(১)
সময়টা খুব গোলমেলে ছিল মাহতাবের জন্য। কোন কিছুই তার আনুকূল্যে ছিল না। সব জায়গাগুলোতে তাকে না শুনতে হচ্ছিল। তবুও এটাকে জীবনের বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে সে আর দশজনের মতই দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু সব সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হল, যখন শিরীন তাকে বলল, "আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে মনে হয় একটু চিন্তা ভাবনা করা উচিত। আমি সম্ভবত এই সম্পর্কটা আর এগিয়ে নিতে পারব না।" মাহতাব কয়েক সেকেন্ড স্থির বসে ছিল এই কথা শুনে। কিছুক্ষণের ভিতর আত্মস্থ হয়ে সে প্রথমেই একচোট হেসে নিল। তারপরে হাসিমুখে শিরীনকে বলল, "ঠিক আছে, তুমি যদি চাও তাহলে সেটাই হবে।" শিরীন মাহতাবের এই ধরনের সহজ জবাব পেয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না যে আসলে কি হচ্ছে। কারণ সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে, মাহতাবকে সুন্দরভাবে প্রত্যাখ্যানের জন্য তাকে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলতে হবে, আগামী কয়েকদিন মাহতাবের ঘন ঘন ফোনের জবাব দিতে হবে এবং মাহতাবের সাথে আরো কয়েকবার বসতে হবে আলোচনার জন্য। মোটামুটি একটা বিরক্তিকর সময় তাকে পার করতে হবে মাহতাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পদ্ধতি হিসেবে। কিন্তু এ ধরনের হাসিমুখে জবাব পেয়ে শিরীন বেশ অগোছাল অবস্থায় পড়ে গেল। সে কি বলবে জবাব হিসেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। অগোছাল অবস্থা সামলে উঠার পর শিরীন মনে করল, মাহতাব হয়তো মজা করছে, বিষয়টা মিথ্যা একটি কৌতুক মনে করছে। তাই শিরীন আবার গলায় বেশ গাড় ভাব এনে দম টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে পুনরায় বলল, "মাহতাব, আমি কিন্তু মজা করছি না, আমি সত্যিই এটা বলছি, আমার পক্ষে এই সম্পর্কটা আর টেনে নেওয়া সম্ভব না। আমি আর এই ভার বহন করতে পারছি না। অনেকদিন হল আমি চিন্তা করছি যে আমাদের এখানেই থামা উচিত। তুমি হয়ত জাননা যে আমার...।" মাহতাব শিরীনকে হাত তুলে ইশারা করে থামিয়ে দিল। তারপর মুখের হাসি মুছে বলল, "আমি জানি তুমি সত্যিই এটা বলছ আর আমি মোটেও কৌতুক করছি না। তোমাকে কোন কৌফিয়ত দিতে হবে না। আমি জানতেও চাই না যে কেন তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ, আমি কি করেছিলাম বা তুমি আসলে কি চাও যা আমার কাছ থেকে পাওনি। আর আমি তোমাকে জোরও করছিনা যে, আমার সাথে তোমাকে অবশ্যই থাকতে হবে। আমি তোমাকে অভিযুক্তও করছি না যে তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ অথবা তুমি কথা দিয়ে কথা রাখনি। তুমি চলে যেতে চাচ্ছ, এটাই বড় কথা। তুমি মুক্ত। আমি কথা দিচ্ছি আমি কোনভাবেই তোমাকে বিরক্ত করব না অথবা তোমার পরবর্তী জীবনে আমি হানা দেব না। তুমি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পার। তুমি যদি মনে কর তোমার ভবিষ্যত স্বামী যদি কোনদিন কোনভাবে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে যেনে যায় এবং আমাকে আমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে এবং এর উত্তরে আমাকে যদি মিথ্যে বলতে হয়, বলতে হয় যে আমাদের কোন