somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্প- ফুঁ

২০ শে জুন, ২০১৩ রাত ৯:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রবি জমি বেঁচে বিদেশ যায়, যাবার সময় কিছু দেনাও করে। সৌদি আরবে যাবার পর রবির কাদায় পড়া জন্তুর দশা হয়। আদম ব্যাপারী গলাকাটা পাসপোর্টে রবিকে সৌদি পাঠিয়েছে। দেনার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে দেশে না ফিরে পুলিশের সাথে টম এন্ড জেরি খেলতে খেলতে জিয়েলায় ঝুলে থাকা জীবন্মৃত অবস্থায় দুই বছর কাটিয়ে দিল। এই অবস্থাতেও মাঝে মাঝে সে বাড়িতে কিছু কিছু টাকা পাঠায়। তারপর আরবি-বাংলা অসদুপায়ের সংকর কায়দায় আকামা ঠিক করে সৌদিতে প্রকাশ্য কাজ করার বৈধতা পেল।
রবি টাকা পাঠায় তার দুলাভাই শফির নামে। শফি রবির পাঠানো টাকা দিয়ে নিজ নামে দোকান কেনে, জমি কেনে। বিদেশ থাকার কল্যাণে রবির সংসারে রবিরশ্মির বিকিরণ আলো-তাপ কিছুই ছড়ায় না, পরিবর্তে দুর্ভিক্ষ রশ্মির তেজস্ক্রিয়তায় তার ঘর সংসার ছারখার হয়ে যায়। চিঠি লেখা এবং পড়া রবির ও তার পরিবারের সদস্যদের সাধ্যের বাইরের ব্যাপার।শ্বশুরালয়ের লেখা-পড়ার প্রতি এই বৈরাগ্যের সুযোগ শফি ষোল আনা কাজে লাগায়। রবির খবর এবং টাকা কোনটাই তার বাড়িতে পৌঁছে না।
এবারের চৈতালি ফসল মেঘ তার খাজনা হিসাবে শিলা বৃষ্টির বষাণ দিয়ে উসুল করেছে। মেঘ গোষ্ঠীর বৈরিতার ধারাবাহিকতায় পাট, আউশ ধান শুকিয়ে ছন হয়ে গেছে। আমের বোল গুটি ফুটাবার ফুরসত পাবার আগেই ধূলায় মিশেছে। গরুর চাড়ি, মানুষের দাঁতের মাড়ি খরা পোহাচ্ছে। আসমান রাজ্য এমনই ফতুর হয়ে বসে আছে যে, সারা আকাশ ঝাট দিয়ে ঘামাচি পরিমাণ মেঘও জড়ো করার যো নেই।
চার দিকে বে-চক্কর দেখে রবির বউ দুই বছরের বাচ্চা ফেলে রেখে নাং-এর দিকে তার কেবলা ঘুরায়।
ভোর রাতে পুঁটি কান্না শুরু করে। তার দাদী মনে করল হয় তো তার মা প্রস্রাব পায়খানার জন্য বাইরে গেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল তবু তার কান্না থামছে না দেখে তার দাদী এসে দেখে ঘরে শিকল আটা। পুঁটিকে কোলে করে দাদী তার দাদাকে বলে দেখ তো কি হল। কান্নার চোটে চাচা-চাচীও উঠে এল। তারা সবখানে খোঁজ করে হয়রান হয়ে গেল। ভোর হওয়ার আগেই পাড়া প্রতিবেশীরাও ব্যাপারটা জেনে যতই খোঁজ করতে লাগল খিটকেলের গন্ধ পেয়ে খবরটা ততই ছড়িয়ে পড়ল।
পুঁটি কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে দাদীর কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে উঠে আবার উঠে মা মা শুরু করল। আমি সখি যাব, মা যাব, সখি যাব, সখি যাব বলে চিৎকার করতে লাগল। তার মার নাম ছকিনা, সে তাকে সখি বলে ডাকে। কোন কিছুতেই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউই তাকে প্রবোধ দিতে পারল না। তার একটাই লক্ষ্য মার কাছে যাওয়া।
বাড়ির পাশের নদীর যে ঘাট দিয়ে ছকিনা মাঝে মাঝে পুঁটিকে নিয়ে নায়রে যায় দাদী তাকে নিয়ে সেই ঘাটে এসে বলে, নৌকায় চড়ে তোর মা নানীর বাড়ী গেছে। একটু পরেই চলে আসপিনি। একটা নৌকা আসতে দেখে সে আসায় বুক বেঁধে দাদীর কোল থেকে নেমে কান্না ভুলে উত্তেজনায় টানটান হয়ে দাঁড়ায়। নৌকা ঘাটে ভিড়লে সে এক দৌড়ে নদীর ঢাল বেয়ে নৌকার কাছে যায়। পুরুষ যাত্রীরা নেমে যাবার পরে ছৈ এর মধ্য থেকে দুই জন ঘোমটা পরা মহিলা বের হল। নৌকা থেকে নেমে যখন তারা ঘোমটা ফেলে হাটা শুরু করল, পুঁটি তখন এক চিৎকার দিয়ে পাড়ের ভেজা মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রবল কান্নায় মাটি আরও ভিজিয়ে তুলল।
