জানি না এখনকার পোলাপান দি এক্স ফাইল সিরিয়ালটার নাম শুনেছে কিনা। আমরা যখন ইউনিভার্সিটিকে পড়তাম তখন দি এক্স ফাইল সিরিয়ালটা বিটিভিতে চলতো। তখনতো আর শত শত চ্যানেল ছিল না তাই ওই এক বিটিভি ই ভরসা ছিল। আমরা হলে পাগলের মতো ওটা দেখতাম। শুক্রবার রাত সাড়ে দশটায় মনে হয়ে দেখাতো। যা বলছিলাম, দি এক্স ফাইল সিরিয়াল হলো প্যারানরমাল জগত নিয়ে গল্প। সেরকম একটা সিরিজে একবার দেখেছিলাম একটা অদ্ভুত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে শহরে। এ রোগে আক্রান্ত হলে সে হিংস্র হয়ে যায় আর খুন করে আপনজনকে। কিন্তু কোন সিমটম থাকে না শরীরে কিংবা বাইরে থেকেও বোঝা যায় না যে সে আক্রান্ত। এভাবে পুরো শহর নিস্তব্ধ হয়ে যায়, আতংক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কেউই কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, সবাই সবার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। কেউই জানে না কে সে রোগের শিকার।
এখন ঠিক যেন সেই এক্স ফাইল এর স্যুটিং চলছে সারা পৃথিবীতে। কেউই কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না! কে তার শরীরে এ জীবাণু বহন করছে সে নিজেই জানে না যতক্ষন না কোন সিমটম দেখা দিচ্ছে। এবং সিমটম ছাড়া বা সম্পূর্ণ সুস্থ্য শরীরেও এ জীবাণু বহন করা সম্ভব। এবং সে সুস্থ্য ব্যাক্তিটি অনায়েসে অন্য রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে সহজেই করোনা ট্রান্সমিট করতে পারে। যা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে সহজেই। সমস্ত পৃথিবী থমকে গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে এতো এতো বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে ও এরকম মহামারি আমাদের জীবনকে থমকে দিয়েছে।
গত ডিসেম্বরে Wuhan hospital এর ডক্টর Li Wenliang এর কাছে ৭ জন লোকাল সীফুড মার্কেটের শ্বাসকষ্ট জনিত রোগী আসে। যাদের সবার একই সিমটম ছিল। তাদের সিমটম দেখে উনিই সম্ভাব্য আউটব্রেক হতে পারে বলে ধারনা করেন। এরপর তাঁর মেডিকেল স্কুল এ্যালাইমনি গ্রুপে Chinese messaging app WeChat এর মাধ্যমে সবাইকে জানান। এবং এটি ব্যাপক আকারে শেয়ার হবার পর চাইনীজ সরকার লী কে আটক করে এবং মিথ্যা খবর ছাপানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাঁকে মুচলেকা দিয়ে খবরটি উইড্রো করতে বলে ও ভবিষ্যতের জন্য হুশিয়ার করে। তখন কেউই জানতো না এটি কিভাবে ছড়ায় বা এর প্রতিষেধক কি? তারপরের ইতিহাস সবারই জানা কিন্তু বাচঁতে পারেননি ডক্টর Li Wenliang। ২১ জানুয়ারীতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭ই ফেব্রুয়ারীতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।............ স্যালুট তোমাকে!
সমাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র যাই বলা হোক চাইনীজ সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এ খবর প্রথমেই বিশ্ববাসীকে জানতে দেয়নি। কিন্তু যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ও লোকজন মৃত্যুভয়ে পালাতে তখন থাকে চাইনীজ সরকার লকডাউন এর ঘোষনা দেয়। কিন্তু ততদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। যারা পালিয়ে Wuhan ছেড়েছে তারা রোগটি ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে। আজ যদি চাইনীজ সরকার প্রথমেই ডক্টর Li Wenliang এর কথা শুনে তাঁকে নিয়ন্ত্রন না করে রোগ নিয়ন্ত্রনে এগিয়ে আসতো তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।
ঠিক একইভাবে সে ভুল করে ইতালি। হয়তো চীন থেকে পালিয়ে আসা অনেক ইতালীয় চাইনীজরা সহজেই ছড়িয়ে দেয় পুরো ইতালীতে। যেহেতু চাইনীজ খবর খুব একটা বাইরে আসে না তাই ইতালি সম্পূর্নভাবে বিষয়টির গুড়ুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হয়। আর সে ভুলের মাশুল দিচ্ছে হাজার হাজার নাগরিক। এখন দেখতে পাই লাশ দাফনের গাড়ির মিছিল।
সেই একই ভুলও আমরা করেছি এবং করছি। কিন্তু কেন আমরা সে একই ভুল করেছি?? গত জানুয়ারীর আউটব্রেক আমরা মার্চে এসেও কেন গুড়ুত্ব দেইনি? হয়তো এর কারন হতে পারে ১৭ই মার্চে পূর্ব ঘোষিত মুজিব শত বার্ষিকী পালনে ঝামেলা হতে পারে এই ভেবে। কারন মুজিব শত বার্ষিকী পালনের মাধ্যমে নেতারা কে কত চামচামী করতে পারে তার প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করতে চায়নি (মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনে তাই মনে হচ্ছে)। আবার হতে পারে যাদের এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় তারা হয়তো জিপিএ ফাইভের ছাত্র-ছাত্রী (কারন তারা এর গুড়ুত্ব অনুধাবন করতেই ব্যার্থ হয়)। কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই খারাপ নিউজটা দিয়ে কেউই নিজের মাথাটা গিলোটিনে আনতে চায়নি।
আমি আশ্চর্য্য হই এই ভেবে যে একটি দেশের ক্ষমতার চেয়ারে বসা একটি লোকও কি জানে না এ রোগের টেস্ট করার জন্য কিছু কিট লাগে, যারা সেবা দিবে তাদের নিজেদের প্রটেকশান লাগে, যেহেতু শ্বাসকষ্টজনিত রোগ তাই তারজন্য অক্সিজেন লাগে, সবার মাক্স লাগে, গ্লাভস্ লাগে...................। হায়রে দেশ!!!
