somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ ছেঁড়া ছাতার তলে

২৭ শে জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তার লাইন ম্যানেজারের ডাকে যখন বিভিন্ন ডেস্কে বসা জনেরা উঠে আসলো বিভিন্ন দিক থেকে, আর নতুন যোগদানের খবরে ওয়েলকাম ওয়েলকাম বলে বিভিন্নমুখী শুভেচ্ছাবানী বর্ষিত হলো, এতদিন ধরে সিন্দাবাদের ভুতের মত চেপে বসা হীনমন্যতা বোধটা উড়ে গেল হঠাৎ করেই। বিস্মিত রকির মনে হলো যেন সে পিকনিক মুডে থাকা একদল ফূর্তিবাজ কর্মজীবীর মাঝে এসে হাজির হলো। অল্পক্ষণ পরেই সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার পর উদ্যমী শব্দটাও মাথায় এলো নইলে নির্ভার কাজ কর্মহীন একটা ডিপার্টমেন্টে তার জায়গা হলো মনে হতে পারতো।

রকি সবচেয়ে চমৎকৃত হলো তার বসের কথাবার্তায়। এটা আপনার ডেস্ক বলে একটা ডেস্কে বসিয়ে দিয়ে যাওয়ার খানিকক্ষণ পর একজন অফিস সহকারীকে নিয়ে হাজির হলেন। এই নেন আপনার ল্যাপটপ আর আপনার সিম কার্ড বলে জিনিস দুটো হস্তান্তর করলেন। আপনার আসা যাওয়ার জন্য গাড়ির খবর ও যথাসময়ে পেয়ে যাবেন,’ নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন বস, ‘বাড়ির ব্যবস্থাতো নিশ্চয়ই আগে থেকে আছে তবে কোন নারীর খবর দিতে পারবো না, ওটা আপনাকেই ব্যবস্থা করে নিতে হবে।’ কথাগুলো নিচু গলায় হলো না, যে কারণে শেষ হওয়ার সাথে সাথে আরক্ত রকিকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে হো হো করে সে হেসে উঠল জোনটা। বোঝা গেল ম্যানেজারের আন্তরিক সহজতায় অভ্যস্থ সবাই।

তার সামনে চেয়ার টেনে বসতে বসতে ঢোকার মুখের মেয়েটির দিকে ইঙ্গিত করলেন ম্যানেজার, আপনার আসা যাওয়ার গাড়ির খবরাখবর পাবেন এই ম্যাডামের কাছে। ম্যাডামের নাম্বারটা রেখে দেবেন, ঐ সংকান্ত প্রয়োজনে যোগাযোগ করবেন।

তখনই মেয়েটি উঠে আসলো আর নিজের ভিজিটিং কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে স্মিত হাসলো, ‘ভাইয়া আপনার নামটা কিন্তু জানা হলো না,’ রকি অপ্রস্তুতভাবে নিজের নামের প্রতিধ্বনি তুললো। ‘আপনার ভিজিটিং কার্ড আগামীকাল এসে পড়বে, তখন আর রকি রকি বলতে হবে না, তবে যাই বলেন রকি রকি নামটা কিন্তু এক্সসেপশনাল।’ ম্যানেজারের কথায় আবার জেগে উঠা চাপা হাসির হুল্লোড় রকিকে দ্বিতীয় দফা বিব্রত করার পাশাপাশি স্বস্তিও যোগাল। এমন দুনিয়া জোড়া পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানে এমন আন্তরিক পরিবেশ! তার নাম ভীতিটা প্রথম ঘণ্টাতেই কাটিয়ে দিল। অবশ্য গতকাল ছোট মামার একজন বন্ধু তার ম্যানেজারকে চিনতে পেরে এ জাতীয় মন্তব্যই করেছিল, ঠিকমত কাজ করলে দেখবে ওর মত ভালো মানুষ আর হয় না। এর আগে কারো কারো মন্তব্যে যে মাল্টি ন্যাশনাল ভীতি গড়ে উঠেছিল সেটা নিয়ে আশ্বস্ত হওয়ার প্রথম সুযোগ এসেছিল তখন আর আজ জয়েন করার পর তো পুরোই কেটে গেল।