নদীর ঘাটে বসে পুঁটি উদাস হয়ে যায়। পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের তালে তালে দৃষ্টি তরঙ্গায়িত হতে হতে ও পারের দিগন্তে গিয়ে ঠেক খায়। ঘোর লাগা জাগ্রত শিশু চোখে মায়ের খোয়াব খেলা করে, ঘোর কাটতেই পুঁটি আবার নাক টানতে থাকে।
পুঁটি দিনের বেলায় যখনই কাঁদতে শুরু করে দাদী তখনই তাকে নিয়ে নদীর ঘাটে যায়। কোন দিন তাকে দিল্লীর লাড্ডু কিনে দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করে। নদীর বুকে দূরে দূরে ভেসে যাওয়া পাল তোলা নৌকার বিন্দু বিন্দু নড়া-চড়ার সাথে সাথে তার আশা-নিরাশা দোল খেতে থাকে। লাড্ডু খোলা বাতাসের প্রভাবে ও হাতের মৃদু মৃদু চাপে তালু ও আঙ্গুলে চটচটে লাল অবশেষ হয়ে লেগে থাকে। আবার কোন দিন দাদী তাকে বাতাসা কিনে দেয়। সে বাতাসায় ছোট্ট একটু কামড় দিয়েই মায়ের জন্য আনমনা হয়ে যায়। হাতে ধরা আধ খাওয়া বাতাসায় লাল পিঁপড়ের ভোজনোৎসবে বাধার সৃষ্টি হওয়ায় পিঁপড়ে হাতে যখন কুটুস কুটুস কামড় দেয় তখন সে বাতাসা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মা মা করে কেঁদে উঠে।
প্রথম দিনের সূর্য মাথার উপর উঠে আলো ছড়াবার আগেই বারানী মাগি হিসেবে ছকিনার খ্যাতি চারদিকে বিস্তার লাভ করে তাকে ঘরের মধ্যে কোন ঠাসা করে ফেলল। খিটকেল অন্বেষী-কাতর পাড়া-প্রতিবেশীরা ঝাঁকে ঝাঁকে তার কানের কাছে যে হারে নিন্দার খই ভাজতে লাগল, তাতে করে দড়ি ছিঁড়ে গাং পাড়ি দিয়ে নাং ধরার হাউস তার এক দিনেই মিটে গেল।
কোণঠাসা হলেও তার ঘরের কোনে বসে কাটাবার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি, জা, ননদ, স্বামী, সতিনসহ সবার গঞ্জনা ও কাজের তাড়নায় ঘরকন্না ও গৃহস্থালি কাজের জন্য বাড়ির ভিতর-বাহির, মাঠ-ঘাট, নদীর ঘাট করেত করতে সপ্তাহ মোড় না ঘুরতেই বসন্তের আগমনে এক দমকায় সব পাতা ঝড়ে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া গাছের মত লাজের সব বসন-ভূষণ ঝড়ে পড়ে সে লাজ-পাতলা হয়ে গেল।
ফেলে আসা স্বামীর জন্য ছেঁড়া কাপড় ত্যাগের অনুভুতিও ছকিনার হচ্ছে না, কিন্তু; বিড়ালের বাচ্চা ফেলানর মত দুধের শিশুকে ফেলে রেখে আসায় ছখিনার স্তনে ও মনে ঠোনক লেগে টন টন করছে। মেয়ের স্মৃতি হিসেবে তার যে জামাটি এনেছে সুযোগ পেলেই সে সেটিকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে ভিজিয়ে ফেলে।
গোসলের সময় গলা পানিতে নেমে ওপাড়ের আবছা আবছা গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবে এই নদী পাড়ি দেয়া ঘণ্টা খানেকের ব্যাপার। জীবনের উপর দিয়ে যুগের পর যুগ পার হয়ে যাবে, কিন্তু; এই এক ঘণ্টা সময় কোন দিনই তার পাড়ি দেয়া হবে না- এ কথা ভাবতে ভাবতে চোখের ধারা নদীর ধারায় মিশে ঢেউ তোলে। শিশু কালে সহ-নাইয়েদের সাথে খেলাচ্ছলে নদীর জলে ঢেউ- এর পর ঢেউ তুলে ছড়া কেটে কেটে নদীর ওপাড়ে ঢেউয়ের বার্তা পাঠাত, আজ সে সত্যি সত্যি ঐ পাড়ে বার্তা পাঠাতে গিয়ে শিশু হয়ে যায়। সে আবেগ মথিত হয়ে নদীর বুকে ঢেউয়ের ঝড় তুলে ছড়া কাটে-
যারে ঢেউ যা
ঐ পারে যা
ঐ পারে যায়ে...
