মানুষটাকে দেখেছিলাম বছর বেশ কয়েক হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে আমার এক বান্ধবীর বাবার বন্ধু উনি। বান্ধবী ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে, সাথে তার বাবা। আর বাবার বন্ধু লোকটি এমনিই এসেছিল বন্ধুর সাথে দেখা করতে। শহীদ ওর নাম। বিকেলে আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় যাব, গেট পর্যন্ত এলেন ওরা এগিয়ে দিতে। আসলে বান্ধবীর বাবার রাজনৈতিক একটা মতাদর্শ আছে, যা আমাদের মত। সেই হিসেবের মিল থেকে আমাদের পরিচয় এবং টুকটাক ঘনিষ্টতা। গেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। শহীদ তখন আমাদের বলেন, তোমরা যে এখন একটা ছাত্র সংগঠন করছো, এটাঁ কী তোমরা তোমাদের ছাত্রজীবন শেষে কর্মজীবনে যেয়েও কন্টিনিউ করবে?
কোন দ্বিধা না করেই বলে ফেলি, অবশ্যই। আর নিজে রাজনীতি করি এবং উনি করেন না, চাকরী করেন বলে কিছুটা গর্বের সাথেই বলি, অবশ্যই করবো। বামঘেঁষা এক সংগঠনের ছাত্র শাখার এই ইউনিভার্সিটির আহ্বায়ক আমি।
মনে হয়েছিল, কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। কারন যাই হোক। হয়তো আমার এরকম সিদ্ধান্তের কথা শুনে অথবা একজন সুন্দর মেয়ে হয়েও আমি সাংসারিক জীবন পালন করবোনা এটা ভেবেও হতে পারে।
একটু থেমে শহীদ আবার বলেন, দেখো তোমাদের বাম সংগঠনগুলির আদর্শ সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র শ্রমিক শেণির রাজ কায়েম করার জন্য সচেষ্ট। কিন্তু দেশে আজ শুধু শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থই প্রধান বিষয় নয়। আরো একটা শ্রেণির স্বার্থ আজ একেবারে প্রধান হয়ে গেছে, আর সেটা হচ্ছে তরুন সমাজের। শ্রমিক শ্রেণির চেয়ে দেশে আজ এই তরুন সমাজের সংখ্যা বেশি। এদের কর্মসংস্থান অতি জরূরী একটি বিষয়, বলা যায় সবচাইতে। অথচ কী প্রক্রিয়ায় কর্মসংস্থান হচ্ছে তা সকলের জানা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমেই হয়ে আসছে অতি সীমিত। আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ, এবং শুধুই প্রতিবাদে মুখর হয়ে থাকতে হবে। ডান হাতে ঘুষি পাকিয়ে বাঁ হাতের তালুতে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে কথাটা বললেন শহীদ।
সাথের আমার সঙ্গীটাকে ওনার মোবাইল নম্বর নেয়ার জন্য বললাম তখনি।
সেই শুরু লোকটাকে জানা। চাকরী করা লোক এরকম প্রতিবাদী কেমন করে হয়, ভেবেছিলামও দিনকয়েক। আমার মূল পার্টির নেতাকেও বলেছিলাম কথাটা। কেন যেন মনে হয়েছিল এই লোকের দ্বারা অনেক কিছু হতে পারে। কথা বলার সময় কেমন যেন একটা ক্ষুব্ধতা দেখা গেছিল তার চোখ দু’টোতে।
শহীদের সাথে এরপরে আর দেখা হয়নি আমার অনেকদিন। পড়াশুনা আর ছাত্ররাজনীতির দোলাচলেই কাটছিল দিনগুলি। ভুলেই গিয়েছিলাম শহীদের কথা।
বছর দুই পর পত্রিকার একটা প্রতিবেদনে আটকে গেল আমার চোখ। প্রতিবেদন ঠিক নয়, আটকে গেল একটা ছবিতে। কারন তখন প্রতিবেদন পড়ার সময়ই পেতাম না বলতে গেলে পরীক্ষার কারনে। কার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে ছবিটা। চেনা চেনা লাগছে বলে স্মৃতির পাতা ক্ষনিক হাতড়িয়েও যখন বুঝতে পারলামনা, তখন প্রতিবেদনের কিছুটা পড়তে লাগলাম। শহীদ নামটা চোখে পড়তেই পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু।
