়, তাছাড়া আলাদাভাবে আবার ওখানে যাবার মত কোন অজুহাত না পাওয়ায় তখনকার মত অন্যদের সাথে বেরিয়ে আসতে হলো। কিন্তু ঘটনার পারম্পর্য মাঝরাতে তাকে হঠাৎ করে কাঁদিয়ে ফেললো।
তারিখ বদলের খানিকক্ষণ আগে ফোন করলো অরণ্য ‘‘তোমার প্রথমদিনটা কেমন কাটালো জানার জন্য ফোন করলাম। মোট ক’জনকে ইনজেকশন দিতে গিয়ে হাতের বদলে মাথায় পুশ করেছো সত্যি করে বলো। আর ক’জন রোগী তোমাকে দেখতে দেখতে ট্যারা হয়ে গিয়েছে সংখ্যাটা জানতে চাই।’ অরণ্যের হালকা মেজাজ নবনীকে, অনেকটা নির্ভার করে দিল। যেই শুনলো কার্ডিয়াক ডিপার্টমেন্টে পড়েছে প্রথম দিনের ডিউটি, আবারো ফাজলামি, করলো অরণ্য, এই রে তোমার মত সুন্দরীর তো হার্টের পেসেন্টদের কাছে যাওয়াই উচিত না। যাগগে দায়িত্ব যখন পড়েছে কি আর করা, তবু একটু দুরে দুরে থেকো, নইলে হার্ট ফেলিওরের সংখ্যা পটাপট বেড়ে যাবে।’ অরণ্যর ফাজলোমো থামিয়ে যখন প্রথমদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেল, হকারটির কথা আসামাত্র কেঁদে ফেললো নবনী। অরণ্যের কাছে লুকানোর কিছু নেই। পেশার যোগসূত্রের কারণে মন ভারি হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করলো নবনী। অরণ্যের গলা ফাটালো হাসি যদিও তাকে খানিকটা বিব্রত করলো তবু এ বৃষ্টি যেন সারাদিনের গুমোট ভাব কাটিয়ে দিল।
ঘণ্টা খানেক পর আবার ফোন করলো অরণ্য। ততক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল নবনী। তার জড়ানো গলার হ্যালোর জবাবে হাসলো অরণ্য, ‘পুরোপুরি জেগে উঠো তারপর একটি কথা বলবো।’ চটজলদি উঠে বসলো নবনী, বলো। ‘আই হ্যাভ গট দ্য ম্যাসেজ, ইনফ্যাক্ট এখানকার জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কিংবা সংগ্রাম করার জন্য যে অনুপ্রেরণার দরকার তার জন্য নিজস্বতা যথেষ্ট নয়। থ্যাংকস ফর ইয়োর বিহেভ, এখন ঘুমোও।’ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেটে দিল অরণ্য।
পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি, নতুন জীবন কর্তব্য বোধের নতুনত্ব নিয়ে তাড়া লাগালো না। সকালে উঠে অরণ্যর কথা নিয়ে ভাবার ফুসরৎ মিললো। বিরাট আশা নিয়ে ইউরোপ পাড়ি দেয়া অরণ্য আগেও দুয়েকবার তার প্রবাস জীবন নিয়ে অতৃপ্তির কথা বলেছে কিন্তু কাল রাতে ঘুম ভাঙিয়ে যা বললো তা যেন আরো অনেক বেশি। অরণ্যর মুখটা মনে পড়লো আর বুকের মধ্যে জমে গেলো এক থম ধরা কষ্ট। সেই উচ্ছ্বল ছেলেটা অনুপ্রেরণা খুঁজছে কি না তার কাছে। নিজেকে বড় ভাবতে যে কারো ভালোলাগার কথা, সেই মায়াময় চোখ দুটো বেঁচে থাকার উৎস বানিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, ভাবতে ভাবতে সকালের অনেকটা পার করে দিল নবনী। বিছানা ছাড়ার আগে তাই, তোমাকে অনুভব করছি তোমার অনুপস্থিতি ছুটির দিনগুলোতে নিষ্কর্মা বানিয়েছে জাতীয় কয়েক লাইন লিখে এসএমএসও করলো অরণ্যের কাছে। গতরাতের আগে কখনো এভাবে বলেনি, এমনকি পরিচয়ের পর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সেই আবহকালীন সময়েও এতটুকু তরলতা মেলেনি অরণ্যের আচরণে। আবার মনটা কেমন করে উঠলো, নিশ্চয়ই বেচারা খুব নি:সঙ্গ বোধ করছে। পর মুহূর্তে মনকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করলো, ওখানে ওর কম করেও কুড়ি পঁচিশজন বন্ধু আছে-আনন্দেই থাকার কথা।