এই টুকু বলে আর শেষ করতে পারে না। সে বার বার চেষ্টা করে, কিন্তু; একই জায়গায় এসে থেমে যায়, শিশু কালে স্বচ্ছন্দে বার বার আওড়ান ছড়ার বাকী অংশটুকু কিছুতেই মিল করতে পারে না। তখন সে মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে, পুঁটিরে পুঁটি, মা, মা।
ক’দিন পর খবর এল ছকিনা পদ্মার ওপারে রাজবাড়ির এক গ্রামে পাড়ি দিয়েছে। ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য পুঁটির দাদা গিয়ে দেখল; ক’দিন আগে যে ঘরামী তার বাড়ির ছোনের চাল ছেয়েছে সেই ঘরামীর সে উঠোন নিকচ্ছে। অনেক বুঝিয়ে তাকে পুঁটির খাতিরে বাড়ি আসতে বলল সে রাজি হল না। শেষে পুঁটিকে তার কাছে এনে রাখতে বলল, নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে তাতেও সে রাজী হল না।
যোগাযোগের দুর্গমতার কারণে সকল খবরই রবির কাছে অগম্য রয়ে যায়। বছর চারেক পর বউ’র খবর শোনার পর রবির দেশে ফেরার আগ্রহে বৈরাগ্য হানা দেয়। তার পরেও সে বাবা-মা, মেয়ে, ভাই-বোনদের জন্য আগের মতই মাসে মাসে ঠিকই বিশ হাজার করে টাকা পাঠায়।
রবির দুলাভাই, শালার কল্যাণে এলাকার সেরা জোতদার। তার বাবা প্রতি মাসে বাড়ি থেকে সুজানর বাজারে শফির কাছে আসে, রবির পাঠানো টাকার জন্য। সারা দিন বসিয়ে রেখে শফি বিকেলে তার হাতে ৫০০ টাকা তুলে দেয় এমন ভঙ্গীতে, যেন টাকাটা দিতে তার খুব বেগ পেতে হলও। আর প্রতি মাসেই বলে, রবি উয়ানে কি করে, বাচে আছে না মরে গেছে তার কোন খবরই পাওয়া যায় না, কী আর করা কন। ও ট্যাহা না পাঠালি আমি তো আর আপনেগের ফেলা দিবের পারিনি।
শেয়াল পণ্ডিতের পাঠশালায় বোকা কুমিরের সাত ছানাকে পড়তে পাঠানোর পরে শেয়াল এক এক করে কুমির ছানা খায়। কুমির যখন মাঝে মাঝে বাচ্চাদের দেখতে আসত, তখন শেয়াল কুমিরের এক ছানাকেই একাধিক বার দেখিয়ে এবং তার ছানার মুখ দিয়ে
“কানা কানা ঘানা ঘানা
কেমন লাগে কুমির ছানা,
গপ্”-
এই পাঠ শুনিয়ে কুমিরকে একটা জংলা বুঝ দিয়ে কুমির-গিন্নির কাছে পাঠিয়ে দিত। তেমনি রবির বুড়া বাপ রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, ধূলা-বালি-কাদা-পানি খচে আসা-যাওয়ায় সাত সাত চৌদ্দ মাইল পথ হেটে সন্ধ্যা পার করে তার আয়ু ক্ষয় আরও ত্বরান্বিত করে তার বুড়ির কাছে যে বার্তা কর্ণান্তর করত, তাতে বুড়ির আয়ু ক্ষয় সংক্রামিত হয়ে দ্রুতগামী হয়। এর ফলশ্রুতিতে বয়সে দশ বছরের ছোট হলেও রবির মা তার বাবার আগেই এপারের পাঠ চুকিয়ে ফেলে। আর বছর তার আড় না ভাঙ্গতেই স্বামী তার বউকে অনুসরণ করে।