আমি যতটুকু জানি আপনি ফ্রেশ গ্রাজুয়েট, এটাই আপনার প্রথম চাকরি, আমি কি ঠিক আছি, ম্যানেজারের জিজ্ঞাসার ধরণটা তাকে অন্যরকম নম্রতার রাস্তা দেখিয়ে দিল। তার সম্মতিসূচক মাথা হেলানো দেখে হাসলেন ম্যানেজার, ‘তো সেক্ষেত্রে প্রতি পদে পদে আপনার শেখার সুযোগ থাকছে, যদি কখনোই কোনভাবে কোনকিছু বুঝতে না পারেন, ডোন্ট হেজিটেড, আস্ক ইউর সিনিওরস। এখানে সবাই খুব কো অপারেটিভ। তবে কখনোই না বুঝে কিছু করবেন না, মনে রাখবেন এ ধরনের যে কোন কাজ আপনাকে পিছিয়ে দেবে। রকির চোখে মুখে সিরিয়াস ভাব দেখে আবার হাসলেন ম্যানেজার, দু’হাত তুলে একসাথে রওনা দেয়া একই গন্তব্যে পৌঁছাতে দু’জনার বোঝা না বোঝার পার্থক্য বোঝালেন বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে। হাসাহাসির ভিতরও বুঝলো রকি, অন্তত: চাকরি করার ক্ষেত্রে সহজতার মূলমন্ত্রটি এই মাত্র আওড়ানো হলো। আরেকটা কথা, উঠে যেতে যেতে থমকালেন ম্যানেজার, ক’টা প্রেম করেছেন। সাথে সাথে আশপাশের সবকটা ডেস্কের সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালো, হাসি হাসি মুখ করে তাকানো মুখগুলো তাকে বিব্রতবোধের চূড়ান্ত অবস্থায় নিয়ে গেলো। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আরক্ত মুখে মাথা নাড়লো রকি, না না। কয়েক ফুট দূরত্ব রেখে টান টান ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন ম্যানেজার, না না মানে কি, আপনি কি বলতে চান এত চকচকে একটা চেহারা নিয়েও আমার মত হতভাগা জীবন কাটাচ্ছেন। কি যন্ত্রণা! এ কথারও উত্তর দিতে হচ্ছে। রকি দেখলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মুখগুলো উত্তর শুনতে উৎসুক। বিব্রতবোধ কাটাতে মরিয়া হলো রকি, প্রথম কথা হলো আমার চেহারা যদি চকচকে হয় সেই স্ট্যান্ডার্ডে আপনার চেহারা সুপার হিরোর মত, আর এ ব্যাপারে আমি মূলত: ভীতু, ভয়ে কাউকে বলতে পারি নাই, আর এই রিয়েল হতভাগার দিকে কেউ কখনো নজর দেয়নি সো বুঝতেই পারছেন। রকির প্রগলভতা হয়তো অপ্রত্যাশিত ঠেকলো, ঘাড় কাত করে চমৎকৃত হওয়া বোঝালো। ম্যানেজার, তারপর ইউ টার্ন নেয়ার ভঙ্গিতে নিজের ডেস্কে ফেরত গেলেন। কিন্তু বসার আগে আবার ওখান থেকে গলা তুললেন, তাহলে তো আপনি সিমিলারিটিটা বুঝবেন না। প্রেমে যদি পরতেন বুঝতেন ডেটিং এর ডেট ঠিক করে ঠিক সময়ে না পৌঁছালে প্রেমিকা কিন্তু আদর করতে দেয় না, চরম বিব্রত বোধের মধ্যে রকি শেষ বাক্যটা শুনলো, চাকরির সাথে কিন্তু প্রেমিকার মিল আছে।