বিশেষত: ইংল্যাণ্ডে ছাত্র ভিসার বিষয়টা সহজ হয়ে উঠার পর থেকে বন্যার পানির মত এদেশ থেকে আদম পাচারের বিষয়টা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিসের ছাত্রত্ব, কিসের পড়ালেখা। ওখানে যাওয়া বেশীরভাগের লক্ষ্য নাকি স্রেফ চাকরি। হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে যাওয়া একজনের উদাহরণ দিয়েছিল অরণ্য, ছয়মাস কেটে যাওয়ার পরও যে একদিনের জন্যও নিজের কলেজ দেখতে যায়নি, এবং যার দিনকেটে যাচ্ছে মূলত: রেস্টুরেন্টগুলোতে ডিস পরিষ্কার করার কাজ করে। করুকগে, যে যার মত চলুক। নবনী ভাবলো অরণ্যকে নিয়ে। বেচারা যে ব্যারিস্টার হতে গিয়েছে সেটাতো ইংল্যান্ড থেকেই পাস করতে হবে, সূতরাং সমস্যাটার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। এদেশে করা সম্ভব এমন কোন সাবজেক্ট হলে অরণ্যের যাওয়াটা বাতিল করে দিত নবনীই, কিন্তু এখনতো মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
তার সহপাঠী অপুর নাকি মেয়ে বেলার স্বপ্ন ইংল্যান্ডে গিয়ে সার্জন হয়ে আসার, সেদিন ক্যাফেটেরিয়ায় বসে জানালো সে। কিন্তু আমার মামাত ভাই যাওয়ার দু সপ্তার মাথায় সগৌরবে ফেরত এসেছে, এমনভাবে হাসছিল অপু যেন বিষয়টা খুব মজার, অতএব আপাতত আমার ট্যাং আর ওমুখো হচ্ছে না, ঘোষণার সুরে জানালো অপু। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক বার বার এ বিষয়টা শুনতে হচ্ছে বিভিন্ন আলোচনায়। ইদানীং তারুণ্যের টকিং সাবজেক্ট বোধ হয় এটাই। টক অব দ্য কান্ট্রি!
বিশেষত: তরুণ প্রজন্ম যে এ ঘোরে পড়েছে দিন কয়েক পর নিজের মামাত ভাইয়ের কথায় বুঝলো নবনী। এখনো অনার্সে পড়া ছেলেটা যেন আরো বেশি আপ ডেটেট। উৎসাহ নিয়ে বলে চলা তার তথ্যগুলো গভীর মনযোগ দিয়ে শুনলো নবনী। মুদ্রার উজ্জ্বল দিকটি দেখে উৎসাহিত প্রজন্মের যেন প্রকৃত প্রতিনিধি সে। টেমস নদীর তীরে হাঁটার যে অগ্রীম বর্ণনা দিয়ে দিল, অনেক দিনের স্বপ্নচারী না হলে তা কল্পনায় আনা কষ্টকর। কোন ঐতিহাসিক স্থাপত্যের উপর উঠলে লন্ডন শহরের পুরোটা দেখা যায় তা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছে এরা। আমার পাশে থাকা সুইস মেয়েটা তখন বলবে...’ কি বলবে সেটা না শুনেই হেসে ফেললো নবনী। এখন হাসছ, তখন বুঝবে, কাঁধ ঝাঁকালো স্বাপ্নিক ছেলেটা। বয়সের কারণে শুধুই আলোর উৎস খুঁজে বেড়ায় এরা, অন্ধকারের অস্তীত্বই এদের অজানা। কখনো জীবনের ঐ দিকটার মুখোমুখি হলে সেই হারানো অসহায়ত্ব তাই এদেরকেই বেশি দিশেহারা করে।
