somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

" সাম্প্রতিক ফিলিস্তিন সংকটের কারন এবং ইসরাইলের বর্তমান অবস্থা " - কোন বার্তা দেয় বিশ্বকে ?

২০ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি- রয়টার্স

ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে লড়াই এখন যেরকম তীব্র হয়ে উঠেছে তা একটি "পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে" রূপ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ।সর্বশেষ এই সহিংসতা শুরু হয়েছে জেরুজালেমে এক মাস ধরে চলতে থাকা তীব্র উত্তেজনার পর। কিন্তু ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের এই দীর্ঘ সংঘাতের পেছনের ইতিহাস আসলে কী?

পূর্ব জেরুজালেম, গাযা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে উঠে।গাযা শাসন করে কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি দল হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাযার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল এবং মিশর, যাতে হামাসের কাছে কোন অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে।

গাযা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছে, ইসরায়েলের নানা পদক্ষেপ এবং কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে আছে। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করে যে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়।এবছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি রমজানের শুরু থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তখন প্রায় প্রতি রাতেই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল।

পূর্ব জেরুজালেম তথা শেখ জাররাহ হতে কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি ফিলিস্তিনিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।


ছবি-bdnews24.com

ফ্ল্যাশপয়েন্ট - শেখ জাররাহ উচ্ছেদ

সম্প্রতি শেখ জাররাহে উচ্ছেদের প্রশ্নটি অনেক ফিলিস্তিনিদের কাছে স্পষ্টতই ফ্ল্যাশ পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। কারণ ইসরাইলি আইনে ফিলিস্তিনিদের তাদের মৌলিক অধিকার দেয় না।ইসরাইলী আইন অনুসারে, ইহুদিরা ১৯৪৮ সালের আগে কোনো এক সময় জমির মালিক থেকে থাকলে সেই জমি পুনরায় দাবি করতে পারে, তবে ফিলিস্তিনিরা এখনো পর্যন্ত যে জমিতে বাস করছে তা-ও তারা আইনত দাবি করতে পারে না। এটি স্পষ্টতই রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন। কার্যত এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার নেই এবং তারা কাজ করতে বা শান্তিতে থাকতে পারবে এমন কোনো আশা নেই। এটি অব্যাহত অস্থিরতার এবং সামজিক বৈষম্যের একটি প্রকট বিষয় বলে সবাই ধরে নিয়েছে।

প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ছিল একেবারেই পরস্পরবিরোধী। এতে প্রকাশ্যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, আবার ইসরাইলকে বসতির জন্য পশ্চিম তীরের বেশির ভাগ প্রদান করা হয়। এতে করে ফিলিস্তিনিদেরকে কেবল একটি ক্ষুদ্র এলাকা দেয়া হয় যেটি ইসরাইল দ্বারা বেষ্টিত এবং নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু ছিল না, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষাকারী ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা কুশনার সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করেননি। এর মাধ্যমে মূলত "দ্বি রাষ্ট্রীয়" সমাধান ফর্মুলার ইতি ঘটানো হয়েছে।

বর্তমান আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বাইডেন প্রশাসনের কাছে এখন "এক-রাষ্ট্রীয়" সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সমাধান প্রশ্নে সাংবাদিক পিটার বাইনার্ট বলেন ,"নাগরিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এখন বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্যের চেয়ে বাস্তবসম্মত"।এখন প্রশ্ন হলো, সেটিও কিভাবে সম্ভব যেখানে বংশপরম্পরায় বসতি করা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে বের করে দিয়ে দখলে নেয়া হচ্ছে। এমনকি, প্রকাশ্যে বোরকা না খোলার জন্য গুলি করে ফিলিস্তিনি কিশোরীকে হত্যা করা হচ্ছে।