এমন কি আমরা এতোটাই গরীব যে ২৫০০ টাকার ডাক্তার/নার্সদের জন্য বিশেষ পোষাক কেনার ও সামর্থ্য রাখি না। এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদেরকে নাকি নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিজেদের ড্রেস কেনার জন্য। এখন একজন ডাক্তার/নার্স নিজকে বাচাঁনোর জন্য পিপিই কিনতে বাধ্য হচ্ছে। তারা সেবা ও করবে, নিজেদেরকে ঝুঁকিতেও ফেলবে আবার নিজের টাকায় পিপিই ও কিনবে............. হায় সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ!
তবে যাই হোক, আমরা এখন বিপদ মাথায় নিয়ে আছি। এ বিপদ থেকে কিভাবে পরিত্রান পাবো তার পথ আমাদেরকে ভাবতে হবে। আমার আগের লিখায় কানাডার উদাহরন টেনে ছিলাম। আবারো বলি, প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো শুধু একা নয় তার সাথে এগিয়ে এসেছে বিরোধী দল ও ব্যবসায়ীরা। মদ নয় তৈরী হচ্ছে হ্যান্ডস্যানিটাইজার, অন্য পণ্য নয় তৈরী হচ্ছে হ্যান্ডস গ্লাভস্ , পিপিই.................। এ পথ ধরে আমরা কি কিছু করতে পারি না!
- আমরা কি কাজে লাগাতে পারি না আমাদের গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরীগুলোকে বা অন্যান্য ফ্যাক্টরীগুলোকে? দ্রুত তৈরী করতে পারি দেশীয় উপায়ে পিপিই কিংবা গ্লাভস্ ?
- একটা ফান্ড কি তৈরী করতে পারি না গরীব অসহায় মানুষগুলোর জন্য যাদের কাজ নেইতো ঘরে খাবার নেই?
- রেশন বা এ ধরনের সাহায্য কি চালু করতে পারি না?
- সকল ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক ব্যাক্তিরা কি কন্ট্রিবিউট করতে পারে না যাতে কোনরকমে খেয়ে বেচেঁ যায় ওই রিক্সাওয়ালা/ দিনমজুর?
সবার শেষ কথা যে যেভাবে পারেন সাবধান থাকেন।
-সেরকম কোন উপসর্গ দেখা দিলে প্লিজ নিজেকেই নিজে বন্দী করে ফেলুন। (কোয়ারাইন্টেন শব্দটা মানে আমাদের দেশের সব শ্রেণীর মানুষ না ও বুঝতে পারে)। আপনার একটু সাবধানতার জন্য হয়তো বাচঁতে সাহায্য করবে আপনার প্রাণপ্রিয় বাবা-মাকে, আপনার সন্তানকে।
-কিছুদিনের জন্য আড্ডা, দাওয়াত, মসজিদে নামাজ পড়া, ওয়াজ মাহফিলে যোগদান বন্ধ রাখি। (আখেরাতের কাজ কিছুদিন ঘরে করলে এমন কিছু কি ক্ষতি হবে?)
শেষ খবর হলো, ধর্ষনের অভিযোগে অভিযুক্ত পরিচালক হার্ভে উইনেস্টাইন ও করোনায় আক্রান্ত। জেলে থেকেও রক্ষা হয়নি তার।
ভালো থাকুন সবাই আর, ড: এম এ আলী, আহমেদ জী এস, খায়রুল আহসান,শের শায়রী, সোনাবীজ অথবা ধুলোবালিছাই, চাঁদগাজি, নূর মোহাম্মদ নূরু ভাইরা যারা নিজেদেরকে সিনিয়র হিসেবে ভাবতে ভালোবাসে। আপনারা আরেকটু বেশী সাবধানে থাকবেন। নিজেকে বন্দী রাখুন আর নতুন নতুন লিখা লিখুন।
আমি সবসময়ই বিশ্বাস রাখি আর সব কিছুর মতো আমরা অবশ্যই এ ভাইরাসকে রুখে দিতে পারবো, শুধু সময়ের অপেক্ষা।