somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবেকের কষাঘাতে

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জীবনের পথটা কেন যেন হারিয়েই ফেলেছিল জিতু ছোটকালে । বাবা মারা যায় তার বয়স যখন মাত্র ১২ । ছোট দুই এবং বড় এক ভাই ওর । চারজন ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাগা মা তার অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ে । বাবার রেখে যাওয়া কিছুই ছিলনা প্রায় তাদের । সেলাইয়ের কিছুটা কাজ জানা মা কাজের পরিসরটা কিছুটা বাড়ান আর বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, টিউশনি করে যা পায়, তাই দিয়ে অতি কষ্টে দিনযাপন করতে হত তাদের ।
অভাব ভাল লাগতোনা জিতুর । বাবা বেঁচে থাকতে খুবই আদর করতো তাকে । ‘তিনভাই চম্পা’ করে বলত তাকে । অফিস থেকে ফিরেই তাকে নিয়ে বসে থাকত সবসময় । জিতুও তাকে শোনাত সারাদিনের গল্প ।
বাবার মৃত্যুর পর জিতুর ডানপিটে স্বভাবটা যখন কিছুতেই বদলানো গেলনা, বরং দিনকে দিন তা বেড়েই চলল, দিশেহারা মা এবং বড়ভাই ওর, ওকে বিয়ে দিয়ে দিল ওর চেয়ে বেশ বড় এক পাত্রের সাথে । পাত্রটি থাকে শহরে, কিছুই করেনা, বাবার ক্লিনিক-ব্যাবসা আছে, কিছু ভাগ পায় ।
পাত্রটির নীতির কোন বালাই ছিলনা । অর্থ ও নারীপ্রীতিতেই মেতে থাকতো সে । জিতু কিছু বললে সে বলত, যাওনা, তুমিও মেতে ওঠো কাউকে নিয়ে । আমাকে জ্ঞান দিতে এসোনা, যাও । স্বামীর রক্ষিতা-ধরনের এক নার্সকে দেখে নার্সিংযে ভর্তি হয় ও এবং যথারীতি পাশও করে একসময় এবং একটি মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে চাকরীও হয়ে যায় তার ।
আরো উচ্ছৃংখল হয়ে ওঠে জিতু । নার্সিং কলেজে পড়াশুনার সময়ই তার পরিচয় হয় গাঁজার সাথে । স্বামীর রক্ষিতাদের প্ররোচনায় বহুগামিতার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতাও হয় তার । গাঁজার পর মদ, হেরোইন এবং এ-সংক্রান্ত এমন কোন নেশা নাই, যা সে করেনা । চাকরী হওয়ার পর নজর উঁচু হয়ে যায় তার । নাইট ডিউটিতে কিছু ডাক্তারেরও সংস্পর্শে আসে ও । দুর্নাম যখন ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন ঢাকায় বদলী হয়ে আসে ও এবং স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে পুরোপুরি মূক্ত হয়ে যায় ।
ডাক্তার হীরন ঢাকা মেডিক্যালে চাকরী করেন । পঁয়ত্রিশের উপর হয়ে গেছে বয়স । বিয়ে করেননি । সৌম্য, শান্ত স্বভাবের মানুষ তিনি, চিকিৎসাই বোঝেন শুধু বলেই আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় । ডিউটির সময় শুধু রুগী-ঔষধ, এসবের বাইরে কোনদিকে চোখ থাকেনা তার । কোনদিন কোন নার্সের দিকে চোখ তুলে তাকাননা তিনি । শুধু ঔষধপত্র সম্পর্কে, রূগীর যত্ন-আত্মি সম্পর্কে খোঁজ-খবরের সময় কচিৎ যদি চোখ পড়ে না যায় ।
