কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে
বাপ্পী পাল
পরিচয়ের পর তার প্রথম কথাটি ছিল, আপনার মনে হয় গুল মারার অভ্যাস আছে, তাই না? ওখান থেকে বেশ কিছুক্ষণ আপনার বকবকানি শুনছি তো, তাই বললাম!’ একেবারে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসা, যেভাবে আমরা পরস্পরের কুশল জানতে চাইতে পারি। ক্যাম্পাসে বসে আগের দিন পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে হওয়া অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাচ্ছিলাম বন্ধুদের, সে যাত্রার দু’জন সঙ্গীও তখন উপস্থিত। সুতরাং গুলতানির কোন সুযোগ ছিল না। তাছাড়া আমার যাবতীয় চেষ্টা তখন নিজেকে বিপরীত রূপে উপস্থাপনের। যদিও কয়েকজন আঁতেল বন্ধুর সংস্পর্শে এসে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ভারি ভারি কথা বলার চেষ্টা করে কারো কারো বিরক্তির কারণ হতে পারি, রাত জেগে পড়াশুনা করে সকালে এসে এইসব পুঁথিগত পড়ালেখা আমাদের কোন বাস্তব কাজে লাগবে কিনা সন্দেহ জাতীয় মন্তব্য করে কারো কারো উষ্মারও কারণ হতে পারি। কিংবা কোন সুন্দরী বালিকার দিকে অন্যদের তাকাতে দেখে এসব আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বয়সের আগে বুড়া হয়ে গেছি জাতীয় ব্যঙ্গ শুনতে পারি, অথবা বাস্তবতার তুলনায় কিছুটা কমিয়ে বলার চেষ্টা করে এতো আরেক চিজ হয়ে গেছে টাইপের শ্লেষ শুনতে পারি। কিন্তু সদ্য পরিচিতা কারো মুখে আমার আচরণ বা চিন্তা বিপরীত গুলতানির অভিযোগ আমাকে বিপর্যস্ত করলো, আমি বিপন্ন দৃষ্টিতে আমার সঙ্গীদের দিকে তাকালাম। দুর্ভাগ্য সমব্যথী জুটলো না একটাও। বরং আমাকে বিষণ্ন করে দিয়ে আমার ভ্রমণের দুই সঙ্গী, পরস্পরের দিকে মাত্র একবার তাকিয়ে, অতি রঞ্জনের জন্য আমাকে অভিযুক্ত করলো এবং তাৎক্ষণিকভাবে তার সাথে একমত হয়ে গেল। যন্ত্রণাদায়ক পরবর্তী আধ ঘণ্টার আড্ডার রেশ আমাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেকদিন। তবে সৌভাগ্য, পরবর্তীতে রেশটা টানার জন্য যা কিছু শুনতে হয়েছে, তাতে সহ শ্রোতা থাকতো না। যা শোনার শুনতাম একা। যার বিভিন্নমুখি রেশ পরবর্তীতে সহস্র সুখস্মৃতি উৎপাদনের ফল্গুধারায় পরিণত হয়েছিল। সেদিন আমার বন্ধুরা যখন অবশেষে তোরে পাওয়া গেল বলে চারদিক থেকে বিভিন্নমুখি আক্রমণ শুরু করলো, সেদিনের কথা ভাবলে এখন হাসি পায়, তখন আমার বিব্রত ভাব বেড়ে চলেছিল পৌনপুণিকভাবে। সাধারণতঃ মেয়েদের এড়িয়ে চলা আমার তাৎক্ষনিক চিন্তা ছিল বাইরে সুন্দর হলেও মেয়েরা এমনই হয়, একেবারে খাপ ছাড়া তলোয়ার, মানুষকে খোঁচানোর কাজে লাগে তা। অথচ ফেরার পথে সবাইকে বাদ দিয়ে, আপনার বাসা তো ওদিকেই চলেন একসাথে যাই; বলে আমাকে তার রিকশায় তুলে নিল। আমার বাসা যে ওদিকে সেটা সে জানলো কিভাবে সে প্রশ্ন করে নতুন করে বিপদ না ডেকে আমি তার অনুগামী হয়েছিলাম। আধ ঘণ্টার সেই যাত্রা আমাকে বুঝিয়েছিল তলোয়ার নয় তারা মলমও হতে পারে, অন্ততঃ আমার মনে কোন ক্ষত রইল না। ‘কিরে রিকশায় কি পড়েছিল, মলম না মরিচ, পরদিন ক্যাম্পাসে এক সহপাঠির জিজ্ঞাসার জবাবে আত্মবিশ্বাস ভর করেছিল, জবাব দিয়েছিলাম আজ ফেরার সময় দেখবি। আমার বিশ্বাস ছিল, সেদিনও সে আসবে