শহীদ আটক হয়েছেন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রয়েছেন তিনি। কেন? বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। কোনটায় বলা হচ্ছে, তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার চেষ্টা করছিলেন। কেউ বলছেন, কয়েকজন কমবয়সী ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি শাহবাগে বসেছিলেন, হাতে ধরা ছিল ”আমরা আর কোনোদিন সরকার তথা কাউকে কোনো অন্যায় কাজ করতে দিবনা”, ”বড় মানুষেরা ভাল হয়ে যান, দেশটা ভাল হয়ে উঠুক”, ”সরকার ভাল হয়ে যান, আমাদের প্রতিবাদ করার কোন দরকার হবেনা”, ”সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে আসুন, অহিংস এই প্রতিবাদে শরীক হোন”, ”যেখানেই দু’শাসন দেখবেন, শুরু করে দিবেন অহিংস প্রতিবাদ”, ”প্রতিবাদে কোনরকম সহিংসতা করবেন না, সহিংসদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই”, ”কোনদিন ক্ষমতায় যাওয়ার কোন চেষ্টা করবনা আমরা, শুধু প্রতিবাদ করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবো” ইত্যাদি।
আটক হওয়ার আগে তিনি কিছু কথা বলে যান বলে প্রায় সব পত্রিকাই উল্লেখ করেছে- ’দেশের সকল তরুনের উদ্দেশ্যে বলে যেতে চাই, তোমরা জানো দেশ কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। দু’টো অপশনের মধ্যেই রয়েছে এসকল কিছুর সমাধান। এক-সরকারকে বদল হতে হবে, যার যা শাস্তি প্রাপ্য তা তাকে দিতে হবে, বিচারহীনতা থেকে সম্পূর্ন সরে আসতে হবে সরকারকে, রাষ্ট্রের সর্বত্র সর্বদা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেকোনোভাবে সরকারকেই; দুই-সরকারকে চাপের মাধ্যমে এসমস্ত কিছু করতে বাধ্য করতে হবে। আর কোন উপায় নাই এদেশ ভাল হওয়ার, আর কোন উপায় নাই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির পর্যায়ে আমাদের পৌঁছে যাওয়ার। অতএব দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসাবে এদেশকে ভাল করার দায়িত্ব কেবল তোমাদেরই এবং কোন অবস্থাতেই থামবেনা তোমরা, প্রতিবাদ কার্যক্রম চালিয়েই যাবে। দেখবে একাজে ক্রমশ:ই সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এসে জড়ো হবে এবং আস্তে আস্তে এভাবে এ-কার্যক্রমের ব্যাপ্তি বাড়বে। বাড়তে বাড়তেই এই অহিংস কার্যক্রম এমন একটা পর্যায়ে চলে যাবে যে, তখন শুধু প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা দেখেই সরকার বাধ্য হতে সকল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। কিছুই করা লাগবেনা আর এবং দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে উঠতে শুরু করবে।
আর হাঁ, তোমাদের মতো হলে এরকম একজন মানুষ এভাবে কেউ আহ্বান করলে আমি তা বিশ্বাস করতাম এবং এই মুহুর্ত থেকেই তাকে জেল ভেঙ্গে বের করার চেষ্টা করতাম। আশা করি তোমরাও তাই করবে। আমি কোন ভয় পাইনা। মৃত্যুর ভয় পেলে এই কাজ আমি করতামনা। আমাকে তোমরা যত তাড়াতাড়ি বের করবে, তোমরা সাথে থাকলে তত দ্রুত এদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়ে যাবে। আর আমার যেকোনভাবে মৃত্যু হলে শুধুমাত্র সেকারনে কোন প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ করবেনা, সহিংসতা তো নয়ই। এটা আমার আদেশ। কারন লড়াইয়ের সুদীর্ঘ এই পরিক্রমায় অনেক মৃত্যু হবে, অনেক ক্ষতি হবে। তাছাড়া সহজে এটা অর্জিত হবেনা। তাই কারো মৃত্যুর জন্য সময় নষ্ট না করে মৃত্যুগুলোকে ধারণ করে, মনে জাগরূক রেখে সুশাসনের জন্য অহিংসভাবে লড়াই চালিয়ে যাবে।’
তেজ আছে লোকটার। প্রতিবেদনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এই কথাটাই মনে হলো আমার সর্বাগ্রে। মোবাইলে রিনাকে আসতে বলে চলে গেলাম জেলখানায়।
সহজেই চিনে ফেলেন আমাকে শহীদ।
রাবিনা তুমি! এলাম আপনাকে দেখতে, রিনাকেও ফোন করেছি, ও-ও আসছে।
ভাল করেছ, তা কী মনে করে? সংগঠন কেমন চলছে তোমাদের?
বলি আমি, এত বড় কথা কেমন করে বলেন? এভাবে বললেই কী মনে করেন যে, মানুষ এগিয়ে আসবে?