আচ্ছা তোমার কোন বন্ধু-বান্ধব আছে নাকি ওখানে, শেষ মুহূর্তে প্রশ্ন করলো মামাতো ভাই। ইতোমধ্যে নাকি কাগজপত্র জোগাড় করে ফেলেছে, অতএব যাত্রাটা সময়ের ব্যাপার। সাথে সাথে বেশ কিছু অবাক করা তথ্যও দিল সে। নগরীর একটি কনসালটেন্সী ফার্মের কথা বললো, যারা নাকি প্রকাশ্যেই বলছে, মাথা পিছু চার লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে ঢুকতে সাহায্য করবে। তারপর তাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। তারপর? জিজ্ঞাসা করলো নবনী। কোন উত্তর নেই, জানাও নেই। এরপরের চিন্তা করার মানসিকতা এদের নেই, চিন্তা শক্তি ও হয়তো নেই।
অরণ্যের কথা বলা গেল না। সমাজ, এখনো এতটা উদার নয় যে, অঘোষিত কোন সম্পর্কের কথা আত্মীয়স্বজনকে জানানো যাবে, মনের মধ্যে যে একটা খচখচানি পড়ে উঠেছিল। ‘পাশে থাকা সুইস মেয়েটা তখন বলবে..’ মনে পড়তেই উবে গেল তা। কসমোপলিটন শহর হিসেবে পরিচিত লন্ডনে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের নাগরিকদের পদচারণা, এরমধ্যে আলাদা করে সুইস এর কথা আসলো কেন? কারণটা হয়তো চমকে যাওয়ার মত কিছু নয়। স্রেফ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারণে সে দেশের কেউ বিশেষত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে একজন সদ্য তরুণের মনোজগতে। নবনীর অনুমান সত্য হলে তো মুগ্ধতা জীবনবোধের পরিচালকের রূপে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বাস্তবতার ব্যাপারটাই অনুপস্থিত।
সেদিন বাসায় ফিরে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত বলে বিশ্বাস করা জাতীয় সে দৈনিকটির বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখলো নবনী। সারা পত্রিকায় শুধু যেন এই বিষয়েরই প্রচারণা। গুণলো সে, বিভিন্ন জাতের মোট ছাব্বিশটি বিজ্ঞাপন। প্রত্যেকটির ভাষা চলে যান ওখানে, অলিখিত ভাবটা হলো এদেশে থেকে জীবনটা কেন বরবাদ করবেন।
ব্যাপারটাকে অনেকটা আগুনের শিখায় পতঙ্গের ঝাঁপিয়ে পড়া বলে মনে হলো তার। বিষয়টা যেহেতু মোটামুটিভাবে জাতীয় সমস্যার পর্যায়ে পড়ে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোটা তাই আঁতলামি বলে মনে হলো তার। কিন্তু আবার যখন অরণ্যের কথা মনে হলো, বিষয়টা নিজের হয়ে পড়লো। শুনে নয়, মুখোমুখি হওয়া সমস্যা-গুলিই মানুষ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে।
নবনীও করলো। উচ্চ মাধ্যমিক একসাথে পড়া যোশেফটা এ যুগের ইবনে বতুতা। ইদানীং নাকি আবাস গেড়েছে প্যারিসে। মাঝে মধ্যে দেশে আসে বলে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যায়নি। তাছাড়া বর্তমানের ইন্টারনেটের যুগ, যোগাযোগ মাধ্যমের অভাব ঘুচিয়েছে। ফেইসবুকে মাঝে মধ্যেই জানান দেয়, পেরুতে তার অনুভূতি কি হলো কিংবা টেক্সাসের কাউবয় জীবনটা কতটুকু সিনেমার বাইরে বলে মনে হয়েছে তার। ভেনিসের লেক ছুঁয়ে থাকা হোটেলটার দোতলার জানালার পাশে বক্সে সারাদিন কাটানোর পর কি জাতীয় ঘোরলাগা অনুভূতি আচ্ছন্ন করেছিল কিংবা হিমালয়ে হেলিকপ্টার থেকে বরফ দেখতে কেমন লাগে সে সবও ইতোমধ্যে ফেইসবুকে দেয়ালের শোভা বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী পিতার কনিষ্ঠ সন্তানটির একাডেমিক পড়ালেখা ছাড়া সবকিছু ভালোই চলছে।
