somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সামুর ব্লগাররা অনেক মানুষকেই সাহায্য করে থাকেন, একটু ভেবে দেখুনতো এই রিক্সাওয়ালা ভাদ্রলোকের পাশে কি একটু দাড়ান যায় কি না!!

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুক্রবার রাত্রে ঘুমাইনি, ঘুমানোর পরিকল্পনাও ছিলোনা। বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিলো, কুয়াশার বৃষ্টি। বৃষ্টিটা উপভোগ করবো ভেবে খুব সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ভোর ৬টার দিকে শাহবাগের দিকে গেলাম একটা রিকশায়... এরপর হেঁটে হেঁটে ফাঁকা শহরে অনেক ঘোরাঘুরি করলাম, ভালোই লাগছিলো... শাহবাগ, কাকরাইল, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আজিমপুর এসব এলাকা হেঁটে যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছি তখন পেছন থেকে একজন রিকশাচালক এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।

আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছের একটি জায়গা। লোকটি বয়সে মুরুব্বি, অনেকটা আমার দাদা’র মতো দেখতে। শুদ্ধ ইংরেজিতে আমায় বললেন, ‘Where do you want to go, sir?’ উনার মুখে ইংরেজি শুনে আমি অবাক হলাম একটু, আগে কখনো একজন রিকশাচালকের মুখে ইংরেজি শুনিনি আমি। ভাবলাম উনি হয় এই ইংরেজিটা কারো কাছ থেকে শুনে মুখস্ত করেছেন, সেটিই আমার কাছে বলছেন। আমি একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলাম, ‘I wanna go Shahbag’। উত্তর এলো ‘Ok Sir, seat on my rickshaw!’এবার অবাক হওয়াটা চমকানোর পর্য্যায়ে পৌঁছালো। এরপর আমি ইংরেজিতে যতগুলো প্রশ্ন করলাম তার সবগুলো উত্তরই পেলাম ইংরেজিতেই। নির্ভুলভাবে, নেটিভ স্পিকারের মতো!

উনার রিকশায় উঠে বসলাম, ইংরেজিতে বললাম- আমার আসলে কোনো কাজ নেই এখন, ভবঘুরের মতো এদিক সেদিক একটু ঘুরতে চাই। আপনি আমাকে যেখানে খুশি নিয়ে যান। উনি আমাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরলেন।

উনাকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো। বললাম- চলুন আপনাকে নাস্তা করাই। রাজি হচ্ছিলেন না, অনেকটা জোর করেই একটা দোকানের সামনে দাঁড় করালাম রিকশা, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের একটি দোকান। এরপর আলাপচারিতা বাড়তে বাড়তে তিনি আমার সঙ্গে অনেক কাছের মানুষের মত কথা বলতে থাকলেন। ‘নানুভাই’ সম্বোধন শুরু করলেন।

যাত্রা আবার শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় তখন আমরা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরছি। এবার শুনলাম তার জীবনের করুণ কাহিনী।

গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে, একসময় গার্মেন্টসের ব্যবসা ছিলো। দুর্ভাগ্যক্রমে সে ব্যবসায় মন্দা যায় কয়েকবছর ব্যবসা করার পর, মূলধন খুইয়ে ফেলেন। অবশিষ্ট সবকিছু বিক্রি করে পাড়ি জমান প্রবাসে।

সবকিছু ভালোই যাচ্ছিলো, বিপত্তি বাঁধায় এক সড়ক দুর্ঘটনা। সে দুর্ঘটনায় সঙ্গী সবাই মারা যান, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান, যেটির চিকিৎসায় খরচা হয়ে যায় জমানো প্রায় সব টাকাই! নিঃস্বপ্রায় হয়ে দেশে ফেরেন, হয়ে পড়েন এক্কেবারে বেকার।

পারিবারিক প্রসঙ্গ জানতে চাইলাম, বললেন- আমার একজন ভাই ইঞ্জিনিয়ার, বোন ডাক্তার। তবে পারিবারিক সম্পর্কটা এখন খুব হালকা, যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গেই। ছেলে বিবিএ পড়ছেন, মেয়েও স্নাতকে। বিয়ের সময় হয়ে গেলেও আর্থিক অনটনের কারণে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। সামনে ছেলের সেমিস্টার পরীক্ষা, টাকা দিতে পারছেন না বলে পরীক্ষাটাও হয়ত দেয়া হবেনা তার।