সম্পর্ক ছিল না, তাতেও আমি রাজী। তুমি নিশ্চিন্তমনে যেতে পার। আমার তরফ থেকে তোমার পরবর্তী জীবনে কোন ক্ষতির আশংকা নেই।" শিরীন মাহতাবের এই ধরনের জবাব শুনে বেশ ভড়কে গেল এবং কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। শিরীন কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, মাহতাব আবার হাত তুলে তাকে থামিলে দিয়ে বলল, "শুধু শুধু তুমি তোমার কথা আর সময় খরচ করছ। আমাকে কোন সান্ত্বনা দিতে হবে না, কারণও দর্শাতে হবে না। আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি আমার তরফ থেকে কোন ধরণের যোগাযোগই তোমার সাথে করা হবে না। এখন থেকে তুমি আমার থেকে মুক্ত। এখন তুমি যেতে পার। আর যদি মনে কর তুমি আরও কিছুক্ষণ এখানে বসে থাকবে এবং আমিও যদি এখানে বসে থাকি তাহলে তোমার কোন সমস্যা হবে, তাহলে আমিই চলে যাচ্ছি।" শিরীন এবার পুরোপুরি অস্থির হয়ে উঠল। সে বলতে লাগল, "দেখো মাহতাব আমি কিন্তু..." মাহতাব শিরীনের কথা শেষ করতে না দিয়েই উঠে দাড়াল এবং হাঁটা শুরু করল। শিরীন সম্পূর্ণ অগোছাল অবস্থায় পড়ে গেল। কিভাবে কি হচ্ছে কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছিল না। সে মাহতাবের পিছু নেবার জন্য উঠে দাঁড়াল এবং বলতে লাগল, "এই দাঁড়াও, কোথায় যাচ্ছ তুমি, দাঁড়াও, আমার কথা শেষ করতে দাও।" মাহতাব থামল না। সে হাটতে লাগল। শিরীন কিছুটা দৌড়ে এসে মাহতাবের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।"
মাহতাব নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, "গতকাল আমার চাকরীটা চলে গেছে"। শিরীন বলল, "আমার চাকরীটা এখনও আছে।"
-আগামী এগার দিন পর আমার মেসের সিটটা ছেড়ে দিতে হবে। আমার কাছে ভাড়া দেবার মত কোন টাকা নেই।
-আমরা নতুন একটা বাসা নিয়ে নেব।
-খাবার কেনার মত টাকাও আমার ফুরিয়ে এসেছে। ধার করে চলতে হবে সামনের দিনগুলো।
-ডাল-ভাত খেয়ে চলার মত টাকা বাসা ভাড়া দেবার পরও আমার কাছে থাকবে।
-এই মূহুর্তে বিয়ে করার জন্য খরচ করার মত নূন্যতম টাকা আমার পকেটে নেই।
-আমার কাছে আছে।
-আমার পরিবার সম্পর্কে তুমি ভাল করেই জান। আমার বেতনের টাকার বেশীরভাগ কোথায় খরচ হয় তাও তুমি জান। নিকট ভবিষ্যতে যদি আমি আবার চাকরী পাই তাহলেও আমার অবস্থা যে এখনকার মতই থাকবে তাও তুমি জান।
-আমার কোন সমস্যা নেই। আমার খরচ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
-তুমি কি ধরনের পরিবারে বড় হয়েছ, তা তুমি ভাল করেই জান। তোমার বাবা-মা তোমাকে নিয়ে কি আশা করে তাও তুমি জান।
-হ্যা জানি।
-তোমার পরিবারে আমাদের বিয়েটা যে কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য হবে না সেটাও কিন্তু তুমি জান।
-হ্যা আমি জানি।
-তুমি আরেকবার ভেবে দেখ।
-আমি আর ভাবতে চাই না। আমি যথেষ্ট ভেবেছি। বাকীটা আমি আজকের পরে ভাবতে চাই।
-আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলতে চাই।
-এর ফলাফল কি হবে তা কিন্তু তুমি জান।
-হ্যা জানি। কিন্তু তবুও আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলতে চাই। উনাকে না জানিয়ে আমি কিছু করতে পারব না।
-ঠিক আছে। তুমি আমার বাবার সাথে কথা বলবে। কিন্তু আমাদের বিয়ের পর। আমরা দু'জনেই একসাথে বাবার সামনে যেয়ে দাড়াব।
