বলা নাই কওয়া নাই, কাবুলি পোশাক পরে সে হাজির। বলে, কালাম ভাইছা দোয়া রাখুইনযে। রেজাকার বাহিনীত নাম দিছি।কাফির কতলের দিন শুরু অইয়া গেছে।মালাউনরার আর রক্ষা নাই।
কীরে আজিজ, এইতা কিতা কছ তুই? তর কি মাথা খারাপ অইছে?
না ভাইছা, মাথা আমার ঠিকই আছে। আল্লাহর রাস্তায় নাইম্যা গেছি।যারা বাধা দিব, তারাই কাফির। আর কাফিররা ভাই কী বাপ, যেই হোক, ছাড়াছাড়ি নাই।সোজা জবেহ।
ওর কথা শুনে, আমার তো পিলা টাইট। আর বাড়াই না।ওর মুখ কেমন কঠিন।চোখ কক্ষুয়ার চোখের মতো লাল।বেতাল অবস্থা।
আমার এই প্রতিবেশি ভাইটির পুরো নাম আজিজুর রমহান খাঁন।চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক। আমার দশ-বারো বছরের ছোট। দেখতেশুনতে, পাঞ্জাবিদের মতো উঁচা লম্বা। হাসিখুশি, মিশুক টাইপের মানুষ। কোনো রকমে মেট্রিক পাস করেছিল। এরপর সারা গ্রামে টু টু করে ঘুরে বেড়াত।তবে ময়মুরুব্বিদের মান্য করে আর ছোটদের স্নেহ।আমার সামনে পড়লে মাথা নিচু করে রাখত। হাতে বিড়িটিড়ি থাকলে তো আর কথাই নাই।যেন পারলে শরমে মাটিতে মিশে যেত। এক দিন উত্তর পাড়ায়, পথে ওর সাথে দেখা। উদাম গা, পরনের লুঙ্গি হাঁটুর কাছে উল্টা করে বান্ধা।আচমকা পড়ে গেছে আমার সামনে। এখন সে কী করে? লুঙ্গি ছাড়ে, না হাতের বিড়ি লুকায়। ওর কায়কারবার দেখে আমার হাসি পায়। মুখ চেপে, না-দেখার ভান করে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাই।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আজিজ বিয়ের পর আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, ভাইছা দোয়া করুইনযে।লাল টুকটুকে শাড়ি পরা লম্বা ঘোমটা টানা বালিকাবউটিও হাত বাড়ায়।
আল্লাহ যেন তোমাদের সুখে শান্তিতে রাখেন।কায়মনোবাক্যে এই দোয়াই করি।ওর মুখে তখন কেমন মিষ্টি লাজুক হাসি ফুটে ওঠে।এখনো আমার চোখে লেগে আছে।
আমাদের গ্রাম উত্তর-দক্ষিণে টানা। উত্তরের মাথা পুবে মোচড় দিয়ে অন্য একটা গ্রামের সঙ্গে মিশেছে।দক্ষিণের মাথাও মিশেছে অন্য আরেকটা গ্রামের সঙ্গে। প্রত্যেকটি বাড়ির পেছনে ঘনজঙ্গল। গ্রামের সামনে একটা কাঁচা রাস্তা। এরপর ফসলের মাঠ। দূরে দুটি জোড়া বিল।গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি।ডিপকলও নাই।অঘ্রাণের ফসল তোলার পর থেকে খেতগুলো পড়ে রয়েছে।শুকনা খটখটে। কয়েকটা খেতে নাইল্যার গুডা ফেলানো হয়েছে। মেঘ নামলে, জলে ভরভুরা হবে মাটি। তখন খেতে রোয়া লাগানো হবে।গ্রামের মানুষের আপাতত কোনো কাজ নাই।
