প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য কিছু দিন আগে রোবেন দ্বীপে যাই। মাদিবাকে যে ছোট্ট কারাকক্ষে বন্দী রাখা হয়েছিল, সেখানে কয়েক ঘণ্টা কাটাই। যেখানে মাদিবা ২৭ বছরের কারাভোগের মধ্যে ১৭ বছর কাটিয়েছিলেন। সেই ছোট্ট কক্ষে আমি একা। বিছানার ওপর বসি। এরপর উঠে দাঁড়াই। পাষাণ কারার ছোট্ট জানালা দিয়ে এক চিলতে দৃশ্য চোখে পড়ে। খুবই ছোট্ট ওই কক্ষে, আমি একদম একা। প্রথমে, এক ধরনের ভোত অনুভূতি কাজ করে। পরে টের পাই, একঘেয়ে লাগছে।
আমার কিচ্ছু করার নেই। কোথাও যাওয়ার নেই। ঘিরে ধরছে, একঘেয়েমি। এর হাত থেকে নিস্তার নেই। আরও কিছুক্ষণ পর, কারাকক্ষের বাইরের বিষয়ে মনযোগী হয়ে উঠি। টেরপাই, শোঁ শোঁ করে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বিকট শব্দে। প্রায় প্রতিদিন এমন গড়গড় শব্দ শুনতে হবে। আর তা চলবে টানা সতের বছর। এই ভেবে আমার অন্তর আÍা কেঁপে ওঠে। আর কোনো কিছুর নয়, শুধু বাতাস চলাচলের শব্দ শুনে যেতে হবে। দেবতা কিংবা কোনো মানুষ আশ-পাশে নেই যে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। এ এমন এক দশা, যখন নিজের মুখ নিজেকেই দেখতে হয়। ক্রমে হতাশা আপনাকে পেয়ে বসবে।
আমি ভাবি, পিকনিক করতে কয়েক ঘণ্টার জন্য এই কক্ষে আসিনি। এখানে থাকতে হবে সতেরটি বছর। নিঃসঙ্গ আর একঘেয়ে জীবন আমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করবে। আক্ষরিক অর্থেই আমাকে শেষ করে দেবে। এ এক নির্মম অভিজ্ঞা। যেকোনো মানুষ নিরাশায় ডুবে যাবে। কিংবা প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠবে তার।
এই প্রতিকূল পরিবেশেও ইতিবাচক চিন্তার জš§ হয়েছিল: আর তা হলো দক্ষিণ আফ্রিকার ঐক্য সাধন।
নেলসন ম্যান্ডেলা যদি ওই ছোট্ট নির্জন কারাকক্ষে বছরের পর বছর না কাটাতেন, তাহলে হয়তো আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তা চিরতরে লোপ পেত। প্রতিকূল বাতাসের মধ্যেও আমাদের আশার প্রদীপ শিখাটি টিকে থাকত না।
ওই ছোট্ট কক্ষে মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা কাটানোর পর টের পাই, আমি দক্ষিণ আফ্রিকার একজন। সামান্য অভিজ্ঞা আমার মনে এনে দেয় অদম্য সাহস। ভাগ্য আমাদের যেখানেই ছুড়ে ফেলুক না কেন, শেষমেশ জয় আমাদের হবেই। মাদিবা জয় করেছিলেন। আমরাও পারব।
আমার এখন মনে হয়, বুঝে গেছি, মাদিবা কোথা থেকে সহযোগিতা পেয়েছিলেন। সত্য জেনে গেছি।
নির্জন কারাকক্ষের ওই ছোট্ট জানালা দিয়ে যদি কিছু বাইরে একটুকরো অংশ নাও দেখা যেত, তাহলেও তিনি অন্য কিছু দেখতে পেতেন। যা কোনো দিন শাসকগোষ্ঠীর চোখে পড়ত না। আর তা হলো, নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন। বাতাসের গর্জন মাদিবার মনে হতাশা জাগাতে পারেনি। বরং তাঁকে আশাবাদী করেছে। অন্যরা পেয়েছেন বন্দীদশার গন্ধ। আর মাদিবা আস্বাদন করেছেন সাগরের স্বাদ। ওই বাতাস তাঁর কাছে বয়ে এনেছিল পরিবর্তনের বার্তা। তিনি টের পেয়েছিলেন, এ বাতাসই একদিন বর্ণবৈষম্য, ঘৃণা ও দোষারোপের জাল ছিঁড়ে ফেলবে।
পূর্বসংস্কার ও বিরক্তিকর ছোট্ট কক্ষ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। প্রবেশ করতে পারি বিশাল এক কক্ষে। যা কিনা এ দেশের মতো বড়। যেখানে রয়েছে অবারিত স্থান ও আশ্চর্য সব সুযোগ-সুবিধা।
আমি বিশ্বাস করি, মাদিবার মতো আমরাও অতীতের শিকল ছিড়তে পারি। হ্যাঁ, আমরাই পারব, নিজেদের মুক্ত করতে। মাদিবার দোহাই।
কুস কোবুইস, দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক, সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। প্রতিষ্ঠানবিরোধী সুরস্রষ্টা হিসেবে খ্যাতিমান।