ব্যবসায়ী থাকাকালীন সময়ে বেশ কয়েকজনকে আর্থিক সহায়তা করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তারা এখন লাখপতি, তবে চেনেননা তাঁকে। ভদ্রলোক ইংরেজিতেই অনেক কিছু বললেন আমাকে।

সারমর্ম এমন, বুঝতেই তো পারছ নানুভাই, একটা লেখাপড়া জানা একদার ব্যবসায়ী মানুষ কতটা আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়লে রিকশা নিয়ে পথে নামে! আমি অসহায় হয়েই, বাধ্য হয়েই এ বয়সে রিকশার প্যাডেল ধরেছি। ইচ্ছা ছিলো আর কিছু না পারি একটা সিএনজি কিনে নিবো, অন্তত আরোও একটু ভালোভাবে চলতে পারবো, জীবনের শেষদিনগুলো আরেকটু ভালোভাবে পার করতে পারবো। তবে সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না, তাই এভাবে রিকসার প্যাডেল আমাকে পা ছোঁয়তেই হলো।

আরোও অনেক কথা শুনলাম ভদ্রলোকের কাছ থেকে। শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে এলো। নিজের কাছে খারাপ লাগছিলো এমন একজন মানুষ আমার মতো অধমকে রিকশায় করে নিয়ে বেড়াচ্ছেন! উনাকে রিকশা থামাতে বললাম। ‘আপনার রিকশায় চড়ে নয়, আপনাকে আমি আজ নিজে রিকশা চালিয়ে শহর ঘোরাবো, প্লিজ আমায় নিষেধ করবেন না!’ বললাম উনাকে। উনি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। ভাবতেই পারছিলেন না একজন প্যাসেঞ্জার, যে কিনা কয়েক ঘণ্টা আগে তার সঙ্গে পরিচিত, সে তাঁকে রিকশায় করে শহর ঘোরাবে!

আমি উনাকে আস্তে করে বললাম, আপনি হয়ত এটাকে পাগলামি মনে করছেন, তবে বিশ্বাস করুন, আপনাকে যদি আজ আমি রিকশায় করে শহর ঘোরাতে পারি, অন্তত কিছু সময়ের জন্যও তাহলে নিজের কাছে খুব ভালো লাগবে, শান্তি লাগবে।
উনি কিছু বললেন না, রিকশার হ্যান্ডেল ধরলাম। ফাঁকা রাস্তায় এটি চলতে শুরু করলো।

ভালোভাবে প্যাডেল ধরতে পারছিলাম না, এনিয়ে প্রথম দিকে উনি খুব হাসলেন। হাসির মাঝেই ধীরে আমিও অনেক পথ এগিয়েছি রিকশা নিয়ে। এরপর পেছন থেকে কোনো শব্দ পাচ্ছিলাম না। কৌতুহল হলো, সামনে পথটা দেখে নিয়ে তাই আড়চোখে পিছে তাকালাম, দেখলাম ভদ্রলোকের দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে।

মনটা আরোও খারাপ হয়ে গেলো। একটু পর ফোঁপানির হালকা শব্দও শুনতে পেলাম। তবে না, যতক্ষণ রিকশা চালিয়েছি ততক্ষণ উনার সে চোখে আর তাকানোর সাহস পাইনি। কান্নার শব্দ শুনেও না!

লেখক: সাংবাদিক ও ব্লগার [email protected]

আল-আমিন কবির ভাইয়ের ব্লগ: Click This Link
-------------




সাহায্য তাদেরই করা উচিত যারা ধুকে ধুকে মারা যাবে তবু কারো মোখাপেক্ষি হবে না, কারো নিকট হাত পেতে চাইবে না। কারণ তার ভিতর আত্ন মর্যাদাবোধ আছে।


লেখাটি বাংলানিউজ২৪ এ পড়ে চোখে পানি এসে যায়, ফলে লেখক বরাবর ইমেইল করে লেখাটি সামুতে প্রকাশের অনুমতি চাই। তিনি বলেন সামুতে আমারও একটি একাউন্ট আছে তবে আমি নয়মিত নই, আপনি লেখাটি প্রকাশ করতে পারেন।


সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:২৮
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×