
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস । বহির্মুখী জীবনে যা কিছুই করি না কেন ? বই পড়া আমি কখোনো ছাড়িনি। কাগজের ঠোঙ্গা থেকে মোটা মোটা বিশ্বকোষের ভলিউম । বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার কোন রুচি বোধ নেই। বহু মতাদর্শের সাথে পরিচিত হওয়ার কারনে কোন বিষয়েই আমি গোলক ধাঁধায় নিমজ্জিত হই নাই। তবে কিছুটা হলেও আমার চিন্তা ভাবনায় দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের দর্শন প্রভাব আছে বলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়।
ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪)
ইমানুয়েল কান্ট ১৭২৪ সালের ২২ এপ্রিল প্রুশিয়ার কোনিগসবার্গ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা আনা রেজিনা প্রুশিয়ার নাগরিক হলেও, তার বাবা গ্রেগর কান্ট ছিলেন জার্মান অধিবাসী। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ৯ সন্তানের ৪র্থ জন। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার পর তার নামের পাশে ইমানুয়েল শব্দটি যোগ হয়। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাইবেল এবং ল্যাটিন দিয়ে। পারিবারিক কঠোর বিধিনিষেধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের মাঝে বড় হতে থাকা কান্ট খ্রিস্টধর্মের একজন কঠোর বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তবে বয়স এবং জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে তিনি সংশয়বাদী হতে থাকেন এবং এক সময় ধর্মকর্মের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন।
গৃহী মানুষ হিসেবে ইমানুয়েল কান্টের নাম আছে। প্রচলিত আছে যে, তিনি তার বাড়ি থেকে কখনো ১৬ কিলোমিটারের অধিক দূরে গমন করেননি! যদিও তথ্যটি ভুল, তথাপি তার জীবন কেটে গিয়েছিল কোনিগসবার্গ শহরেই! কদাচিৎ শহরের বাইরে গেছেন জরুরি প্রয়োজনে। ফ্রিডেসিয়ানাম কলেজে পড়ালেখা শেষ করে ১৭৪০ সালে ভর্তি হন কোনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি দর্শনের ছাত্র হন, পড়তে শুরু করেন লেবিনিজ এবং ক্রিশ্চিয়ান উলফের দর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে প্রাথমিকভাবে গৃহশিক্ষক হয়ে জীবিকার্জন করতেন কান্ট। পরবর্তীতে কোনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক পদে যোগ দেন তিনি। প্রাথমিকভাবে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। ‘জেনারেল হিস্ট্রি অব নেচার’, ‘আপন নিউটনিয়ান প্রিন্সিপালস’ এবং ‘জেনারাল নেচারাল হিস্ট্রি অ্যান্ড সেলেশ্চিয়াল বডিজ’- এই তিনটি বই তিনি ১৭০-৫৫ সালের মধ্যে প্রকাশ করেন।
দর্শনে তার প্রথম পদক্ষেপ ‘ফলস সাটলটি অব দ্য ফোর সিলোজিস্টিক ফিগারস’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৬০ সালে। এরপর আর কখনোই দর্শনের বাইরে পা রাখেননি কান্ট। ২ বছর পর প্রকাশিত হয়, সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত গ্রন্থ ‘দ্য অনলি পসিবল আর্গুম্যান্ট ইন সাপোর্ট অব আ ডেমনস্ট্রেশন অব একজিস্ট্যান্স অব দ্য গড’। এই বইয়ে তিনি ধর্মের উপর যুক্তির প্রাধান্য স্থাপন করে সমালোচনার শিকার হন। আবার দর্শনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব খুঁজে প্রশংসিতও হন। এরই মাধ্যমে তিনি দার্শনিক হিসেবে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং নিজের স্থান অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে ১৭৬০ সালেই হঠাৎ তার কলম নীরব হয়ে যায়। এই নীরবতা ভাঙতে সময় নেয় ২১ বছর!
কলম নীরব হলেও, তার ভাবনার চাকা ঠিকই সচল ছিল। দীর্ঘ ২১ বছরের চিন্তার প্রতিফলন তিনি ঘটিয়েছিলেন ১৭৮১ সালে প্রকাশিত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’-এ। এটি প্রকাশের সাথে সাথেই তার নাম উঠে যায় সর্বকালের সেরাদের তালিকায়। এরপর একে একে প্রকাশ করেন ‘গ্রাউন্ডওয়ার্ক অব মেটাফিজিক্স’, ‘ক্রিটিক অব প্র্যাক্টিক্যাল রিজন’, ‘মেটাফিজিক্যাল ফাউন্ডেশন অব ন্যাচারাল সায়েন্স’, ‘ক্রিটিক অব জাজমেন্ট’, ‘রিলিজিয়ন উইদিন দ্য বাউন্ডস অব বেয়ার রিজন’ সহ অমর সব দর্শনের বই। ১৮০২ সালে লিখতে শুরু করেন ‘ওপাস পোস্টুমাম’ নামক একটি গ্রন্থ যা আর শেষ করে যেতে পারেননি। ১৮০৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ৮০ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কোনোদিন বিয়ে করেননি। সমগ্র জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানচর্চায় আর ভাবনায়। তার সে সব ভাবনা আজ দর্শনের অমূল্য সম্পদ, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের পাথেয়।
ফিচার ছবি: justillon.de
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