যখনকার কথা তখন অটো রিক্সা, নছিমন, করিমন, কুরিয়ার সার্ভিস, মোবাইল ফোন কোন কিছুরই চল হয় নি। থানা সদর থেকে জেলা সদরে যাবার রাস্তাটাই তখন একমাত্র পাকা রাস্তা। মেঠো পথে যাতায়াতের জন্য তখন ‘পা’-ই সই। প্রায় সব এলাকাতেই আষাঢ় মাসে মাটির রাস্তা দিয়ে হাটা-চলা করা নৌকার গুন টানার মতই কষ্টকর; আর গরমের সময় গিরা সমান ধূলার চাদরের আতিথেয়তা ছিল।
রবির জন্য একটি অল্প বয়সী, সুন্দরী, দশ ক্লাস পড়া, বড় লোক পাত্রী ঠিক করা হয়েছে, পাত্রীর একটি ছবিও পাঠান হল। আর শফি রবিকে চিঠিতে এ পরামর্শও দিল, ভাল ঘরে বি’ করতি গেলি ঘর-দুর পাকা করতি হবি; তাই এহুনি চলে না আসে আরও কিছুদিন থাহে আয়, আর বাড়ি করার লেগেন বেশি বেশি করে ট্যাহা পাঠা। এত্তোরের চিন্তা কোরবুই লা। বাড়ি করার থিন আরম্ভ করি আমি একাই চাত্তোরের ব্যাবাক কাম সামাল দেব নে। রবি বাড়ি ফেরা পিছিয়ে দিয়ে নব উদ্যমে বাড়তি রোজগারে লেগে গেল।
রবি আবার চিঠি পেল, বাড়ির কাম শেষ। পাকা বাড়িত তো আর কুপির সলক চলে না। চাই বিজলি বাতির ফকফকা রোশনাই। তোর বাড়ির মাইল খানিক দূর পর্যন্ত কারেন্ট আয়ছে, কিছু বাড়তি ট্যাকা অফিসে খরচ করলি তোর বাড়ি পর্যন্ত আনা যায়।
রবি সে ব্যবস্থাও করে।
রবি বাড়ি ফিরে দেখে পাকা ঘর-দোর নেই, বাপ নেই, মা নেই, আগের বউ তো নেইই; হবু বউয়ের যে ছবি পাঠান হয়েছিল, তার সাং-সাকিন, দাগ-খতিয়ানের কোন অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। তার বদলে আছে নেই নেই এর একটা গুমট বাঁধা হাহাকার, পচে যাওয়া দুটো ছনের চালা ঘর, তার ছোট ভাই-এর আশ্রয়ে অবহেলায় বেড়ে উঠা অচেনা এতিম এতিম চেহারার একটা কিশোরী ।
রবি তার দুলাভাইয়ের দোকানে তার হিসাব নিকাস মেলাতে গিয়ে হাতা-হাতি লেগে যায়। বারো বছর বিদেশে ব্যাগার খাটার পরে, শেষে ডাকাতির অপবাদে দেশে উপরি পাওনা হিসেবে কপালে জুটল দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
জেল থেকে বের হয়ে সে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে, আপাতত নিজের বিয়ের চিন্তা শিকেয় তুলল। ঘর বাড়ি ঠিক ঠাক করে বাসের উপযোগী করার পর, মেয়ের বিয়ের পাত্র খোঁজার জন্য হন্য হয়ে গেল।
অনেক তত্ত্ব তালাশের পর ঈশ্বরদীতে একটা পাত্র পাওয়া গেল। রবি তার মেয়েকে বলল, ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে, উজ্জ্বল শ্যামলা, কোঁকড়া চুল, মাঝারি গড়ন, বয়স ২৫, বাড়ির অবস্থা যুতসই, এক ভাই পুলিশ, হুঁ! বুড়ে-বুড়ির বালাই নেই। থাকপু বাসায়। মা- এই বিয়েত বেপছন্দের ফাঁক-ফুকেট নেই।
রবি আগেই মেয়ের জন্য কিছু সোনার গহনা কিনে ছিল, আসার সময় নিজের বিয়ের জন্যও কিছু গহনা কিনেছে। মেয়ের বিয়েতে সে নগদ কিছু টাকা এবং নিজের বিয়ের জন্য কিছু না রেখে সব গহনাই মেয়েকে দিয়ে দেয়।