আমাদের উত্তর পাড়ায় মাত্র কয়েক ঘর হিন্দু।একটা বাড়িতে প্রতিবছর দুর্গা পূজা হয়।হিন্দু-মুসলিম সবাই পূজা দেখতে যেত। রাতে যাত্রাপালা হতো। সেখানে কোনো কোনো যাত্রাপালায় আজিজকে দেখা যেত, নায়কের পাট করছে।এ ছাড়া পৌষা সংক্রান্তির আগের সারা রাত হিন্দু বাড়িগুলোতে বাহারি পিঠা বানানো হতো। সকাল থেকে শুরু হতো অতিথিরূপী নারায়ণদের সেবা। শ্রাবণীবত্তের দিন পাঁঠাবলি দেখতে ছেলে-বুড়ো অনেকেই যেত। দুই ঈদে হিন্দবাড়ির লোকজনও মুসলিমদের বাড়িতে দাওয়াত রাখত।
সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলে এক দিন শুনি, আজিজ উধাও।এরপর ওই কাবুলির বেশে তার ফিরে আসা। নতানি বউ তার পায়ে ধরে মিনতি করেছে কত।পায়ে প্যাঁচিয়ে থাকা ঢোঁড়াসাপকে যেভাবে এক ঝটনায় দূরে ছুড়ে ফেলা হয়, বধূটিকে সেই রকম সরিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আজিজ। দক্ষিণে পা বাড়ায়।
কয়েকদিন পর, এক দুপুরে আমাদের গ্রামে একদল রাজাকার হানা দেয়। সারা গ্রাম ভয়ে অস্থির।বাড়ির পেছনের জঙ্গলে, ঘরের ভেতর ডুলি, উগারতল, যার যেখানে লুকানোর কথা মাথায় আসে, লুকিয়ে পড়ে।যেন সবাই ছোটবেলায় ফিরে গেছে। পলামুঞ্জি খেলছে। দত্ত বাড়ির শেয়ান দুটি মেয়ে আর পোয়াতি বউটি আশ্রয় নেয় মাইঝ পাড়ার জজ মিয়ার বাড়িতে।ভয়ে আতঙ্কে বধূটি, সেদিন একটা ছেলেশিশুর জন্ম দেয়।
আমি বাইরাগের ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখি, মাত্র সাত/আটজন রাজাকারের একটা দল। আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরের পাড় বেয়ে পুবে কালী দত্তদের বাড়ির দিকে যায়। দলের একজনকে আমি চিনি। তার গায়ের রঙ পাতিলের তলার মতো কালো।টিঙটিঙে চেহারা। পিঙ্গলা চোখ । আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে, রেলস্টেশন এলাকায় চায়ের দোকানগুলোতে তাকে প্রায়ই দেখা যায়।লোকটার দাবা খেলার খুব শখ। টিঙটিঙের কান্ধে একটা বন্দুক।সে এই দলের সর্দার!