একেবারে অপরিচিত চারপাশ আর বয়সে বেশ ক’বছরের সিনিয়র ম্যানেজারের মুখে প্রেম ট্রেম জাতীয় কথা শুনে আড়স্ট হয়ে পড়া বোধে শেষ মন্তব্যের মানেটা বুঝতে সময় লাগলো। তাকে সময়ানুবর্তী হওয়ার পরামর্শটা এমন সরসভাবে দেয়া হলো যে বুঝে উঠার পর চমৎকৃত হলো রকি।

এভাবে পদে পদে চমৎকৃত হওয়ার ব্যাপারটা চলতেই থাকলো। ক’দিন পর একটি প্যাকেট হাতে গম্ভীর মুখে ম্যানেজারের আগমন ঘটলো তার সামনে, কোম্পানির ডিসিশান হলো, আপনার অবিলম্বে একটা গার্ল ফ্রেন্ড দরকার। হকচকিয়ে গেল রকি। এখানে কিছু গিফট আছে, আপনার গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য, গাম্ভীর্য অটুট রেখে নিজের জায়গায় ফিরলেন ম্যানেজার। সন্ধ্যা পর্যন্ত হকচকানো ভাবটা গেল না তার। ফেরার পথে সবার হাতে যখন একই প্যাকেট দেখলো পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা। কোন একটা উপলক্ষে সবাইকে উপহার দেয়া হয়েছে। তারটা নিজ হাতে নিয়ে এসে তাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে এই ম্যানেজার। গাড়িতে যখন তার পাশের ডেস্কের কলিগের সাথে বিষয়টা শেয়ার করলো, ব্যাপারটা পরিষ্কার করলেন তিনি। ‘উপহার নেয়ার বিষয়টা অন্যদের ক্ষেত্রে ঘটেছে অফিস শেষে, এডমিন ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে, আপনার এমপ্লয়ী আইডি এখনো না হওয়ায় ভাইয়া নিজ হাতে দিয়ে গেছেন। আর সেটাকে অন্যভাবে এক্সপ্লেইন করেছেন।

একই গাড়িতে অন্য ডিপার্টমেন্টেরও দু’জন ছিল। ব্যাপারটা শুনে হা হা করে হাসলো তারাও। ‘ম্যানেজার সাহেব যার পেছনে লাগেন, একেবারে তার বারোটা বাজিয়ে দেন’ তাদের মন্তব্যে সামান্য অস্বস্তিবোধ হলো রকির। এ ধরনের ফাজলামো পরিচিত পরিবেশে মধুর কিন্তু অপরিচিত পরিবেশে বিব্রতকর। সপ্তাহখানেকের মধ্যে অবশ্য সবার সাথে মোটামুটি আলাপ পরিচিতি গড়ে উঠেছে কিন্তু গার্ল ফ্রেন্ড ট্রেন্ড জাতীয় কথাবার্তা মোকাবেলা করার মত সহজতা এখনো আসেনি।

দিন কয়েকের মধ্যে ম্যানেজারের অন্যরকম একটা পরিচয়ও পেল রকি। বিশেষ একটি করেসপন্ডেস-এর ক্ষেত্রে কি লেখা উচিত অনুচিত না বুঝে তার ড্রাফটটা নিয়ে সরাসরি ম্যানেজারের শরণাপন্ন হলো সে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতে কোন ধোঁয়াশা রাখার মানে নেই। ঘটনাটা শুনে আলগোছে একবার তাকালেন ড্রাফটটার দিকে, ‘ঠিকইতো আছে’, স্বাভাবিক উঁচু গলায় বললেন একবার, তারপর উবু হয়ে বসলেন টেবিলে। ঈশারা পেয়ে ঝুঁকে এলো রকিও, নিচু গলায় কারণ জানিয়ে পুরো ড্রাফটটা বদলে দিলেন। অথচ রকি যখন নিজের ডেস্কের দিকে রওনা দিল, আবার স্বাভাবিক গলা ভেসে আসলো, ‘আপনার পুরোটাই ঠিক আছে শুধু এই দুয়েকটা শব্দ এদিক সেদিক হবে। বিষয়টা বোধগম্য হতে তাজ্জব হলো রকি, সে জানলো তার সীমাবদ্ধতা কিন্তু আশপাশের অন্যরা শুনলো তার পারঙ্গমতা। নিজের মনে মাথা নাড়লো রকি, লীডারশীপ বুঝি একেই বলে।

