ছবি - গুগল।
‘কর্তৃত্ববাদী আচরণের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় ট্রাম্পের উত্থান ঘটেছে এবং তার পুরো শাসনকাল জুড়ে সেই আচরণ অব্যাহত ছিল। এমন চরিত্রের একজন মানুষের জন্য নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করার চেয়ে কারচুপির অভিযোগ করাটাই সহজ’।
মামলায় জিতে নির্বাচনী ফল উল্টে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি ধরে রাখতে পারবেন, তেমন সম্ভাবনা আর নেই বললেই চলে। সুতরাং তাঁর বিদায় নিশ্চিত। তবে সেই নিশ্চিত বিদায়টা ট্রাম্প ভীষণ গোলমেলে করে তুলবেন এবং এই লক্ষ্যে তিনি বাকি দিনগুলোতে নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করবেন, এমন ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ঝড়ের শুরুটা এরই মধ্যে করেছেনও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এরই মাঝে তিনি তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে বরখাস্ত করেছেন। এরপর হয়তো তিনি সিআইএ পরিচালক জিনা হাসপেল ও এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রেকে বরখাস্ত করবে। এসপারের বরাত দিয়ে সিএনএনকে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যিনি এরই মধ্যে বরখাস্ত হয়েছেন এবং যাঁরা বরখাস্ত হতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের সবার অপরাধ একটাই—ট্রাম্পের নির্বাচনী স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে তাঁরা জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছেন।
প্রেসিডেন্সি ক্ষমতার অন্যান্য অপব্যবহারও করছেন ট্রাম্প। প্রথা অনুযায়ী আসন্ন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহযোগীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা থাকলেও উল্টো সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছেন তিনি। অথচ নির্বাচনে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই প্রক্রিয়া শুরুর রেওয়াজ রয়েছে।
ছবি - গুগল।
ট্রাম্পের আরো বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগেই ট্রাম্প অস্থিতিশীল আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনাকে দেশে ফিরিয়ে আনবেন, এমনকি এশিয়াজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় মৌলিক পরিবর্তন আনবেন। সত্যিই তেমন কিছু ঘটলে পরিস্থিতি পাল্টানো জো বাইডেনের জন্য কঠিন হবে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা।ঝামেলা যে শুধু ট্রাম্পই পাকাবেন, তা নয়। তাঁর অনুগত রিপালিকানরাও এতে অংশ নিতে পারেন। ট্রাম্প যেহেতু মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সুতরাং পরাজয় স্বীকার করে জনমনে স্বস্তি দিতে তিনি দেরি করবেন তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণাও এখনো অপেক্ষমাণ। চূড়ান্ত সেই দিনটির আগে রিপাবলিকানরা বাইডেনের জয়কে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করার চরম প্রয়াস চালাবে, এমন আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এদিকে মার্কিন বাহিনী আবারো মধ্যপ্রাচ্যে বি-৫২ এইচ স্ট্রাটোফোরট্রেস বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাথে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সংঘাত বাড়াতে পারেন বলে আশঙ্কা যখন জোরদার হয়েছে ঠিক তখনই মার্কিন বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে এই বিমান মোতায়েন করল। আর এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আবার সংঘাতের আশংকা জোরদার হচছে।
কয়েকদিন আগেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেছিলেন যে তিব্বতের বাসিন্দাদের ওপর চীনের সরকার অকথ্য অত্যাচার করছে চীন। আর তারপরই আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে হোয়াইট হাউজে ঘুরে এলেন তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধান লোবসাং সাঙ্গে।জানা গেছে, প্রায় দীর্ঘ ৬০ বছর পরে হোয়াইট হাউজে গেলেন তিব্বতের কোনও নেতা। এই ঘটনায় এখনো চীনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। এ দিকে পর্যন্ত হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।তবে এর ফলে যে চীনের সাথে নতুন করে আরো সমস্যা তৈরী হবে এটা নিশ্চিত।
প্রেসিডেন্সি ত্যাগের আগ পর্যন্ত ট্রাম্প এরকম নানা অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড চালালে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, কর্তৃত্ববাদী আচরণের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় ট্রাম্পের উত্থান ঘটেছে এবং প্রেসিডেন্সিকালজুড়ে সেই আচরণ অব্যাহত ছিল। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক রুদ বেন গিয়াট ট্রাম্পের মধ্যে ‘প্রতিশোধপরায়ণতা’ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্টের শেষ দিনগুলোর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাল্টিমোরভিত্তিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জন গার্টনারের মতে, ট্রাম্প ‘মারাত্মক আত্মপ্রেমী’। আর তাই এমন একজন মানুষ পরাজয় মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সমর্থকদের কাছে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করবেন এবং সেটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন বিজয়ী হলেও এতদিন তার জয় স্বীকার করতে চাননি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশেষে সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসছেন বলে মনে হয়। গত রবিবার (১৫ নভেম্বর) বাইডেনের জয় স্বীকার করলেও নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছেন ট্রাম্প। এক টুইটে এমন কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