সেই যোশেফকে স্মরণ করলো নবনী। ফেইসবুকে নয় বরং মেইল পাঠিয়ে জানতে চাইল বহির্বিশ্বের প্রকৃত অবস্থা। জবাব আসতে তিন ঘণ্টাও লাগেনি। তবে সুখকরও লাগেনি জবাবটা। প্রশ্নটা যদিও পৃথিবী সংক্রান্ত ছিল উত্তরও এলো সেভাবে। আবার খানিকক্ষণ পর মোবাইলে ফোনও করলো। আগেও যে একেবারে করেনি তা নয়, তবে এবার কথা বললো দীর্ঘক্ষণ, আধ ঘণ্টারও বেশি।
মাত্র চৌদ্দদিন আগে নাকি সে লন্ডন থেকে প্যারিসে গেছে। কি কাজে ওখানে গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করাটা অপ্রয়োজনীয়, যে কারণেই যাক, অরণ্যের সাথে দেখা হওয়ার কথাটা ও জানালো। সেই দেখা নাকি দূর থেকে, পরস্পরকে দেখেছে কিন্তু কথা হয়নি। হয়তো সে কারণে দেখা হওয়ার কথাটা বলেনি অরণ্য। যাই হোক, সদ্য প্রত্যক্ষদর্শী অভিজ্ঞতা জানালো যোশেফ, বললো বিশেষত বাঙালি, পরিচালিত কলেজগুলোর গণহারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। শত শত ছাত্রের ছাত্রত্ব চলে যাওয়ার কথা এবং হঠাৎ করে এদের অসহায় হয়ে পড়ার কথাও বাদ গেল না।
ফোন ছাড়ার পর খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল নবনী। বোঝা যাচ্ছে এমনকি অরণ্যও তার কাছে অনেক কিছু গোপন করেছে। কেন করলো ক্ষোভটা অবশ্য বেশিক্ষণ টিকলো না। টেনশনে ফেলতে চায়নি বলেই নেতিবাচক দিকগুলো জানায়নি। এভাবেই অন্ধকারে রয়ে যায় অন্ধকার দিকগুলো। প্রচারের আলো কখনো নাগাল পায় না এসবের। দুশ্চিন্তা আর উৎকক্তার আশংকা পৌনপুণিকতার সূত্র ধরে অন্ধকারকেই প্রদীপ শিখা বলে বিভ্রম জাগায়। ঝাপের সংখ্যাও তাই অবিরত।
এরমধ্যে অবশ্য সাময়িকভাবে স্টুডেন্ট ভিসার ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটা উঠে গেছে কি-না নিশ্চিত মনে করতে পারলো না নবনী, তবে আর কোথাও এর প্রভাব পড়ুক বা না পড়ুক সরাসরি প্রভাবটা পড়লো পত্রিকার বিজ্ঞাপনে। এরমধ্যে ইউকে’র জায়গাটা দখল করেছে অন্য কোন দেশের নাম। এখনো নির্দিষ্ট করে বলার মত কোন নাম একচেটিয়াভাবে জায়গা দখল করেনি, বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় পুরো পৃথিবীটা চলে আসছে। অন্তত: এই একটি ক্ষেত্রে এদেশে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার প্রচারণা চালানো হয়, স্পন্সরশিপের সহায়তার কথা বলে, অথচ কেউ খবর রাখে না এর।
সেদিন আরেকটি দৈনিকে অন্য ধরনের একটি খবর দেখলো নবনী। এক দেশে পাঠানোর কথা বলে আরেক দেশে পাঠিয়ে দেয়া এক যুবকের সংবাদ। বেচারা এখন সেদেশের কারাগারে। খবরটা নিয়ে অপুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। গুরুত্বই পেল না, আরে দুর, ওরকম ঘটনাতো হাজার হাজার ঘটছে। এটাকে এত গুরুত্ব দেয়ার কি আছে।’