-না আমার পক্ষে তা সম্ভব না।
-দেখ তুমি ভাল করেই জান যে এর ফল কি হবে।
-হ্যা আমি জানি, কিন্তু তারপরেও আমি উনাদের না জানিয়ে কিছু করতে পারব না।
-ঠিক আছে, তুমি যদি এটাই চাও তবে তাই হবে। আমরা এখনই বাবার কাছে যাব।
(২)
বছর চব্বিশ পর। হাসান আর চৈতি এইমাত্র কাজী অফিস থেকে বের হল। হাসানের মুখ দেখে বেশ চিন্তাযুক্ত মনে হচ্ছে। চৈতির মুখটা অবশ্য মোটেও চিন্তাযুক্ত নয়। সে বেশ হাসিখুশী। নববধূর লজ্জা লজ্জা ভাবটাও চৈতীর ঘোমটা দেয়া মুখের দিকে তাকালে কিছুটা বোঝা যায়। চৈতি হাসানের বা হাতটা জড়িয়ে ধরে আছে। হাসান চৈতির ঘোমটা দেওয়া মুখের দিকে একবার তাকাল। তার ইচ্ছে করছে ঘোমটাটা সরিয়ে দিয়ে চৈতির মুখটা একটু ভালভাবে দেখতে। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আসলেই সে কাজটা করবে কিনা। হঠাত চৈতির মুখে "শোন, এখন আমরা সোজা বাড়ী যাব", শুনে সে তার চিন্তাযুক্ত ভাবটা মুখ থেকে সরিয়ে চৈতির দিকে তাকাল। তারপর বলে উঠল, "চল"।
চৈতির মা মিসেস শিরীন খন্দকার অনেকক্ষণ হল বিছানায় শুয়ে আছেন। একজন ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে এসে তাকে দেখে গেছে। সবগুলো থানায় খবর দেওয়া হয়েছে। এখনও চৈতির কোন খোজ পাওয়া যায়নি। হঠাত কাজের লোক এসে খবর দিল, "আম্মা আপামনি আইছে, লগে এক ব্যাটারে লইয়া আইছে।" মিসেস খন্দকার ততক্ষণাত বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। নীচে নেমে দেখলেন, চৈতি মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাড়িয়ে আছে একটা ছেলের সাথে। ছেলেটার পরনে নীল একটা পাঞ্জাবী। ছেলেটা মাথা নীচু করে দাড়িয়ে আছে। মিসেস খন্দকার একমূহুর্ত ভাবলেন। তারপর ওদের সামনে এসে দাড়ালেন। চৈতি আর হাসান মিসেস খন্দকারের পা ছুয়ে সালাম করল। মিসেস খন্দকার সরে দাড়ালেন না আবার কোন প্রতিক্রিয়াও দেখালেন না। ঠায় দাড়িয়ে রইলেন। তারপরে হাসানকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার নামই তো হাসান?" হাসান বলল, "জ্বী"। মিসেস খন্দকার বললেন, "তুমি কি কর?" হাসান বলল, "গাজীপুরের একটা গার্মেন্টসের পিএম হিসেবে আছি এখন।" মিসেস খন্দকার বললেন, "থাক কোথায়?" হাসান বলল,"গাজীপুরেই বাসা নিয়ে থাকি।" মিসেস খন্দকার বললেন,"দেখ ছেলে তুমি হয়ত জাননা, চৈতির বাবার সাথে আমার যখন বিয়ে হয় তখন তার কোন চাকরী ছিল না, থাকার জায়গা ছিল না। আমার বাবা-মা আমাদের বিয়ের পর চৈতির জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের গ্রহণ করেননি। অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে আমরা দিন কাটিয়েছি। আমার জন্য সুখ সম্পদের দরজা খোলা ছিল। আমি চাইলেই ওর বাবাকে ছেড়ে চলে আসতে পারতাম। ওর বাবা চাইলেই আমাকে ছেড়ে অনেকটা নির্ভার জীবন যাপন করতে পারত। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যাইনি। তোমরাও কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যেও না। চৈতির বাবার আত্মা এতে কষ্ট পাবে। উনি বেচে থাকতে অনেক কষ্ট করেছেন। উনাকে আর কষ্ট দিও না। লোকটাকে এবার শান্তিতে থাকতে দাও।" মিসেস খন্দকার এরপর চৈতি আর হাসানকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেদে ফেললেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:২৮