তার রিকশার সহযাত্রী বানাবে। অন্ততঃ সেদিন নিরাশ করেনি। ঠিকই এসেছিল সে। ‘আমার জন্যই তো অপেক্ষা করছেন মনে হয়’। কৌনিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল সে। নইলে ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দু’ঘণ্টা বসে আছেন কি বুঝে’! আমার একটিই ক্লাস ছিল সেদিন, তাও শেষ হয়েছিল দু’ঘণ্টা আগে, সব কথা ঠিক। কিন্তু সে জানলো কেমনে সেকথা আর জিজ্ঞাসা করা হলো না। সে কথা জানতে চাইলে আবার কি না কি বলে বসে কে জানে। তখনো উপস্থিত আমার জনা দুয়েক সহপাঠি সে-ই কিনা কি’টা যদি শুনে ফেলে তাহলে আর রক্ষা নেই। বর্তমানে প্রবাস জীবনে নিজেদের পেশার বিশেষজ্ঞ হতে যাওয়া এ দু’জনে তখন এ বিষয়েই বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর রিকশায় যখন কথাটা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি তো আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, তাই না’? মেজাজটা আর নিয়ন্ত্রণ করা গেল না। নিকুচি করেছে একসাথে ফেরার। আমি রিকশা থেকে নেমে গেলাম। কি আশ্চর্য! সে আমাকে আটকানোর কোন চেষ্টাই করলো না, কিংবা সরি টরি জাতীয় কিছু বলে পরিস্থিতি হালকা করারও কোন চেষ্টা করলো না। অবাক ব্যাপার, মেজাজটা ঠান্ডা হওয়ার পর যে আশংকাটা করলাম, সেটাও সে করলো না। ব্যাপারটা অন্যদের কাছে পুরোপুরি চেপে গেল। পরের দু’দিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে আসলো না। তিনদিন পর যখন দেখা হলো, তাও স্টেশনে, প্রথমে এমনভাব করলো যেন কিছুই হয় নি। আমরা বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, সেখানে এসে উবু হয়ে বসলো, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে। তার পুরনো বান্ধবী, আমাদের সহপাঠিনী রিনি যখন তাকে বসতে বলল, নাহ হাঁটতে ইচ্ছে করছে বসবো না বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। পরমুহূর্তে আমার দিকে তাকিয়ে কি খবর প্রতিবেশী, চলুন হেঁটে আসি’ বলে সরাসরি আমাকে ইঙ্গিত করলো। এ ধরনের মুহূর্তগুলোতে দ্বিতীয় কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না, কেউ আলাদা চোখে তাকালো না, আমি তার অনুগামী হলাম। তো মিস্টার হাফ, আপনি কি সব সময় অর্ধেক রাস্তাই যাবেন, কদ্দুর গিয়ে সরাসরি কথাটি পাড়লো সে। হাফ! সম্বোধনটা আমাকে হতচকিয়ে দিল। শোনার দূরত্বে আর কেউ না থাকা সত্বেও আমি চকিত চোখে আশপাশে তাকালাম। একে ঘাঁটালে আরো কি বলে তার কোন ঠিক নেই। এখন হাফ বলেছে আরেকটু হলে সবার সামনে কোয়ার্টার টোয়ার্টার বলে বসতে পারে। শংকাই আমাকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিল, ইয়ে আমাকে কি সরি বলতে হবে? নাহ্, সরি কেন বলতে হবে, যেন খুব অবাক হওয়ার মত কথা বললাম, তবে আপনার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে! আমার আবার কোন ব্যাপার পরিষ্কার হলো, আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম’। বোঝা যাচ্ছে আপনি চাইছেন আপনাকে আমি তুমি করে বলি, ঠিক ঠিকাছে বলবো’। কোন মেয়ের মুখ থেকে সরাসরি এ ধরনের কথা শোনার অভিজ্ঞতা আগে হয় নি, আমার চারপাশে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেল। প্রায় বোধশক্তিহীন