তাই বুঝি? অপুর ভাবলেষহীন প্রতিক্রিয়াই। বরং তাকে বিস্মিত করলো। বন্ধু মহলে অরণ্যের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা স্বীকৃত। অপুও অরণ্যের উদাহরণ টানলো ‘আসলে অরণ্য বাইরে তো, তাই বাইরের খবরগুলো তোর নজরে পড়ছে, আগে এড়িয়ে যেত।’ হতে পারে! ইদানীং এসব খবর টবর যত শোনে বা দেখে অরণ্যের জন্য চিন্তাটা তত বেড়ে যায়।
কয়েকদিন পরেই অবশ্য নবনীর দুশ্চিন্তার সীমারেখা টেনে দিল অরণ্য, ‘অন্যরকম একটা ব্যাপার ঘটে গেছে।’, হাসতে হাসতে বললো সে, আমার কলেজের লাইসেন্সটা সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিছু না বুঝে থমকে গেল নবনী, মানে কি! মানে আর কিছু না, ফোনের ওপাশে যেন অরণ্যের নিশ্চিন্ত গলা, আমার কলেজটা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কি সব হাবিজাবি কর্তৃপক্ষীয় নিয়ম মানেনি, তার জন্য শাস্তি হিসেবে কলেজটাই বন্ধ করে দেয়া হলো। শুধু আমারটা নয় এখানে বন্ধ করে দেয়া কলেজের সংখ্যা অনেক।
তোমার পড়ালেখা। নবনী যেন আর্তনাদ করে উঠলো।’ একেবারে সেন্টার পয়েন্ট অব দ্য কিচেন। হা হা করে হাসলো অরণ্য, আপাতত: চুলোয় গেছে।’ এরপর যতক্ষণ কথা হলো কারণে অকারণে হেসে চললো সে, যেন বোঝাতে চাইছে কত নির্ভার। নবনী বুঝলো উল্টোটা, হয়তো প্রকৃত অবস্থাই দ্বিতীয়টা।
অনুমানটা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্বীকৃতি পেলো। পরের রাতে অনেকটা অকপট অরণ্য, জানালো স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়ে কর্মজীবী হয়ে পড়াদের পাশাপাশি কত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে মেয়ের এখন পথে পথে ঘোরার অবস্থা। একুল ওকুল দু কুল হারানোর অবস্থা নিয়ে এখনও টিকে আছে সেখানে। কেন যে সবাই এদিক সেদিক না ভেবেই দৌঁড় দেয়!’
আক্ষেপ করলো অরণ্য, ‘অথচ এরাই দেশে থাকলে অনেক কিছু করতে পারতো।’
কথাটা অরণ্যের জন্যও প্রযোজ্য। ওখানে যাওয়ার আগেই বেশ গুচ্ছিয়ে নিয়েছিল সে। এখন মনে হচ্ছে খামাকাই সবকিছু ছেড়ে চলে গেল।
যাই হোক আমার কলেজ আপীল করেছে, দোয়া করো যেন নিষাধাজ্ঞাটা উঠে যায়, দুয়েকদিনের মধ্যে রেজাল্টটা জানা যাবে।’ ফোন ছাড়ার আগে জানালো অরণ্য।
পরের সকালের দায়িত্বের কথা মাথায় রেখেও দীর্ঘদিন পর রাত জাগলো নবনী। উল্টো পাল্টা হাজারো চিন্তার পর সে যখন ওপর অলার উদ্দেশ্যে দু হাত জড়ো করলো, কি আশ্চর্য! তার কামনাটা বদলে গেলো। তার প্রার্থনাটাও শুধু অরণ্য কেন্দ্রিক থাকলো না। অরণ্য’র প্রার্থিত মতে নয়, সে কামনা করলো উল্টোটা, ‘হে প্রভু, এই পুরো জেনারেশনটার মোহ যেন কেটে যায়, তাদের গন্তব্য যেন বিক্ষিপ্ত না হয়ে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আর গন্তব্যটা নির্ণীত হোক এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ব দ্বীপে।

# অনেক আগে লেখা
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×