জিতুর সম্পর্কে হীরন শোনেননি বা তাকে যে তিনি সতর্কভাবে নীরিক্ষা করেননি, তা নয় । কিন্তু তিনি জিতুর মধ্যে একটা অদ্ভুত সরলতা লক্ষ্য করেন অবাক হয়ে, যা তার চরিত্রের সাথে যেন মিলেনা । অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন, জিতুর সেবা করার মানসিকতা এবং দক্ষতা অন্যদের থেকে বেশ উন্নত, যেখানে কোন ফাঁকি পরিলক্ষিত হয়না তাঁর কাছে । নীরবে ক্ষত পরিষ্কার করে যায় সে, ইঞ্জেকশনের সুচ ফোটানো, ক্যানোলা করা অথবা স্যালাইন সেট করা, রুগীকে ঔষধ খাওয়ানোর সময়জ্ঞান, প্রভৃতি নার্সীয় কাজগুলোতে ও কোন ফাঁকি দেয়না ।
অবশেষে আসে সেই রাত, যেরাতের বদৌলতে পুরোপুরি বদলে যায় জিতু । সুনামের আধার ডাক্তার হীরনের উপরও চোখ ছিল জিতুর । সেদিন ছিল ওদের নাইট ডিউটি, বৃষ্টির রাত ছিল ওটা । জিতু ভেবেছিল, সহজ না হলেও খুব কঠিন হবেনা হীরনকে পেতে, কারন পুরুষ তার কম চেনাতো আর হয়নি ।
কত হবে রাত, তখন! দেড়টা অথবা দুইটা, জীবনের পঁচিশটা বছর আগের ফেলে আসা সেই রাতের কথা ভেবে আজও শিউরে উঠে জিতু । হাতঘড়িটা দেখে নেয় ও, জেলে হীরনকে দেখতে যাওয়ার এখনও সময় আছে আরো দুঘন্টা, যেখানে আজ আবার দেখা হবে তার জীবন পরিবর্তন- করে-দেওয়া অতি প্রানের হীরনের সাথে ।
গত সাত বছর ধরে জেলে রয়েছেন ডাক্তার হীরন উগ্র মার্ক্সবাদী রাজনীতি করার কারনে । কোথাও একটি খুন হয় বছর দশেক আগে, তারও বছর পাঁচেক আগে থেকে ভারতের নকশালবাড়ীর ঢেউয়ে কাঁপছিল এদেশ এবং হীরন যেহেতু নেতা, তাই ফেঁসে যান তিনি । অথচ নক্সালপন্থার উপর তাঁর আবেগী সমর্থন ছিল ঠিকই, কিন্তু এপন্থার শ্রেনীশত্রু খতমের তত্ত্ব তিনি সঠিক মনে করতেননা । কারন তিনি মনে করতেন, এক শ্রেনীশত্রুর জায়গায় আরেকজন শ্রেনীশত্রু আসবে । তাই খুন কোন সমাধান নয় । আর খুনের রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন এক রাজনীতি । এতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য পার্টি এবং বাস্তবে হয়েছেও তা-ই ।
পরিবর্তিত জিতু আবার ফিরে যান পঁচিশ বছর আগের সেই রাতে । গভীর সেই বৃষ্টির রাতে ওয়ার্ডে ডাক্তারদের জন্য নির্ধারিত কামরায় দেখেন জিতু, আধশোয়া হীরন কি যেন একটা বই পড়ছে ।
কি করেন ? প্রশ্ন জিতুর ।
বই পড়ছি, কিছু বলবে ?
জিতু ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করে যান হীরনকে পাবার । কিন্তু পেরে ওঠেননা । হীরন তার দিকে তাকানইনা ।
বলেন, দেখ জিতু, তোমার উদ্দেশ্য আমি বুঝি । তবে তুমি যা চাও আমি তা চাইনা ।
কেন, কেন আপনি তা চাননা ডাক্তার ! আমার কি নাই, যা আপনি চান ? আর এই নিস্তব্ধতায়, কেউ যখন নাই, কেন হবেনা ?