হয়ে যখন, চলুন একটু বসি বলে সৌজন্যতার তোয়াক্কা না করে রাস্তার পাশে গাছের নিচে বসে পড়লাম, সে হাসলো। প্রকৃতপক্ষে আমার হাঁটু তখন আমার ভার বইতে অক্ষম। আপনি কি কোন উল্টাপাল্টা ডিসিশানে পৌঁছে গেলেন নাকি, দু’হাত কোমড়ে দিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল সে, আমি তোমাকে তুমি বলবো তার কারণ তুমি আমার কাছে আপনি শোনার মত সম্মানিত থাকতে পারোনি, মিস্টার হাফ! তুমি তোমার মান অর্ধেকে নামিয়ে এনেছো! সেই মুহূর্ত থেকে সে আর কখনো আমাকে আপনি বলেনি। আমিও বলিনি। তবে আমার ব্যাপারটা ভিন্ন, আমি বলিনি নৈকট্য বোঝাতে। নৈকট্যের সূচক, সম্বোধনে নির্ণীত বলে সে কখনো স্বীকার করে নি। বলতো অন্ততঃ তার তরফ থেকে আমার জন্য সম্বোধনটা সম্মানের নির্ণায়ক। সে কি বলতো তাতে আমার কিছু আসতো যেতো না। আমি ভাবতাম আমার মত করে, বিপরীতটাও ধরতাম তাই। না ভাবারও কোন কারণ ছিল না। আমার বৃষ্টিতে ভেজার কাহিনী শুনে যদি কেউ বলে, আমারও খুব বৃষ্টিতে ভেজার শখ। এখন তো পারবো না, ভবিষ্যতে তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো, তবে তো তৃতীয় চিন্তা আসে না দ্বিতীয় চিন্তাই আসে। আমার সীমিত চিন্তা শক্তি সীমিত আকারেই ভাবাতো। কষ্টে সঞ্চিত অর্থ যখন কেউ পড়ন্ত বিকেলে দু’ঘণ্টা রিকশায় ঘোরার বিনিময়ে বিলিয়ে আসার সুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন যদি কেউ সে কথা শুনে সহযাত্রী হতে না পারার দুঃখটাকেই বড় করে তুলে নিজেদের রিকশা যাত্রার ভাড়া দিয়ে দেয় সেক্ষেত্রেও দ্বিতীয় চিন্তাটাই আসে, আমি সেটাই ভাবতাম। কিংবা গোধুলী লগ্নে আমার একা একা হাঁটার অভ্যাসের কথা শুনে ভবিষ্যতে সেও সঙ্গী হওয়ার আগ্রহ জানায়, এখন হলে তো লোকে কথা শোনানোর সুযোগ পাবে বলে বর্তমানের অপারগতার কারণও জানায়, তখনো আমি ভাবালু হয়ে উঠতাম। যদিও তার যে কোন মন্তব্যের ফুট নোট থাকতো, আবার কোন উল্টাপাল্টা ডিসিশানে পৌঁছে যেও না। আমি একথা সাধারণ ভাবেই বললাম। তার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই আমার বদলে যাওয়া শুরু। তার মত অতটা সোজা সাপটা হওয়া সম্ভব ছিল না। আমি শুধু আচরণে আরোপনের চেষ্টাটা বাদ দিলাম। আমি যেমন সেটাও যে একটা মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে, মেনে নিলাম তা। আপনার গুলতানি করার অভ্যাস আছে কিনা জাতীয় জিজ্ঞাসা অবশ্য তারও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিল না, পারে স্বীকার করেছিল। স্রেফ আমাকে নাড়িয়ে দেয়ার জন্যই নাকি তার ঐ জিজ্ঞাসা। আমাকে নাড়ানোটা হঠাৎ দরকার পড়লো কেন তাছাড়া আমাদের পরিচয়টাও তো সেদিন প্রথম, সেদিন আমার প্রশ্নের জবাব দেয় নি সে। তবে আমার ধারণাটা পাল্টে দেয়ার মত রহস্য করেছিল, পরিচয় প্রথম কিন্তু তোমাকে চিনতাম আগে থেকেই। কিভাবে চিনতো কিংবা নাড়ানোটা দরকার হয়ে পড়েছিল কেন কোন প্রশ্নের জবাব দেয় নি। সোজা চোখে তাকিয়ে উঠে গিয়েছিল চুপচাপ। আরে জবাব দাও, আমি তো পাকা বড়ই গাছ নই। আমার তৃতীয় জিজ্ঞাসাও তার চলে যাওয়া বিলম্বিত করতে পারে নি। সে জবাব আজো পাইনি, হয়তো কখনো পাবো না। সেটা অবশ্য অনেক পরের দিকের কথা। ততদিনে আমি তার কখনো হুটহাট মুড কখনো