দত্তদের বাড়ি তখন খা খা করছে। রাজাকারেরা সোনাদানা, কাসার থালাবাসনসহ সামনে যা পায়, আর নিতে মন চায়, ইচ্ছে মতো লুট করে, বস্তায় ভরে। বস্তা মাথায় তোলে। যাওয়ার পথে গোয়াইল ঘরের সামনে চাড়ি খেতে থাকা বড় বড় দুইটা দামড়ার দড়ি টানতে টানতে নিয়ে যায়।
রাজাকারেরা চলে যাওয়ার পর গ্রামের বাসিন্দারা একে একে বেরিয়ে আসে।প্রথমে কে কোথায় কেমনে কাঁপতে কাঁপতে পলায়, এ নিয়ে নিজেরাই বর্ণনা দেয়, হেসে গড়াগড়ি খায়।
আমাদের গ্রামে একজন নামকরা কুস্তিগির আছে। বলবান যুবক, আর পরিশ্রমী পুরুষ মানুষের সংখ্যাও কম না, শতাধিক তো হবেই।তা সত্ত্বেও গ্রামেরই একটা বাড়িতে রাজাকারেরা লুটপাট করল। কেউ বাধা দিল না।বরং আড়ঙ্গে নাড়াই লাগার আগেই কিছু ষাঁড় যেমন লেজ উঁচু করে দৌড় দেয়, এভাবে সবাই পালাল।গ্রামটার ইজ্জত থাকল কই! সেই দিনই সাব্যস্ত হয়, যা থাকে কপালে, আর কোনো দিন গ্রামে রাজাকার ঢুকতে দেওয়া হবে না।যে গ্রাম হাওয়া-বাতাস দিয়ে মায়ের মতো আমাদের বড় করেছে, তার ইজ্জত আর লুটতে দেওয়া হবে না। কিন্তু অস্ত্র কোথায়? সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে পাঁঠাবলি দেওয়ার একটা বলছিরা, দুই ঈদে জবাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয় এমন কয়েকটা ছুরি পাওয়া যায়। কয়েকটা সুপারিগাছের গুড়ি কাটা হয়।সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বায় কেটে, ফালি ফালি করে কেটে এক প্রান্ত সুইয়ের মতো চোখা করা হয়।এর নাম অলঙ্গা।এর বাইরে, প্রত্যেকের বাড়িতে মাছ-তরকারি কাটার দা হাতের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
সন্ধ্যার আগে আগে ধুলধুলিয়ার সময় খুড়ে ধূলি উড়িয়ে মাঠ থেকে গরুগুলো গোহালে ফেরে। খড়ের গোহালঘরে মশা তাড়ানোর জন্য ধোঁয়া দেওয়া হয়। ঘরের টুই বেয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি বেরিয়ে আসে।তখন হাঁস-মুরগিগুলো খোয়ারে ঢুকতে থাকে। আমাদের লাল মোরগটা শিয়াইল্যা রঙের নতানি মুগরিকে কব্জা করে।দিনের শেষ বাউ দেয়। ছাড়া পেয়ে মুরগিটা পাখনা ঝাপটা দেয়। এরপর খোয়ারের ভেতরে চলে যায়।
দক্ষিণ পাড়ার মসজিদে টিনের চোঙায় মুখ রেখে মৌজালি মোয়াজ্জিন আজান দেন। আর হিন্দু বাড়িগুলো থেকে উলুধ্বনি ভেসে আসে। আজান ও ধ্বনির ঠোকাঠুকি হয়নি তো কোনো দিন।পশ্চিমের আসমান রক্ত বরণ ধারণ করে। ধীরে এই লালিমা মুছে যায়। আঁধার ঘনায়। ঘরে ঘরে কুপি জ্বলে।
রাত নিঝঝুম। তখন বিলপাড় থেকে কে যেন টর্চ মারে। আমাদের গ্রামের কারও টর্চ নাই। ঘর থেকে ও ঘরে খবর পৌঁছে যায়। আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে গ্রাম।নিজ নিজ অস্ত্র হাতে বাহিনী প্রস্ত্তত। কথা এই, একটা চিৎকার শোনামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বে সবাই।
অন্ধকার রাত। চারদিক শুনশান।আসমানে অজস্র তারা ফুটেছে।পায়ের নিচে শুয়ে আছে মাটির রাস্তা। অন্ধকারে, এই মাটির পথ ধরে, নিঃশব্দে চলাচল করতে, আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না।এ মাটির প্রতিটি কণা সেই ছেলেবেলা থেকে আমাদের চেনা।তা ছাড়া, আমাদের চোখের জ্যোতি ভালো।তারার আলোয় চলাফেরার অভ্যাস হয়ে গেছে।আমাদের অলঙ্গা বাহিনী একবার দক্ষিণে যায়, আবার উত্তরে আসে।হাতে হাতে বিড়ির আগুন, জোনাকির মতো