লীডারশীপের আর একটা নমুনা দেখলো মাস তিনেক পর। সেদিন সবাইকে লাঞ্চের দাওয়াত দিলেন তিনি। বেশ নামী হোটেলটার লাঞ্চটা হঠাৎ করেই বিস্বাদ হয়ে গেল এভাবে খাওয়ানোর উপলক্ষটা বলার পর, ‘আমি অসাধারণ তিনটা বছর কাটালাম আপনাদের সাথে, ম্যানেজার হঠাৎ করে শুরু করলেন। তারপর জানালেন পরের সপ্তাহেই তার চাকরি বদলের কথা, ‘আমি কখনোই ভুলবো না এদেশে কাটানো সময়টা, বিশেষত: এই অফিসের প্রতিটা মুখই আমার এক একজন প্রিয় মানুষের মুখ। অসংখ্য সুখস্মৃতি আমাকে সারাজীবন অনুপ্রেরণা জোগাবে, তা পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন!’

অদ্ভুত এক বিষণ্নতা নেমে আসলো এতক্ষণ ধরে হাসি খুশিভাবে আড্ডায় মেতে থাকা মানুষগুলোর মুখে। পেশাদারিত্বকে যেখানে শেষ কথা বলে শেখানো হয় সেখানে সবাইকে এভাবে থমকে যেতে দেখে বিস্মিত হলো রকি।

বাসায় ফেরার পথে এই বিষন্নবোধের কারণটা জানা গেল। গত বছর যখন আমাদের উপর দিয়ে চাকরি যাওয়ার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, ম্যানেজার সাহেবই আমাদের ছাতা হয়ে আগলে রেখেছিলেন’, বিষণ্ন মুখে জানালেন কোম্পানিতে এক দশক কাটিয়ে দেয়া একজন। হুম, মাত্র এক শব্দে সমর্থন জানালেন দ্বিতীয়জন, মাথা নেড়ে অন্যরা। তবে এই যাত্রা পথেই অন্যসুরটা শুনলো রকি। ‘ইমোশনাল হওয়ার সুযোগ আমাদের নেই’, যে বললো সে নিজেই মাথা নেড়ে নিজেকে সমর্থন করলো, অন্যরা করলো না বলে।

এই অন্যসুরের অন্য অর্থ ভাবছিল রকি, কিন্তু পরদিন অফিসের আনাচে-কানাচে ঘুরাঘুরি করতে থাকা কে হবেন পরের ম্যানেজারের ফিসকাস তাকে নির্দিষ্ট চিন্তাই করালো। নবীনত্বের কারণে নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে কোন প্রকাশ্য মন্তব্য করলো না সে, তবে ফিরতি পথে গাড়িতে অনুপস্থিত থাকা আগের দিনের আলাদা বাস্তববাদী যে দৌঁড়াচ্ছে জানা গেল অন্যদের মুখে।

অনুমানের ব্যাপারটা অবশ্য সাতদিনের বেশি স্থায়ী হলো না। শেষদিকে নিশ্চিত হতে থাকা অনুমানটাই ঠিক হলো। আলাদা বাস্তবতার নতুন সংজ্ঞা নিয়ে অষ্টম দিনে সবার সামনে জ্ঞানগর্ভ কথা বলে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললেন এতদিন সহকর্মী থাকা নতুন ম্যানেজার। চেয়ার অনেককে দায়িত্বশীল করে তোলে, কাউকে কাউকে অহংবোধীও। যে যা ইচ্চা করুকগে, কার কি বদল হচ্ছে তা মাথাতেই আনতে চাইল না সে।