ধীর স্থির চলাফেরা সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। পুরো সপ্তাহ দেখা না হওয়া সত্বেও তার চুপচাপ থাকাটা, যেমন স্বাভাবিক ছিল তেমনি দুপুরে এক ঘণ্টার ঘুম থেকে উঠে ছত্রিশটা মিসকল দেখাটাও স্বাভাবিক পর্যায়ে পড়ে গিয়েছিল। কিংবা রাতের তিনটায় মিসকল পেয়ে বিচলিত আমার কি হয়েছে জিজ্ঞাসার জবাবে তার নিচু গলার হাসি হাঁফ ছাড়া স্বস্তির যেমন পরশ বুলাতো তেমনি তারপর হঠাৎ তোমার গলা গুনতে ইচ্ছে করছে জাতীয় কথা আবেগেও ভাসিয়ে দিত। অথচ যাই ঘটুক অল্পক্ষণ পরেই মনে হতো স্বাভাবিক, সবকিছু স্বাভাবিক। কোন কিছু দেখার মধ্যে পুরোটা দেখার চেষ্টাও ছিল তার আরেক বৈশিষ্ট্য। একবার রাত একটায় ফোন করে ফিস ফিস করলো, একবার বারান্দায় যাও। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে বারান্দায় এসে উল্লেখযোগ্য কিছুই চোখে পড়লো না। শুনে আবার ফিসফিসানি, চাঁদটাকে দেখো। তাকালাম পুবদিকে, চাঁদের কোন চিহ্ন নেই। আকাশের চাঁদের কথা বলছো নাকি, ওখানে তো কোন চাঁদ নেই। আমার উত্তরে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিল সে। মধ্যরাতের ক্ষণ ভুলে যাওয়া গলায় বলেছিল, আকাশের চাঁদ না তো কিসের চাঁদ। আবার পরমুহূর্তে সামলে নিয়েছিল, তুমি কি আসলেই কোন চাঁদ দেখছো না! ‘কি আশ্চর্য! পুরো পুব আকাশটাই অন্ধকার, চাঁদ থাকবে কি ভাবে’! চাঁদ কি শুধু পুব আকাশেই থাকে, তার ক্রুগ্ধ গলা কানে আসার সাথে সাথে দৃষ্টি বোলালাম এ পাশ ওপাশ। হেলে পড়া নিস্তেজ ফালিটা চোখে পড়লো। আবার পরদিন পরীক্ষার মত জিজ্ঞাসা, চাঁদের আকার আকৃতি কেমন ছিল। ওটা ফালি নাকি আধি, আধিটা কতটুকু? তবু আমার উত্তর নাকি অসম্পূর্ণ অনির্দিষ্ট। সেই যে পরীক্ষা নেয়া শুরু, এরপর সেটা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়েছিল সবকিছুতে। হঠাৎ কোন মানুষের দিকে তাকানোর পর আমাকে বলতে হতো লোকটির উচ্চতা রং পোশাক চুল ইত্যাদি। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন আসতো জুতো পরেছে না স্যান্ডেল পরেছে। এই খুঁটিয়ে দেখার ব্যাপারটা আমার কোন কাজে লাগবেও না হয়তো, কিন্তু এটা এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখনো আমার কোন বন্ধু যখন কোন সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য দেখে, মানুষের দৃষ্টিতে, সে সময়ে আমার চোখ রোবট হযে যাচাই করে পরিপার্শ্ব। প্রতিনিয়ত আমার বিচ্যুতি ঘটে মানুষ পরিচিতি থেকে, ইদানীং অনেকেই আমাতে বিরক্ত। তার জন্মদিনে সারাদিন স্বাভাবিকভাবে আমার সাথে ঘোরার পর মাঝরাতে ফোনটা এসেছিল, ততক্ষণে তারিখটা বদলে গেছে। হাঁদারাম আজ যে আমার জন্মদিন ছিল আর সে উপলক্ষেই সারাদিন তোর মত একটা উজবুকের সাথে কাটিয়েছি সেটা মনে রাখিসনি কেন? সম্বোধনের মাধুর্য আমাকে চমৎকৃত করলো হতচকিয়ে যাওয়ায় ভাষার সন্ধানে হাতরাচ্ছিলাম। এর মধ্যে ইতর এবং বদমাশ বিশেষণ দুটিও আমার শোভা বাড়ালো। সে যখন লাইন কেটে দিয়েছিল তখনো যুতসই কোন শব্দ জোটেনি। অথচ পরদিন যখন ক্যাম্পাসে দেখা একেবারে স্বাভাবিক, যেন রাতে কিছুই হয় নি। পরে জানা গিয়েছিল তারও তিন মাস আগে নাকি কোন এক ফাঁকে আমাকে সে তার জন্মতারিখ বলেছিল। আমি মনে রাখিনি, তাই ব্যবহৃত