হীরন তাকে বেরিয়ে যেতে বলেন ।
আরো যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন জিতু, কি একটা বলতে যান ।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হীরন বলে ওঠেন, দেখ, দেশ-সমাজ সম্পর্কে তোমারতো কোন জ্ঞান আছে বলে আমি মনে করিনা, জান কেবল উচ্ছৃংখলতা । শোন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নীরব-নিথর গ্যাসচেম্বারে মৃত্যুপথযাত্রী ইহুদী দুই যুবক-যুবতী কোন ধ্যান-ধারনা থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তেও এই অবৈধকাজ সম্পন্ন করেনি জান ? তারা মনে করত যে, ক্ষেতের বাইরে যে বীজ ছিটকে পড়ে, তা থেকে ভাল কোন শস্য জন্মেনা । তাই তারা ক্ষেতের বাইরে ছিটকে পড়া বীজ হতে চাননি । প্রতিকী ঐ সংলাপের মধ্য দিয়ে আসলে তারা বিবেকের কাছে সবসময় সৎ থাকতে চেয়েছেন, যুগ যুগ ধরে যাতে পৃথিবীতে সততার ধারা অব্যহত থাকে । প্রজন্মান্তরে তারা সততার এই বীজই রোপন করে যেতে চেয়েছেন ।
একটু থেমে আবার বলেন হীরন, মূহুর্তের লোভের কাছে আমি কখনও পরাজিত হবোনা, বেরিয়ে যাও এখান থাকে, এখনই । শেষের কথাটা চিৎকার করে বলেন তিনি ।
পোষাক সামলে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন, হীরনের । এমন কথাতো শোনেননি কোনদিন তিনি । একোন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আজ তিনি ? পায়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন জিতু অনেকক্ষন । অনুশোচনা আসে তার মধ্যে, প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মন তার ব্যকুল হয়ে উঠে তখন । কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলেননা কেমন করে তা করবেন । শেষে পা ধরে পড়ে রইলেন হীরনের ।
হীরনও বাধা দিলেননা, বুঝে গেছেন তিনি, কালিমা দূর করতে চান জিতু এবং কিছুক্ষন তা দিলেনও করতে ।
বেরিয়ে আসেন তিনি একসময় হীরনের রুম থেকে ।
এই পঁচিশটা বছর হীরনের সঙ্গে ঘর না করলে জিতু জানতেননা স্বাভাবিক ঘর-সংসারের বাইরেও অনেক ভাল একটা ক্ষেত্র আছে এই পৃথিবীতে। বখে যাওয়ার হাতছানি যেমন আছে সেখানে, তেমনি আছে বেরিয়ে আসার হাতছানিও । পৃথিবীতে বোধহয় মার্ক্সবাদেই রয়েছে এমন আবেগ, যাতে মানুষের আবেগী পরিশুদ্ধতা ঘটে । পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতপার্থক্য থাকলেও সারাবিশ্বে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ যত মানুষের মধ্যে উন্নত চিন্তা-চেতনার জন্ম দিয়েছে, অন্যকোন মতবাদ তা দেয়নি ।
নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছে তাঁকে আজ । ছটফট করে উঠেন তিনি । ছয়মাস পর আবার দেখতে পাবেন তিনি তার অতি প্রিয় পথপ্রদর্শক এবং আপনজন, হীরনকে । আইনের বেড়াজালে ছূঁতে হয়তো পারবেননা, কিন্তু দশ-পনেরোটা মিনিট তাকিয়ে তো থাকতে পারবেন তাঁর দিকে অতি নিবিষ্টে, অতি ভক্তিতে, তার নষ্ট জীবনটাকে একেবারে পরিশুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য । আগামী কিছুদিনের জন্য সেটিই যে হয়ে থাকবে তাঁর একান্ত পাথেয় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:১০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ফাঁদ (The Middle Class Trap): স্বপ্ন না বাস্তবতা?

লিখেছেন মি. বিকেল, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৪৫



বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত কারা? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কিছু রিসার্চ এবং বিআইডিএস (BIDS) এর দেওয়া তথ্য মতে, যে পরিবারের ৪ জন সদস্য আছে এবং তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×