টুইটে বাইডেনের নাম না উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, তিনি জিতেছেন নির্বাচনে জালিয়াতি করে। কোনও নির্বাচনি পর্যবেক্ষক ছিল না, ভোট গণনা করেছে কট্টর বামপন্থী ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠান ডমিনিয়ন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নাম রয়েছে। তাদের সরঞ্জামগুলো খুবই বাজে, যা টেক্সাসের ভোট গণনার জন্যও যথাযথ ছিল না।
নির্বাচনের পরপরই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মামলা করেছিলেন ট্রাম্প। এরই মধ্যে তার প্রায় সব মামলাই খারিজ হয়ে যাচ্ছে বা গিয়েছে। ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ না থাকায় আদালতে দায়ের করা মামলায় বাস্তব কোনো সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে ট্রাম্প শিবির। তবে ভোট কারচুপির কোনো অস্তিত্ব নেই বলেই মত দিয়েছেন বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।চলতি সপ্তাহেই ট্রাম্প এবং তার রিপাবলিকান সমর্থকরা চারটি পৃথক রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল আটকানোর জন্য করা মামলায় পরাজিত হয়েছেন বা তাদের মামলা খারিজ করা হয়েছে।অ্যারিজোনা,জর্জিয়া,মিশিগান,নেভাদা,পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন রাজ্যে রিপাবলিকানদের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ খারিজ হয়েছে বা খারিজ হওয়ার পথে।কারন ভোট জালিয়াতইর আবেদনের পক্ষে আদালতের সামনে কোনো সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি রিপাবলিকানরা।
ছবি - গুগল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচিত-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টায় সফল হবেন না ট্রাম্প। তবে তার এই ভিত্তিহীন দাবির পুনরাবৃত্তি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা হ্রাস করছে এবং ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে এই ধারণা জাগিয়ে তুলেছে যে বাইডেন একজন অবৈধ প্রেসিডেন্ট হবেন।
এদিকে গত শুক্রবার (২০ নভেম্বর) মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েট শহরের একটি সংগঠন ও তিনজন ভোটার ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল জেলা আদালতে নির্বাচনের ফল অনুমোদনে বারবার বাধা দেওয়ার অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মিশিগান ওয়েলফেয়ার রাইটস অর্গানাইজেশন নামের ওই সংগঠন ও তিন ভোটার মামলায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মিশিগানে নির্বাচনের ফল অনুমোদনে বাধা দেওয়ায় এবং আইনপ্রণেতাদের চাপ দেওয়া থেকে ট্রাম্পকে বিরত থাকতে আদালতকে আদেশ দিতে অনুরোধ করেন।সেইসঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের বঞ্চিত করা বিশেষ করে ওয়েইন কাউন্টির ভোটারদের বঞ্চিত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
ট্রাম্প ১৯৬৫ সালের ভোটাধিকার আইনের ১১ (বি) ধারা লঙ্ঘন করেছেন বলেও মামলায় দাবি করা হয়। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিশিগানের ভোটের ফল অনুমোদনে তাঁর দল, রাজ্য ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছেন। ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত শহরগুলোকে টার্গেট করে ভোটে জালিয়াতির মিথ্যা অভিযোগ বারবার করছেন এবং এসব অভিযোগ আদালত থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছে।এর আগে মিশিগানে ট্রাম্প শিবিরের করা মামলা খারিজ করে দেন স্থানীয় আদালতের এক বিচারক। গত ৬ নভেম্বর ওই আদালতের বিচারক সিনথিয়া স্টিফেনস মামলাটি খারিজ করে দেন।
ট্রাম্প প্রশাসনেরও কিছু কর্মকর্তা একান্তে বলেছেন, তারা বুঝতে পারছেন বাইডেন জিতেছেন। কিন্তু পরাজয় মেনে নিতে প্রেসিডেন্টের আরো সময় প্রয়োজন।সার্বিক অবস্থা দেখে যা মনে হয় পূর্ব নির্ধারিত সময়ে ( ২০২১ সালের জানুয়ারী ২০ ) তারিখেই ট্রাম্প যাবে কারন তার আবারো ক্ষমতায় থাকার মত নৈতিক বা আইনি কোন অবস্থানই আর নেই । তবে যাওয়ার আগে তিনি ঠিক কতটা ক্ষতি আমেরিকা তথা বিশ্বপরিস্থিতির করে যান সেটাই এখন দেখার বিষয়।
২০২০ আমেরিকার নির্বাচন পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট ৩ - Click This Link
তথ্যসূত্র : এএফপি, সিএনএন এবং দৈনিক সংবাদপত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৩৯