somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'দেশে বিদেশে' ; সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পড়লাম সৈয়দ মুজতবা আলী'র 'দেশে বিদেশে'।

বইয়ের নাম দেখে হয়তো অনেকে ধারণা করবেন- লেখকের নানা দেশ ভ্রমণের কাহিনি নিয়ে এই বই। অন্তত আমি তাই ধারণা করেছিলাম।

কিন্তু না, বরং তৎকালীন ভারতবর্ষ থেকে আফগানিস্তান পর্যন্তই এর ব্যাপ্তি। তবে দুই'শ সত্তর পৃষ্ঠার এই বইটি আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিবে বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে। স্বল্প পরিসরে তাদের ভাষা, আচরণ, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ সম্পর্কে ধারণা দিবে। বিস্তৃত পরিসরে রয়েছে আফগানিস্তানের কথা।

সৈয়দ মুজতবা আলী'র শান্তিনিকেতনে পড়ালেখার পর আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে ‘কাবুল কৃষি কলেজে’ ফারসি ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মূলত আফগানিস্তান থাকাকালীন তার জীবন অভিজ্ঞতা নিয়েই 'দেশে বিদেশে' বইটি। অবশ্য আফগানিস্তানেও নানা ভাষার নানা জাতির যে সম্মিলন দেখা গিয়েছে তাতে করে 'দেশে বিদেশে' নামটা যথার্থতা লাভ করেছে।

'দেশে বিদেশে' সৈয়দ মুজতবা আলী'র প্রথম বই। এবং অনেক সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টিতে এটি তাঁর লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ বই। সাপ্তাহিক 'দেশ' এ, ১৩ ই মার্চ ১৯৪৮ থেকে ১৮ ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ পর্যন্ত মোট আঠাশ কিস্তিতে- 'দেশে বিদেশে' সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। এবং তা অনেকটা ইতিহাস সৃষ্টি করার মত।

শ্রীযুক্ত কানাইলাল সরকারের সনির্বন্ধ অনুরোধে মুজতবা আলী 'নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড'কে বইটি প্রকাশের অনুমতি দেন। এবং অবশেষে এপ্রিল ১৯৪৯ সালে বই আকারে প্রকাশ হল 'দেশে- বিদেশে'। শুরু হল মুজতবা আলী'র বাংলাসাহিত্যে জয়যাত্রা।

এ বিষয়ে এখানে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যালের মন্তব্যটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তিনি বলেছিলেন-

"বাংলা সাহিত্যে খোশগল্প, মজলিসী এবং আড্ডা রসের একটি ধারা ছিল, কিন্তু খোশগল্প, আলী সাহেবের রচনায় শিল্পসুষমামণ্ডিত হয়ে দিল্ তর্ করা যে খুশবাই এনে দিয়েছিলেন- বাংলা সাহিত্যের কুতুব মিনার 'দেশে বিদেশে'র মাধ্যমে, তা ভগীরথের শিবের জটার থেকে গঙ্গা আনার মতই তুলনীয়। রসসাহিত্যের ধারা যখন ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে- ঠিক তখনই “দেশ” পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এই লেখাটির আবির্ভাব। সাহিত্যের শুকিয়ে ওঠা নদী, খাল, বিল, হাওর ভরে উঠলো রসসাহিত্যের মিষ্টি জলে। খাবি খাওয়া মাছের মত পাঠককুল আবার চোখ মেলে তাকিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেন – এই জলে।"

মরুময়, উষর, প্রানহীন আফগানিস্তানকে তিনি যে রসবোধের মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, তাতে যেকোন রসহীন পাঠকও তৃপ্ত লাভ করবেন। মনে হবে লেখক যেন মরুভূমিতে মধুর চাষ করেছেন।

"গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম যে ভাবনা আমার মনে উদয় হল সেটা অত্যন্ত কাপুরুষজনোচিত–মনে হল, আমি একা।"

সত্যি মানুষ খুব একা। বিশেষত যখন দেশ ত্যাগ করে, কিংবা বিদেশে অবস্থান করে তখন এ অনুভূতিটা অনেক শক্তভাবে জানান দেয়। লেখকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়। বইয়ের শুরুতে লেখক যখন হাওড়া স্টেশন থেকে পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রা শুরু করেন তখন আর সবার মতই তাঁরও মন স্বদেশের ভাবনায় আদ্র হয়ে ওঠেছিল। ভীষণ একা বোধ হচ্ছিল। ট্রেনের বাইরে তাঁকিয়ে তিনি খুঁজছিলেন চিরায়ত বাংলার কোন রূপ। হয়তো তিনি খুঁজছিলেন সুপারি গাছ কিংবা আম জামে ঘেরা ঠাসবুনুনির গ্রাম। সেরকম এক একাকীত্বের মুহূর্তেই লেখক উপরের উক্তিটি করেছিলেন।

দ্রুতবেগে ট্রেন চলছে। সাথে এগিয়ে চলছে মুজতবা আলীর দুলকি চালের বর্ণনা। তার কথার রসে কখনো উঠে এসেছে ভৌগলিক বর্ণনা, কখনো বা স্থানীয় মানুষের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, ইতিহাস। বিশেষত পাঠান জাতির কথা। একই সাথে তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠি যেমন আফ্রিদী, শিনওয়ারী, খুগিয়ানী এদের কথাও লেখক বেশ রসময় ভাবে উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। বলতে ভুলেন নি পাঠানরা গরীব জাতি হলেও মেহমানদারিতে তাদের কোনো কমতি নেই। গল্পগুজব করে সময় কাটানোতে এদের কোন আলসেমি নেই।