তবে, ‘সবকিছু মাথায় রাখতে হবে সবদিকে খেয়াল রাখতে হবে’ বলে যে আলাদা মনযোগের বৈঠকটা হলো, একেবারে ওয়ান টু ওয়ান, তাতে অন্যরকম একটা ব্যাপারও তার মাথায় ঢোকানো হলো। এতদিনের একসাথে যাওয়া আসার পথে রাস্তায় হওয়া হাসি ঠাট্টার উষ্ণতা পুরোপুরি পাশে রেখে নতুন ম্যানেজার তার চাকরি যে এখনো স্থায়ী হয়নি এবং ছয় মাসের শিক্ষানবিসতার কাল পেরুলে যে সুপারিশটা ম্যানেজারেরই করা লাগে সে দায়িত্ব স্মরণ করলো, এবং সুপারিশ না করার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি না করার যে পরামর্শটা জুটলো, তাতে পরিবর্তনটা বুঝলো সে।

তবু যদি বুঝতে কিছুটা বাকি থাকে দু’দিন পর তাও আর থাকলো না। অন লাইন নিউজ এজেন্সী গুলোর খবরে এসে যাওয়া প্রচণ্ড জ্যাম যখন তাদের আধা ঘণ্টা দেরিতে অফিসে পৌঁছালো, তার ডেস্কের সামনে এসে মাথা নাড়লো ম্যানেজার। মুখে কিছু বললো না বটে কিন্তু একবার হাত ঘড়ি আর একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ জঙ্গীতে তার হাত মেলে দেয়াটা অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল।

দেরীতে আসার ব্যাপারটা কাঙিক্ষত নয় কিন্তু দৈবতার সাথে তুলনীয় এ ঘটনায় প্রায় চার মাসের মধ্যে প্রথমবারের মত দেরীতে আসাটা যেভাবে গ্রহণীয় হলো অক্ষম ক্রোধের জন্ম দিল তা। ‘ধ্যাত্তেরী শালা!’ বদলে যাওয়া খবরদারীতে ক্রমশ: বিরক্ত হয়ে উঠা রকি প্রথমবারের মত স্বগতোক্তির চট্টে বিরক্তি প্রকাশ করলো।

সেদিন সন্ধ্যায় বেরুতে গিয়ে দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেল রকি। ‘সাধারণ নিয়ম হলো কেউ দেরিতে আসলে দেরি হওয়া সময়টা বেশি থেকে ব্যাপারটা পুষিয়ে দেয়া, অবশ্য তাতেও দেরিতে আসার অপরাধটা হালকা হয় না’ হা হয়ে গেল রকি, কি এমন কাজের চাপ যে খামাকা অফিসে বসে থাকতে হবে। গত ক’মাসে যখনই দরকার হয়েছে অফিস আওয়ার পেরুনোর পরও দীর্ঘক্ষণ কাজ করেছে সে। ব্যাপারটা দায়িত্ব মনে হতো আজ মনে হলো বাধ্যবাধকতা। ইচ্ছা করে আরও দু’ঘণ্টা বসে রইল সে। বসে বসে ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়লো এবং বেরুনোর সময় মনে আসা তার প্রতিজ্ঞাই তাকে অনুভব করালো এখন থেকে সমান তালে ফাঁকি মারাও স্বাভাবিকতায় এসে যাচ্ছে।

