৭১-এ এরা দুই ভাই ছিলেন দাপুটে রাজাকার। এখনো দাপটেই আছেন। কিন্তু রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সহোদর দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন গ্রামবাসী।
পাকিস্তানীদের দোসর বাঘা উপজেলার ব্যাংগাড়ী এলাকার দুই সহোদরের নাম রাজাকার মুনা ও হাবি। এলাকায় মুনা রাজাকার ও হবি রাজাকার হিসেবেই পরিচিত। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের হয়ে এলাকায় নতুন করে আধিপত্ত বিস্তার করে এখনো দাপটেরসাথেই নানা অপকর্ম করছেন। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট গ্রামবাসী ও ভূক্তভোগীরা এদের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ প্রেরণ করেছেন।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগে জানা যায়, উপজেলার ব্যাংগাড়ী এলাকার বহুল আলোচিত দুই প্রভাবশালী সহোদর ছিল পাক সেনাদের দোসর। তাদের পিতার নাম আবুল কাশেম। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এরা ফেরি ব্যবসায়ী ছিল। গ্রামে ও হাট বাজারে দই, মিষ্টি ও ঘোল ফেরি করে বিক্রি করতো। কিন্তু ৭১-এ শুরু হয় এদের ভাগ্য বদলের পালা। রাতা-রাতি হয়ে উঠে সম্পদশালী। যা কিছু করেছেন তার সব কিছুই হয়েছে পাকসেনাদের দোসর হওয়ার কল্যাণে। স্বাধীনতার গা ঢাকা দিলেও ৭৫-এর পট পরিবর্তনের সুযোগে আবার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে পুনরায় শুরু করেন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। এতে স্বল্প সময়ে বিপুল ভূ-সম্পত্তি ও অর্থের মালিক বনে জান দুই রাজাকার সহোদর। বাঘা, আড়ানী, নারায়নপুর বাজারে গড়ে উঠে এদের একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়রা জানান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল খালেকের আত্বীয় এই দুই রাজাকারের বাড়ি কমান্ডারের পাশের গ্রামেই। এলাকাবাসীদের অভিযোগ কমান্ডারের আত্মীয় হওয়ায় রাজাকারের তালিকায় এদের নাম নেই। এদের চার ভাইয়ের মধ্যে এখন কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ জাতীয় পার্টি, আবার কেউ বিএনপির ছত্র-ছায়ায় থেকে এখনো দাপট করে যাচ্ছে । সম্পত্তি দখল থেকে শুরু করে খুন, লুটপাটসহ এমন অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এখনো এরা করে যাচ্ছে। এ সকল অভিযোগে দুই সহোদর ও এদের সন্তানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বাঘা ও লালপুর থানাসহ কোর্টে একাধিক মামলা হয়েছে। অনেকে এদের ভয়ে অভিযোগ করতে সাহস পায় নি। আবার যারা অভিযোগ করেছেন তাদের অনেকেই নির্যাতিত হয়েছেন। এলাকাবাসী মনে করেন বর্তমান সরকার এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে করতে জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ। তাই ভূক্তভোগীসহ এলাকাবাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে আরো জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করতে গিয়ে এরা চাঁদপুর গ্রামের এক বিধবার পুত্র ওয়াদুল, ব্রাহ্মনডাঙ্গা গ্রামের জোবান আলী, কুষ্টিয়া জেলার আওলাদ হোসেনকে দিবালোকে হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছিল। এছাড়াও এরা সরেরহাট গ্রামের সাজদার, মাজেদ, সেনাবাহীনীর হাবিলদার ( অব.) রুসত্মম আলী, আশরাফপুর গ্রামের বুদু পুলিশ, চাঁদপুর বেংগাড়ী গ্রামের মোহম্মদ পাইনি, শাহাজান পাইনি, মাজদার কাজী, আজিজ ও তার ভাই, আশরাফপুর গ্রামের হায়দার, আব্দুল করিম ও তার ছেলে আমু, দুড়দুড়িয়া গ্রামের আবজাল, মকবুল, আকবর, হাফিজুর,আকরাম, রহমান, মুনছার কাজী, হাশেম কাজী, কাশেম, ফরজ আলী, মেহের আলী, মাজেদ আলী, ফকির মণ্ডল, লালপুর এলাকার জোত গৌরী গ্রামের আব্দুল জলিল কার্তিক চন্দ্রসহ অনেককে নির্যাতন করে এবং কারো কারো জমি-জমা দখল করে নিয়েছিল।