শেখ জাররাহ জেরুসালেমের ওল্ড সিটির উত্তরে অবস্থিত, এই অঞ্চলের নামটি মুসলিম সেনাপতি গাজি সালাউদ্দিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের নামে, যিনি ক্রুসেডারদের কাছ থেকে জেরুসালেম অধিকার করেছিলেন। এটি ফিলিস্তিনি পরিবারের বহু প্রজন্মের বাসস্থান। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে কয়েক লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে জর্দানের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে পালিয়ে যায়। ১৯৫৬ সালে, জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থা জর্দান ও ইউএনআরডাব্লিউর সহায়তায় ২৮টি ফিলিস্তিনি শরণার্থী পরিবার শেখ জাররাহে চলে যায়। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল শেখ জাররাহসহ বাকি পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়। এরপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটাকে ‘দখলকৃত অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করে যেখানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুসারে, ইসরাইলের আইন চলে না। আর এই জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যতের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে কল্পনা করে।

ইসরাইল ১৯৭০ সালের ‘সম্পদ আইন’ পাস করার কয়েক দশক পরে, যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক নাহালাত শিমন সংগঠনসহ ইহুদিপন্থী বন্দোবস্তকারীরা শেখ জাররাহে জমি দাবি করার জন্য একের পর এক মামলা শুরু করে। এ কারণে জাতিসঙ্ঘের অনুমান, পূর্ব জেরুসালেমজুড়ে প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি উচ্ছেদের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা বলেছেন যে, ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা এই শহরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দখল করতে আসা এক ইহুদি বাড়ির অধিবাসী ফিলিস্তিনি মহিলাকে বলতে শোনা যায়, "আমি যদি আপনার বাড়ি চুরি না করি, তবে অন্য কেউ এটি চুরি করবে"।

অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলেছে, শেখ জাররাহে যা ঘটছে তা ফিলিস্তিনিদের সাথে বৈষম্যমূলক ইসরাইলি ভূমি দখল অনুশীলনের প্রতীক। জাতিসঙ্ঘ গত সপ্তাহে ইসরাইলকে সতর্ক করে, ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে নিষিদ্ধ এবং এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমর, ইন্ডিয়ানার আন্দ্রে কারসন এবং মিশিগানের রাশিদাত লাইব এক বিবৃতিতে বলেছেন, কয়েক দশক ধরে, আমরা একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য লিপ সার্ভিস দিয়েছি; ভূমি দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি অব্যাহত রেখে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ইসরাইল শেখ জাররাহ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে আল-আকসা মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে ধর্মীয় সমাবেশে অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করে এবার। ইসরাইলি পুলিশ আল- আকসায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্টের মতে শত শত লোককে ইসলামের এই তৃতীয় পবিত্রতম স্থানে আহত করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় হামাস গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলে রকেটের একটি ‘ব্যারেজ’ নিক্ষেপ করে সাড়া ফেলে দেয়।

ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাস’ ফিলিস্তিনের সাম্প্রতিক নির্বাচন বাতিল করার সিদ্ধান্তে এমনিতেই ক্ষুব্ধ। এরপর আল-আকসায় হামলা আর শেখ জাররাহের ভূমি দখলের বিরুদ্ধে তারা সরব হয়। হামাস রকেট হামলা করে পূর্ব জেরুসালেমের ঘটনার ব্যাপারে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হামাসের সরব হওয়ার জন্য এমন একটি পরিস্থিতি নেতানিয়াহু ইচ্ছা করেই সৃষ্টি করেছেন বলে মনে হচ্ছে।


ছবি- jagonews24.com

নয়া আঞ্চলিক মেরুকরণ -

উপসাগরীয় দেশগুলো এই ইস্যুতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলো ও ইসরাইলের মধ্যে ট্রাম্প-মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি সম্পাদনে এমন একটি ধারণা তৈরি হয় যে, ফিলিস্তিনি ইস্যু আর রাজনৈতিকভাবে উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে, আলজাজিরায় গাজায় বোমা ফাটানো বিল্ডিং এবং লাশের ফুটেজ দেখানোর পর আরব জনমতে এর প্রভাব পড়ে। ফলে ওআইসির জরুরি সভায় সবাই প্রায় একইভাবে গাজায় ইসরাইলি তাণ্ডবের নিন্দা করেছেন। আর এটি যদি উপসাগরীয় দেশগুলোকে ইসরাইলের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করে, তবে সেখানে উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য নেতানিয়াহু সরকারকেই দোষ দেয়া হবে।