বাড়ির পেছনের জঙ্গলের দিকে কোথাও একটা শেয়াল হুক্কা হুয়া করে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে তিন চারটা কোরাস গায়।মুহূর্তের মধ্যে বিলপাড়, এরপর অন্যগ্রামগুলো থেকেও হুক্কা হুয়া শোনা যায়। এরপর আবার স্তব্ধতা।মাঝরাতে আধখানি চাঁদ ওঠে আকাশে। হঠাৎ দূরে কোথাও, বিকট শব্দ হয়।এক শ বাজ এক সাথে পড়লে যেমন শব্দ হওয়ার কথা, এমন। আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই।
আমার বুক ধরফর করে। গলা শুকিয়ে আসে। পানি খেতে পারলে হতো। তবু সবার সঙ্গে থাকি। আবার শেয়ালে হাঁক। প্রহর ঘোষণা করে। এরপর আমাদের এক গ্রাম পরের আমতলা গ্রামে হঠাৎ আগুন দেখা যায়। এরপর শব্দ করে কয়েকজন কথা বলে।আমতলার সালুক (সাহা) বাড়িগুলোতে অাগুন দিছে মনে অয়।গ্রামে সাধারণত, কারও বাড়িতে আগুন লাগলে হই হল্লা শুরু হয়। আশ-পাশের দশ গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে যায়। পুকুর থেকে পানি এনে, কলাগাছ কেটে আগুনে ছুড়ে মারে, নেভায়। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম ঘটে। আগুন লাগছে…বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বন্ধ কোনাকুটি কেউ দৌড়ায় না। সময় খুব খারাপ। রাজাকারেরা যে কোনো সময় আমাদের গ্রামেও হানা দিতে পারে। কার কপালে মরণ আছে জানা নাই। ভয়, আতঙ্ক আর ক্ষোভ নিয়ে, গ্রামের এ মাথা ওমাথা করি।আমতলার দিক থেকে কয়েকটা গুলির শব্দ কানে আসে।এরপর সব চুপচাপ।কয়েক মিনিট পার।আবার গুলির শব্দ।আবার সব নীরব।
এক সময় ভোরের আজান ধনি শোনা যায়।মোরগ বাগ দেয়। পুব দিক ভর্সা হয়। পাখিদের ঘুম ভাঙে।কিচির মিচির করে।নিসর্গের মুখে আরও একটি সকাল হয়।হিন্দু পরিবারগুলো বাসিমুখে বাড়িঘর ফেলে গ্রাম ছাড়ে।শুধু দত্তবাড়ির সদস্যরা থেকে যায়।
আরও পরে খবর আসে, একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে ঠাকুরাকোনা রেলব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে।আর একদল রাজাকার আমতলার সালুক বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শেষে ফেরার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে পড়ে।আর তখনই পটাপট গুলি। আমতলা থেকে বুড়িঝুড়ি যাওয়ার পথের পাশে চিত হয়ে পড়ে আছে আইজ্যা রেজাকারের লাশ।
আজিজদের বাড়ির উঠুনে অনেক মানুষ জড়ো হয়। ওর লাশ হবে এ নিয়ে পাড়াপাড়ি হয়। ওর পবিবারের সদস্যরা বিব্রত। না পরছে কিইতে, না পারছে বইতে। ছেলেছোকড়ারা বলে দিয়েছে, ওই লাশ আনা যাবে না। কোনো রেজাকারের লাশ এই গ্রামের মাটি গছবে না। লাশ ওইখানেই পড়ে থাকবে, পচবে, গলবে, শিয়াল-কুকুরে খুবলে খাবে।
অন্দর থেকে বধূটির কিচন সুরে বিলাপ শোনা যায়। প্রতিবেশী মহিলারা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কাইন্দ না বউ। আল্লা আল্লা কর। আর কী করবা। সবই নসিব রে মা। এর পর কাচারমা নামের এক দাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, আইজ্যা তো মরছে না, বউডারে মাইরে থইয়্যা গেছে। বউয়ের পেডে রেজাকারটা বাচ্চা রাইখ্যা গেছে।