আমি মনে করি রাবিনা, আসবে। কারন আমি মনে করি, দেখ এভাবে আমাদের মধ্যে কেউ কী কোনদিন মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে? তরুনদের কেউ কী কোনদিন বলেছে যে, এসো আমরা দেখি সরকারী নিয়োগে কী করে দুর্নীতি হয় আর। জেলা-উপজেলাসহ সব খানকার ঠিকাদারদের টেন্ডারবাজী রুখে দেওয়ার ডাক কী কেউ দিয়েছে এত প্রত্যক্ষভাবে? কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের এদেশে বিনিয়োগের রাস্তা মসৃনতার সাথে পরিষ্কার-ঝকঝকে করে দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার লড়াইয়ে এদেশের গ্রাম-গঞ্জে বসবাস করা শিক্ষিত বেকার তরুন-তরুনীরা আর কতদিন সক্রিয় না হয়ে থাকবে? এদেশে অনেক বিবেকবান মানুষ আছেন, যারা চান দেশটা সর্বোচ্চ ভাল চলুক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হোক জীবনের সব ক্ষেত্রে। মানবতাবাদী অনেক সংগঠনও আছে। কিন্তু মূলত: লোকবলের অপ্রতূলতার কারনে সেগুলি এককভাবে কার্যকর কোন ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারছেনা। এইসমস্ত বিবেকবান ব্যক্তি এবং সংগঠন সমূহকে এক হতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট কর্মকান্ড, প্রতিবাদ আয়োজনের মাধ্যমেই সেটা হবে। অতএব আমরা যদি প্রতিবাদ করা শুরু করি, তাহলেই হবে সবকিছ, মানুষও ভরসা পেয়ে এগিয়ে আসবে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে স্বপ্নের মতো মনে হলেও শুনে যাচ্ছিলাম। রিনা এলে হঠাৎ আমি বলে উঠি, চলি শহীদ ভাই। আপনার কথাই হয়ত ঠিক, আপনার কথা হজম করতে পারছিনা, আর একদিন আসব।
শহীদ ভাইেেয়র খোঁজ রাখি আমি। রাজনীতিবিদ অনেক দেখেছি আমার এই অল্প বয়সে। কিন্তু শহীদ ভাইয়ের মতো এত সাহসী আর তেজী রাজনীতিক আর দেখেছি বলে মনে হয়না।
মাস ছয়েক হয়ে যাওয়ার পরও যখন ওঁর মুক্তির বিষয়ে কিছু হয়না, আরেকদিন যাই কারাগারে ওনাকে দেখতে।
চেহারা কিছুটা ভেঙ্গে গেলেও বুদ্ধিদীপ্ত চাহনীটা ঠিকই ধরা আছে শহীদ ভাইয়ের। বলেন, তুমিএসেছো ভাল লাগছে রাবিনা।
কেন, আর কেউ আসেনা শহীদ ভাই, বলে ফেলি আমি।
খুব কম, কেন যেন মানুষ আসেনা। আসলে মানুষ বোধহয় রাবিনা, এসমস্তকিছু চায়না। অথবা মনে করে এরকম করে কিছু হবেনা।
চলমান রাজনীতি দেখতে দেখতে মানুষ হয়ত মনে করে, এসব করার পেছনে আমার অথবা কারো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে
আজকের রাজনীতিবিদদের মতো। আসলে মানুষের দোষও দেওয়া যায়না। কারন আমি এক অপরিচিত মানুষ, কোন ভরসায় তরুন
সমাজ এগিয়ে আসবে বলো। আমি কী এদেশের জন্য কিছু করেছি কোনোদিন?
এতই যদি বোঝেন, তবে পড়ে পড়ে জেল আর খাটছেন কেন ?
বলতে পারো এটা একরকম প্রায়শ্চিত্ত। চিরদিন করেছি চাকরী। কই, কোনোদিন তো আগে এসমস্ত কথা বলিনি। নির্ঝঞ্জাট জীবন
কাটিয়েছি। স্ত্রী, সন্তানদের কারনে রাজনীতি করিনি কোনোদিন, কারন তাতে আমার চাকরী চলে যেত। চাকরী চলে গেলে ওদের
নিয়ে পথে বসতে হতো আমাকে। কে চায় এটা করতে বলো।
তবে সেই প্রায়শ্চিত্ত করতেই এখন আপনার রাজনীতির মাঠে আসা, আর কিছু নয়?
তাই কী হয় রাবিনা, এই আদর্শের শুরুই হয় অতি শৈশবে আমার। আশপাশের গরীব মানুষগুলোর জীবনযাপন আমাকে ভাবাত
বেশ। ভাবতাম কেন এমন হয়, কেন কিছু মানুষ প্রাচুর্যের মাঝে আর অধিকাংশই বাস করে অতি কষ্ট করে বসবাস করে।
নকশালবাড়ী আন্দোলনের রমরমা তখন। ধনী-গরীবের সমতায়নের লড়াইয়ের সময় মাষ্টার্স করা ছাত্র-ছাত্রীদের সার্টিফিকেট ছিঁড়েৃ..........
(পাদটিকা: গল্পটি কোনদিকে নিয়ে যাব, বুঝতে পারছিনা; প্রিয় পাঠক, আপনারা বলবেন কী!)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৬ রাত ১২:৩৯