এ ব্যাপারে গড়গড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, ভূক্তভোগীসহ এলাকাবাসীর অভিযোগে কোনো অসত্য নেই। দুই ভাই-ই স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে রাজাকার ও শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়ে বহু অকর্ম করেছে। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের সঙ্গে কথা বললে তিনি এদের সম্পর্কে কিছু না বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মো. শাহরিয়ার ফিরোজের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, তার কাছে রাজাকারদের কোন তালিকা নেই। তিনি ইতিপূর্বে সাবেক কমান্ডার আব্দুল খালেকের কাছে রাজাকারদের তালিকা চেয়েছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা তালিকা জমা দেন নি। তবে মুক্তিযোদ্ধা শাহদৌলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আ. রাজ্জাক, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা শফিউর রহমান শফি, শমসের আলী, মকবুল হোসেন, আমীর হোসেন, হুরমত আলী, হযরত আলী, অব. সৈনিক এসরাওল হক, আব্দুল হালিম, ও ভূক্তভোগী মজিবর, আমজাদ, জাহানারা রেজাউল করিম, কাশেম মণ্ডল, আ. মতিন, সাজদারসহ অনেকেই জানান, তারা স্বাধীনতার সময় এরা রাজাকার ছিল। তারা আরো বলেন, অমার্জনীয় অপরাধে জড়িত থেকে এরা বিপুল ধন- সম্পদের মালিক হয়েছে।
মুক্তি যোদ্ধা আমজাদ হোসেন, ফকির মণ্ডল ও শাহাজান জানান, এরা অনেক জমি দখল করে নিয়েছে। নিহত ওয়াদুল ওরফে ওয়াকিমের মা জাহানারা কেঁদে কেঁদে বল্লেন, টাকা ও সাক্ষীর অভাবে রাজাকারদের হাতে নিহত ছেলের ন্যায় বিচার পান নি। নিহত জোবান আলীর মেয়ে বেবী জানান, আমি সে সাময় অনেক ছোট ছিলাম। বড় হয়ে জেনেছি, বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল মুনা ও হাবি। সেই আগুনে পোড়া কাঠের কয়েকটি আসবাবপত্র আজো আমাদের স্মৃতি হয়ে আছে। নিজেদের নিরাপত্তার অভাবে পিতা হত্যার অভিযোগ করতে সাহস পায় নি। তবে তারা রাজাকারদের বিচার দাবি করেছেন।
এলাকার আকরাম, লুৎফল, আলী হোসেন ও আবু জানান, সম্প্রতি তারা হুকুম দিয়ে শাহারা নামের এক বিধবার ৫৫ বছরের বসত-বাড়ি রান্নাঘর ভেঙ্গে নুর মোহাম্মদকে দখল করে দেয়। পুলিশ বিধবা শাহারার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যবসা নিলে তারা পুলিশের বিপক্ষে উল্টো থানা পুলিশের নামে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন।
এসব বিষয়ে অভিযুক্ত মুনা ও হাবির কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন আমরা মেহনত করে বড় লোক হয়েছি। ৭১ সালে রাজাকার ছিলেন কি না ? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, যারা আমাদের রাজাকার বলে তারায় রাজাকার। এরপর প্রশ্ন করলে তারা এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাননি।
View this link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