কোয়ানটিটি কোয়ালিটির বিরোধ সর্বত্র। এক্ষেত্রে প্রথমটাকে দেখনদারির ঘরে ফেলে এ যাবতকাল এড়িয়ে চলেছে রকি। মানসিকতায় মিলে যাওয়া বস তাকে এতদিন স্বস্তি যুগিয়ে এসেছিল স্বকীয়ভাবে। কিন্তু কোয়ালিটির ঘাটতি থাকলে কোয়ানটিটি দেখানোর যে দেখনদারিত্ব, এবার যেন সরাসরি তার মাঝে এসে পড়েলা সে। নবীনত্ব হীনমন্যতারও কারণ হওয়া উচিত জাতীয় কথাবার্তা তাকে ক্রমশ: বিষণ্ন করে তুললো। জয়েন করার পরপর, যখন অফিসে কাজের প্রচণ্ড চাপ, উইক এন্ডটাকে চরম কাঙিক্ষত মনে হতো। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শান্তি শান্তি লাগতো। ড্রেস কোড ও শিথিল সেদিন, সবার মধ্যেই ফূর্তিভাবটা থাকতো সুস্পষ্ট। ইদানিং অভ্যস্ত হয়ে উঠার কারণে হোক কিংবা বর্তমানে পাল্টে যাওয়া পরিবেশের কারণে হোক, বৃহস্পতিবার আর উৎসব ভাব আনে না। তবু সাপ্তাহিক নিষ্কৃতি স্নায়ুতো শিথিল করবেই। শেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফিরতি পথে মাত্র তিনজন সওয়ারী নিয়ে চলা গাড়িতে অন্য ডিপার্টমেন্টের একজন তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো, কি খবর আপনার নতুন ছাতা ঠিকমত কাজ করছে নাকি? হা হয়ে গেল রকি? তার নতুন ছাতা কেনার খবর এখানে পৌঁছালো কি করে। তার অবাক দৃষ্টির সামনে বসে মৃদু হাসলেন প্রশ্নকর্তা, আপনার সাথে গাড়িতে আছি মানে অন্যদের মত মাথা গুলিয়ে ফেলতে যাইনি, ভেজা-শুকনা কিছু খাইওনি। আপনার পুরনো ম্যানেজারকে সবাই ছাতা বলতো তাই বর্তমান জনের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। ‘অ, তাহলে ছাতাটা ছেঁড়া পড়েছে।’ তৃতীয় জনের গলা ফাটানো হাসির মধ্যে নিজের জবাবে নিজেই চমৎকৃত হলো রকি।

আর সপ্তার শুরুর দিন, বর্তমান যাত্রাপথের সাতজনই যখন আসীন, ছাতা বদলের খবরটা দিল রকি, অন্যদের চুপ করে যাওয়া মনযোগের বিপরীতে বসে সেদিনের ছাতার উপমা টানা জনকে ব্যাখ্যাও দিল সে। এখন আমার অবস্থা ছাতাহীনতা, ছাতা বদল নয়। মাথার উপর খোলা আকাশ তো তাই বললাম। ক’মাসে আপন হয়ে উঠা মানুষগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে মাঝপথে নেমে যেতে কষ্ট হলো তার। য্যামে পড়া রাস্তায় চেপে ধরা কৌতুহলী মুখগুলো তাকে ক্রমশ: কোণঠাসা করে ফেলছিল। রকি কোন অবস্থাতেই বলতে চাচ্ছিল না তার সিদ্ধান্ত জানানোর পর কথিত ছাতার গর্জে উঠা বা গুটিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো।

শ্রাবণ সন্ধ্যায় নগর ভিজিয়ে দেয়া ঝিরঝিরি বৃষ্টি তখন নিজের মতই ঝরছে। ইতোমধ্যে ভিজে যাওয়া চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে কালো হয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকালো রকি, মাঝে মাঝে ছাতা ছাড়াই অরক্ষিত মাথা নিয়ে বৃষ্টির নীচে দাঁড়ানো উপভোগ্য হয়ে উঠে এবং সবঅর্থেই, বিশেষত: সেটা যদি শ্রাবণ সন্ধ্যায় হয়।


Click This Link
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×