এরপর পেশওয়ার, খাইবারপাস হয়ে লেখকের যাত্রা চলতে থাকে আফগানিস্তানের কাবুলের দিকে। যাত্রাপথে নুড়িযুক্ত পথ, মরুভূমির মতো প্রান্তর, আফগান সীমান্তের শুরুতে এক দুর্গ, এক প্রাচীন সরাই, চমৎকার নিমলার বাগান কোন কিছুই লেখকের চোখ এড়ায়নি। আরবি-ফারসি যুক্ত সাবলীল হাস্যরসাত্মক ঢং ও নানা তথ্য দিয়ে তিনি কাবুল যাত্রা এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যাতে অচেনা কাবুল পাঠকের কাছে মোহনীয় দৃষ্টিতে ধরা দিতে বাধ্য হয়।

আফগানিস্তানের লিখিত ইতিহাস দুষ্প্রাপ্য বলে লেখক একে তুলনা করেছেন 'অরক্ষণীয়া মেয়ে' হিসেবে। এজন্য অবশ্য তিনি দায়ী করেছেন এর ভৌগলিক সীমান্তকে। এর ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে একই সাথে আরো কয়েকটি দেশের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। বিশেষত ভারতবর্ষ আর আফগানিস্তানের ইতিহাস এমনভাবে মিলেমিশে রয়েছে যে এই দুই দেশকে আলাদা করে দেখাকে লেখক কুসংস্কার হিসেবে মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও এর সাথে জড়িত রয়েছে তুর্কিস্তান, ইরান, রাশিয়া ইত্যাদি দেশসমূহ। সেজন্যই লেখক বলেছেন- "আফগানিস্তানের তুলনায় সুইটজারল্যাণ্ডের ইতিহাস লেখা ঢের সোজ। যদিও সেখানে তিনটে ভিন্ন জাত আর চারটে ভাষা নিয়ে কারবার।"

এরপর লেখক আফগানিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রা, শাসনব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা, ঋতু, ইতিহাস নিয়ে নানা তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বইটি।

তখন আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন আমান উল্লাহ। তিনি ছিলেন ইউরোপ ঘেঁষা ও প্রগতিপন্থি। ইউরোপের ভালো দিকগুলো তিনি নিজ দেশে প্রয়োগের চেষ্টা করতেন। যদিও কিছু উদ্ভট নীতিও জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে মোল্লারা তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিল। তাঁকে কাফির বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। দূর্বল অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোল্লাদের বেশ বড় একটা প্রভাব ছিল। মোল্লারা জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল, বিশেষত উপজাতি গোষ্ঠীগুলোকে।

এরকমই অস্থিতিশীল অবস্থায় এক কুখ্যাত ডাকাত সর্দার বাচ্চায়ে সকাও কাবুল শহর দখল করতে এলো। গোলাগুলি, লুটতরাজ, অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হল। আফগানিস্তানের এরকম চরম সংকটপূর্ণ সময়ে এসে শাসক আমান উল্লা সিংহাসন ত্যাগ করে পালালেন। শাসনভার দিয়ে গেলেন বড় ভাই ইনায়েত উল্লার হাতে। কিছুদিন পর ডাকাত সর্দারের আক্রমণে ইনায়েত উল্লাও আফগানমুলুক ছেড়ে পালালেন। সিংহাসনের দখল এলো ডাকাতদের হাতে।

এসময়ে ব্রিটিশ রাজদূত বিদেশিদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু বৈষম্যের শিকার হল ভারতীয়রা। অথচ যে বিমানে তারা দেশত্যাগ করছিলেন, সেগুলোও ভারতীয় করের টাকায় কেনা, এমনকি পাইলটরাও ভারতীয় অর্থের বেতনভোগ করে। যদিও শেষ পর্যন্ত মুজতবা আলীর দেশে ফেরার ব্যবস্থা হল।

কিন্তু অনেকদিন থেকে সে দেশটার প্রতিও তাঁর একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল। বিদায় অংশে পাঠকের মনে সবচেয়ে বড় দাঁগ কাটবে, পাঠকের হৃদয় আদ্র করে তুলবে আফগানিস্তান থাকাকালীন লেখকের চাকর আব্দুর রহমান। পুরো আফগানিস্তানের মধ্যে লেখকের সবচেয়ে কাছের লোক ছিল এই আবদুর রহমান। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে এই মানুষটি তাঁকে কখনো ছেড়ে যায় নি। বরং তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে লেখকের সেবা করে গিয়েছেন। এমনকি যখন লেখক ভারতবর্ষে চলে আসছিল আবদুর রহমান কান্নাকাটি করে লেখকের সাথে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিল।

আব্দুর রহমানের এই আকুলতায় লেখকের হৃদয়ও আদ্র হয়ে ওঠেছিল। সেজন্যই বোধ করি লেখক বলেছেন- "চর্তুদিকের বরফের চেয়েও শুভ্রতর অবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম অবদুর রহমানের হৃদয়।"

লেখকের সাথে এই অচেনা দেশ ঘুরতে চাইলে পড়তে পারেন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম সার্থক এই ভ্রমণকাহিনি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড্রাকুলা

লিখেছেন সুদীপ কুমার, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১২

কোন একদিন তাদের মুখোশ খুলে যায়
বেরিয়ে আসে দানবীয় কপোট মুখায়ব।

অতীতে তারা ছিল আমাদের স্বপ্ন পুরুষ
তাদের দেশ ছিল স্বপ্নের দেশ।
তাদেরকে দেখলেই আমরা ভক্তিতে নুয়ে পড়তাম
ঠিক যেন তাদের চাকর,
অবশ্য আমাদের মেরুদন্ড তখনও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×