মাস না ঘুরতেই মেয়ে বাপের বাড়িতে ফেরত এল। “তোর বাপ নিজে বিয়ের জন্যি যে গয়না গুলেন রেখে দিইচে সে গুলেন নিয়ে আয়, গয়না আসলি তুই আসিস না হলি ও-মুখ আর এত্তোরে ফিরাস নে” আসার সময় পুঁটি জামাই-এর এই বার্তা নিয়ে এল। আসার আগে সে আরও যে বিষয়টি আবিষ্কার করে এসেছে তা তার কাছে ‘হিরোশিমা-নাগাসাকি’ অবস্থার মত ভয়ংকর। তার স্বামী মাঝে মাঝে রাতে বাড়ি ফেরেনা, কারণ; তার আলাদা একটি বাসা আছে, আর সেই বাসাতে পুঁটির একটা সতীন আছে, সাথে দুটি ছেলে।
পুঁটির ঘর সংসারের উপাখ্যান শুরু না হতেই জন্মের মত দাড়ি পড়ে গেল। জগত সংসারের ল্যাং খেয়ে রবি একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেল।
সে তার বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, বাজান ভাঙ্গে পড়িছ্যাও ক্যা?
তোর লেগিন রে মা, তোর লেগিন। তুই মা ফ্যালানি মিয়ে, তার বাদে এখুন এই কচি বয়সে হলু সোয়ামী এড়া। তোর চিন্তায় চিন্তায় আমার পেটের ভাত চাল হয়ে যায়রে মা! চাল হয়ে যায়!
তুমি আমাক মার প্যাটে থুয়ি গ্যেলে বিদেশে সুখ তালাশ করবের, আর মা আমাক পেটেত থেন মাটিত নামা রাখে দিলে সুখের পাগার পাড়ি। গেদা কাল থে বাপ মা এড়া কুত্তের বাচ্চার মত লাত্তি-গুড়ি, আঁটে-কাঁটা খায়ে খায়ে যে বাড়ে ওটেছে; তার কাছে সব কষ্ট হাড় সওয়া।
ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছও তো বাঁচার লেগেন আবার কুশি ছাড়ে। আর আমরা তো মানুষ। অবুঝ গাছ যদি সব-সওয়া হতি পারে আমরা মানুষ হয়ে সব-সওয়া হতি পারব লা ক্যা বাজান?
কিন্তু শুয়ে থাকলি তো আর হাড়ি চলবে না হানে, প্যাটও চলবেন না। প্যাটের তো আপন-পর, গ্যাদা-বুড়ের বুঝ নেই উএর যুগানের কমতি পড়লি ঠিকই আগুন ধরা দেবযানে। হাড়িত ফকিরেক ভিক্ষে দেওয়ার চালও নেই, হাড়ি নিজিই ফকির হয়ে বসে রইছে। বাজান তুমি এটা কাম ধর।
রবি সুজানগর পাবনা-রুটে ট্যাম্পো গাড়ির ড্রাইভারি শুরু করলো। সে যাতায়াতের পথে মনে মনে মেয়ের জন্য আবার পাত্র তালাশ করতে লাগল।
রবি অনুভব করল যত স্নেহের পাত্রই হোক না কেন, নিজেকে নি:স্ব করে সব সম্পদ কাউকে উপুড় করে ঢেলে দিতে নেই, নিজের জন্য তো কিছু রাখতেই হয়, আর যার জন্য এক থোকে সব উজাড় করা হয়, তার শেষ ভরসা হিসেবেও কিছু রাখতে হয়। তাতে আখেরে স্নেহ তলানিতে ঠেকে না।
এক রাতে কয়েকজন লোক রবিকে খেজুর পাতার পাটিতে জড়ান এক মরা দেখিয়ে বলে, ভাই এই মরাডা শুঁটকার মোড়ে কফিলের বাড়ি নি যাতি হবি।
রবি বলে, ভাইডি আমি রাত করে মরা টানতি পারবন্না। অন্য কাড়ুক নি যান।
আরে ভাই বৃষ্টির মদ্দি রাত করে আর কোহানে গাড়ি পাবনে হানে, আপনেই চলেন যাই। বৃষ্টি এহোন ইটু ছ্যাঁক দিচে এই সুযুগি খ্যাপটা মারি আসেন।