উচ্ছেদের প্রশ্নটি দীর্ঘ দিন ধরে উষ্ণ হয়ে আসছে। ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি উত্তেজনার ভয়ে এ বিষয়ে শুনানি স্থগিত করেছে। তবে ইসরাইলি পুলিশ বিক্ষোভের প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল এবং পূর্ব জেরুসালেমে তাদের ক্র্যাকডাউনগুলো প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র ছিল। তারা রমজানে নামাজের সময় আল-আকসার মতো একটি অতি স্পর্শকাতর মসজিদে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করেছে।

এমা অ্যাশফোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলিসি’ সাময়িকীকে বলছেন, “বাস্তবতা হলো, সেখানে যা ঘটছে তা অনুমোদনের মতো নয়। সন্ত্রাসবাদ ঘৃণ্য; তবে এটি মূলত সহিংসতার একটি রাজনৈতিক রূপ। এটি ঘটে যখন কোনো গোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক অভিযোগ থাকে এবং যা নিয়মিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা যায় না। আর এই ক্ষেত্রে ট্রাম্পের , "শতাব্দীর সেরা চুক্তি" এবং সাম্প্রতিক ইসরাইলি নীতিগুলো এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে ইসরাইল-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে কার্যকরভাবে বসবাসরত দারিদ্র্যপীড়িত ফিলিস্তিনিদের বিশাল একটি গ্রুপকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এর সমাধান হিংস্রতায় নয়। এর একটি রাজনৈতিক সমাধানের সন্ধান করতে হবে, যেমনটি ওয়াশিংটন সাবেক যুগোস্লাভিয়া এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে করতে সহায়তা করেছিল।”

আমেরিকান ইহুদিদের বেশির ভাগই ফিলিস্তিনের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান এবং সঙ্কট সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে সমর্থন করে এবং একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তির জন্য পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনা সরিয়ে দেবার পক্ষে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে রাজনৈতিক মূলধন ব্যয় করতে চায় না। এমা মনে করেন, নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত এজেন্ডার কারণে এগুলো ঘটছে। কারণ তিনি এর আগে ২২ মে ইসরাইলে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ইসরাইলি রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়ার ল্যাপিডকে সরকার গঠনের জন্য অনুরোধ করেছেন। এর আগে ইয়ামিনা পার্টির চেয়ারম্যান বেনেট ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি ল্যাপিডকে সমর্থন করবেন এবং তার দলের সাতটি আসন রয়েছে যা ল্যাপিডের পক্ষে ৬১ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যথেষ্ট। নতুন পরিস্থিতিতে বেনেট সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। নেতানিয়াহু সম্ভবত এটিই চেয়েছিলেন। বেনেট ছিলেন লিকুদ দলে নেতানিয়াহুর প্রতিদ্বন্দ্বী, যিনি নির্বাচনের আগে লিকুদ পার্টি ত্যাগ করেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো, এর জন্য কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে ইসরাইলকে ? ১৬ মে যুদ্ধপরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ইসরাইলের ডানপন্থী পত্রিকা জেরুসালেম পোস্টে একটি কলাম লিখেছেন, TZVI JOFFRE। "ইসরাইল যুদ্ধ জিতেছে, লড়াইয়ে জিতেছে হামাস" শীর্ষক এই লেখায় তিনি বলেছেন, ‘ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ‘অপারেশন গার্ডিয়ান অব দি ওয়ালস’ এ দুর্দান্ত সাফল্য লাভ করেছে, তবে এর মধ্যেই ঘরটি ভিতরে থেকে ভেঙে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে।’ তার মূল্যায়ন হলো, "হামাস সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিবৃতির পর বিবৃতিতে যা অর্জন করতে পারেনি তা করেছে বিদ্বেষের ব্যাপারে ঐক্য দিয়ে। এটি লেবানন, জর্দান, পশ্চিম তীর এবং এমনকি ইসরাইলের আরব সম্প্রদায়কে এমন ভীত করেছে যে, ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সবার ক্ষোভ একত্রিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরাইল হয়ে পড়েছে বিভক্ত, রাজনৈতিক কলহ, অস্থিতিশীলতা এবং মারামারিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন"।

চলমান সংঘাতের পর কী হবে বা হতে পারে ?