বিশেষণগুলো আমার প্রাপ্য ছিল। সেদিন থেকে ঘনিষ্ঠ, পরিচিত বা অল্প পরিচিত অনেকেরও জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী কিংবা প্রেম বার্ষিকী এমনকি দেখা বার্ষিকীর হিসাবও আমার ডায়েরির পাতায় ঠাঁই নিল এবং সে অনুযায়ী উইশও করেছি অনেককে। লক্ষ্য করেছি অনেকেই এতে বিস্মিত হয়েছে তবে পুলকিতভাবে সংখ্যাই বেশি। দুয়েকজন সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকায়নি এমনও নয়। আবার এক্ষেত্রেও কারো কারো চোখে আদিখ্যেতা খোঁজা বিরক্তিও দেখেছি। এ অভ্যাসের অনুশীলন, আমায় মনে রাখিয়েছে তার সাথে প্রথম দেখা, শেষ পরীক্ষার তারিখ কিংবা ছাত্রত্ব শেষে বেকারত্বে প্রবেশের দিনও। মনে রয়েছে সামাজিক জীবনের অহর্নিশ চাপে নুয়ে আসা তার ক্ষয়িঞ্চু প্রতিরোধের ক্রমও। মনে আছে যেদিন সে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দিতে এসেছিল, কার্ডটি দিয়ে হাসছিল, ‘অবশেষে আমার একটা গতি হলো, তুমি কিন্তু বিয়েতে আসবে। আমি তাকিয়েছিলাম তার দিকে। কোনকালেই সাজগোজ পছন্দ করতো না সে, আর না সাজা সাজেই তাকিয়ে থাকার মত স্নিগ্ধতা ছিল তার। অথচ তাকাতে হতো লুকিয়ে, তবুও কেমনে যেন বুঝে যেত, আর বুঝলেই . . . এমনকি দু’বার জনসমক্ষে কান মলাও খেয়েছি। অথচ সেদিন কোন বাধা ছাড়া তাকিয়েছিলাম, একেবারে নির্ণিমেষ নয়নে। দুর্বোধ্যতা হারিয়ে দিয়েছিল মুগ্ধতাকে। তাকিয়েছিল সেও। খানিকক্ষণ পর জীবনে প্রথমবারের মত আমার হাত ধরেছিল, তুলে ছুঁইয়েছিল গালে। ততক্ষণে নেমে আসা অশ্রু ভিজিয়ে দিয়েছিল আমার হাত আঙুল। উঠে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘আসতে হবে না তোমাকে, আসবে না প্লিজ’! যাইনি, তবু এখনো নিঝুম একাকীত্বে আনমনে হাতটা তুলে ধরি চোখের সামনে। এখনো স্পর্শ পাই অশ্রুর, ভেজা ভেজা লাগে হাতের চেটো। কেউ বলার নেই, পরীক্ষাও নেবে না কেউ অথচ এখনো দশমীর চাঁদের আকার দেখি খুঁটিয়ে। এখনো হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই, কুঞ্চিত চোখে তাকিয়ে দেখি পৃথিবীর রঙ। আমি থাকতে চেয়েছিলাম একান্তই আমি হয়ে, হয়েছিও হয়তো। মানুষই তো বদলায়, আর আমার বর্তমান আমিত্ব, সেও তো আমারই মানিয়ে নেয়া রূপ। এসএমএসের এ যুগেও চিরকুট লিখা পছন্দ করতো সে। কখনো বলার জন্য কখনো শুধুই দেয়ার জন্য। বেশির ভাগই অর্থহীন কথাবার্তায় ভরা। তবুও জমিয়ে রাখতাম। শেষ পর্যন্ত রেখে দিলে অনেক বড় সংগ্রহ হতে পারতো। বর্তমানে সহমর্মী বন্ধুদের তখনকার ভয়ে প্রায়ই মানি ব্যাগে লুকিয়ে ফেলতে হতো সে সব। একা হলেই হাতে নিয়ে দেখতাম, পড়াটা মুখ্য থাকতো না। আজও তাকালাম হাতের দিকে, হাতে ধরা চিঠিটার দিকে। এ চিঠিগুলো স্মরণ করায় তাকে, এখনো। হয়তো এ জীবনে যখনই ইন্টারভিউ’র কোন চিঠি পাবো, বরাবরই তাকে মনে পড়বে। শেষদিকে এ জাতীয় খবরগুলোর জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকতো সে। তার ব্যস্ততা এখন কি নিয়ে জানি না তবে আমার ত্রস্ততা শেষ। আমি জানি এসব চিঠি শুধুই পরিসংখ্যানগত সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়। তবুও উপযাচক হই সংখ্যা তত্ত্বে সামিল হতে, এখন এটিই যে আমার নির্মোহ যাত্রার সূচক!
Click This Link