না ভাই আদার রাতি মরা নি যাতি পারবন্না।
ভাই বুড়ে মানুষ-ডা মিয়ের বাড়িত বেড়াতি আসে মরে গেল। সকালে জানাজা। আপনে যদি ইট্টু দয়া না করেন তাহলি ভর রাত এই মরা পওর পারা লাগবেনে। চলেন ভাইডি কয়ডা ট্যাহা ধরে দেবন হানে।
কি আর করা চলেন।
আপনি শুঁটকার মোড়ে যায়ে আমার নাম কয়েন। আমার নাম রফিক। দেখপেন নে বাড়ির সামনে একটা দোকান আছে। মরা বাড়িত এমনি লোক জড়ো হয়ে আছে, গেলিই ঠিক পাবান্নে । যাতি তো মাততোর বিশ মিনিট লাগবানে। আপনে নিয়ে যান আমি পিচ পিচ সাইকেলে আসতিছি।
কিছু দূর যাবার পরে রাস্তার দুই পাশ একদম ফাঁকা, আশপাশে দুই চার মাইলের মধ্যে কোন বসতি নেই। রবির গা ছমছম করছে। সে জোরে গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ মানুষের গলা পেয়ে সে গাড়ির গতি কমায়। পিছে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে গাড়ির গতি বাড়ায়। আবার জোড়ে জোড়ে কথা শুনতে পায়। ব্যাপার বুঝতে না পেরে সে গাড়ি থামায়। তখন মরা বলে, কিরে মরে গেছি বলে কি গায়ে ব্যথা লাগে না, আস্তে চলাহ্- বলে জোড়ে ধমক দেয়। রবি পালায় গাড়ি থুয়ে, আর মরা পালায় গাড়ি নিয়ে।
মরার গাড়ি ছিনতাইয়ের কাহিনী হাটে, মাঠে, ঘাটে, হেঁসেল, ইশকুল কলেজ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার চমৎকারিত্বের মজা কানে কানে মজে যাবার আগেই রবি আবার টেম্পো চালাতে লাগল, তবে; এবার নিজের গাড়ি না ভাড়া গাড়ি। রবির গাড়িতে যারা উঠে তাদের কাছে মরার কাহিনী সে করুন ভাবে বর্ণনা করে, যারা শুনে তাদের কেউ মজা পায় কেউবা তার দু:খে দুখী হয়ে সমবেদনা জানায়। আস্তে আস্তে সব ঘটনা বাসি হয়ে আসে।
হাজীর হাট পার হয়ে গাড়ি কাল ধোঁয়া ছাড়তে থাকে, হাঁপানি রুগীর মত ধুকতে ধুকতে এডরুকের কাছে এসে গাড়ী নষ্ট হয়ে গেল। সে আনেক চেষ্টা করল কিন্তু গাড়ি আর চালু হল না। আধা মাইল ফাকেই গন্তব্যের শেষ, কিন্তু এই সুযোগে যাত্রীদের কেউ আধা ভাড়া, কেউ ভাড়া না দিয়েই কেটে পড়ল। ফাকা গাড়িতে বসে সে ভাবছে যাহ্ শালা! সারা পথ দৌড়ানের পর দুয়েরে আসে আছাড় খালেম। সে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে অনন্ত সিনেমা হলের মোড়ে নিয়ে গেল। রবি গাড়ির তেলের পাইপে মুখ লাগিয়ে উবু হয়ে ফুঁ দিচ্ছে। শহরের এক পরিচিত লোক যে রবির সব দু:খের কাহিনী আগাগোড়া জানে, সে রিক্সায় যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, নিজের ফুটো শক্ত করে এটে ধরে ফুঁ দিয়েন ভাই, না হ’লে সব ফুঁ পিছন দিয়ে বের হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ রাত ৩:০৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×