ইসরাইল সম্ভবত গাজা বা লেবাননে স্থল অভিযান পরিচালনা করবে না, যা তাদের জন্য ভুল খেলা হতে পারে। গাজায় ইসরাইলের শেষ স্থল আক্রমণে আল কাস্সাম ব্রিগেডের সাহসিকতায় তারা পিছু হটেছিল। ফলে ইসরাইল এখন আর গ্রীষ্মকালে হিজবুল্লাহর সাথে লড়াইয়েরও ঝুঁকি নিতে চাইবে না। তদুপরি, সিরিয়া থেকে চালিত সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের গভীরে প্রবেশ করেছে যা ইসরাইলের নিউক্লিয়ার প্লান্টের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ইসরাইলের ‘আয়রন ডোম’ এটি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়।

ইরান ও তুরস্ক উভয়ের কাছে আরো আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে যা ইসরাইল কখনো থামাতে পারে না। ‘ছয় দিনের যুদ্ধের’ দিনগুলো সম্ভবত চলে গেছে। ইরান স্থল থেকে স্থল ও আকাশে এবং পানির গভীরে ব্যবহারক্ষম দীর্ঘ পরিসরের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। তুরস্ককে সিরিয়ায় অবস্থিত তার সেনাবাহিনীকে এই ইস্যুতে জড়িত করার প্রয়োজন হবে না। সৌদি আরব ও মিসরের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগের মধ্যেই অনেক বার্তা রয়েছে। ইসরাইলি বিনিয়োগে ইথিওপিয়ায় নীল নদের উৎসে বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ মিসরের অর্থনীতির জন্য বাঁচা মরার প্রশ্ন। ইসরাইলের ইহুদিদের অনেকে বিশ্বাস করে, মুসা নবীর হারিয়ে যাওয়া সিন্ধুকটি ইথিওপিয়ায় পাওয়া যেতে পারে। ইসরাইলের অনেকে দেশটিতে ‘দ্বিতীয় ইহুদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে।

ইথিওপিয়ায় নীল নদের উপর দেয়া ‘রেনেসাঁ বাঁধ’ চালুর উদ্যোগ ইসরাইলের বাইরে, তুরস্কের মতো বড় আঞ্চলিক শক্তির সাথে সমঝোতায় আসতে উৎসাহিত করেছে মিসরকে। এটি মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক খেলাকে পাল্টে দিয়েছে। এর মধ্যে এরদোগানের সৌদি বাদশাহকে করা ফোন কলটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়টাতে সৌদি আরবে কাতারি আমির, তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সফরও তাৎপর্যপূর্ণ। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন নিয়ে এর মধ্যে এরদোগান ১৯ জন রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে কথা বলেছেন। তিনি খেলছেন কূটনীতির ময়দানে, আর ইরানের কাজ সম্ভবত প্রতিরোধ যুদ্ধকে শক্তিমান করার ক্ষেত্রে। ইসরাইলের খুব গভীরে ইসলামী জিহাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত নেতানিয়াহুর চোখের নিচে কালো আস্তরণ ফেলেছে। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে ওয়াশিংটনকে বার্তা দিয়েছেন।

তুরস্ক - ইরান- পাকিস্তান - সৌদি আরব - মিসর - কাতার- এসব দেশের মধ্যে যেকোনো মাত্রার সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব নিকাশকে পাল্টে দিতে পারে। ইসরাইলকে যত বড় বাঘ মনে করা হয়, বাস্তবতা সে রকম নয়। দেশটির প্রযুক্তিগত উন্নতির সীমাবদ্ধতা হামাস বা হিজবুল্লাহর মতো শক্তির সাথে সঙ্ঘাতেই প্রকট হয়ে উঠছে।

আমেরিকার সামরিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তার বাইরে চিন্তা করা হলে ইসরাইলের ক্ষমতা তার ভূখণ্ডগত অবয়বের মতোই সঙ্কীর্ণ। ১৯৪৮, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সাল আর ২০২১ সাল এক নয়। ৯৩ লাখ জনসংখ্যার ইসরাইলের ৫৪ লাখ ইহুদির ৯৫ ভাগই এখন একই সাথে অন্য কোনো দেশের নাগরিকও। তাদের অনেকেই দেশটির নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে বিকল্প আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। হামাসের রকেট নিক্ষেপে সতর্কঘণ্টা বেজে ওঠার সাথে সাথে সবাইকে বাংকারে জীবনপণ ছুটতে দেখা যাচ্ছে।

দেশটির অভ্যন্তরীণ নাগরিক সংহতিও এতটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে যে, চারবার নির্বাচন করেও সরকার গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। পাঁচ মিশালি সংস্কৃতির ইহুদি জনগোষ্ঠী যে যার মূল দেশের নেতাদের প্রতি বেশি আনুগত্য পোষণ করছে। রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। একসময় ইহুদিদের ধর্মনিষ্ঠতাকে গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। এখন যৌন ব্যবসার বৈশ্বিক কেন্দ্রগুলোতে বেশি ভিড় জমায় ইসরাইলিরা। ইসরাইলি সমাজকে যারা গভীর থেকে নিরীক্ষণ করেন এই বিষয়গুলো তাদের নজর এড়ায় না। এ কারণে কিসিঞ্জার, খামেনি অথবা সাবেক শিন বেত প্রধান অদূরভবিষ্যতে ইসরাইল রাষ্ট্রকে অস্তিত্বহীন দেখতে পাচ্ছেন।

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মূল সমস্যাগুলো কী?

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিরা বেশ কিছু ইস্যুতে মোটেই একমত হতে পারছে না।এর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে? পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদী বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে, নাকি সরিয়ে নেয়া হবে? জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে? আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে- ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কি আদৌ গঠিত হবে,এ প্রশ্ন।গত ২৫ বছর ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোন সমাধান এখনো মেলেনি।


ছবি- jagonews24.com

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ তাহলে কী?

এক কথায় বলতে গেলে, খুব সহসা এই পরিস্থিতির কোন সমাধান মিলবে না।সংকট সমাধানের সর্ব-সাম্প্রতিক উদ্যোগটি নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটিকে "ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি" বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছিল একেবারেই একতরফা একটি উদ্যোগ বলে। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ নিয়ে আসলে কাজ মোটেই এগোয়নি।ভবিষ্যতের যে কোন শান্তি চুক্তির আগে দুপক্ষকে জটিল সব সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে।সেটি যতদিন না হচ্ছে, দুপক্ষের এই সংঘাত চলতেই থাকবে।

আর এতসব সমস্যার মাঝে,সাম্প্রতিক সংকটে হামাসের সাথে ইসরাইলের সামরিক দূর্বলতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসরাইলের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কেউ কেউ এর পেছনে ইসরাইলের জনসংখ্যামিতি ও আদর্শবোধ,কেউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি আবার কেউ ডিভাইন কিছু দেখতে পাচ্ছেন। তবে ভেতর থেকেই যে ইসরাইল রাষ্ট্রের ক্ষয় হচ্ছে সেটি প্রকাশ পেতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। ইসরাইলের পক্ষে উচ্চতর প্রশিক্ষিত সশস্ত্রবাহিনী, মার্কিন সরকার এবং রথচাইল্ড পরিবারের অন্ধ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে একপর্যায়ে তার আধিপত্য বিস্তারে টান পড়তে শুরু করবে। রাশিয়ানদের এবার মুসলমানদের সমর্থন করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। চীনের বার্তায়ও তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্পের সাথে পুতিনের ভুল সহযোগিতার পরিস্থিতি এবার থাকবে না। কেউ কেউ এমন ইঙ্গিতও দেন যে, মুসলমানরা মধ্যপ্রাচ্যে গোঁড়া অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে সমর্থন পাবে এবার। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, যিশুকে ইহুদিরাই হত্যা করেছিল। এখনই এসপার ওসপার কিছু একটা হয়তো হবে না, তবে ভিতরে ভিতরে ইসরাইলের ক্ষয় যে শুরু হয়ে গেছে তা ইসরাইলের ভেতরে এবং বাইরে তা দৃশ্যমান।

এখন শুধু সময়ের এবং দেখার অপেক্ষা - বিশ্ব শক্তি কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করে বা ইসরাইলের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হয় এ সমস্যার উত্তরণে।

তথ্যসূত্র ও সহায়তায় - রয়টার্স,বিবিসি এবং উপসম্পাদকীয় (নয়া দিগন্ত - ১৮-০৫-২০২১)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:১৪
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×