somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সোহানী
হাজার হাজার অসাধারন লেখক+ব্লগারের মাঝে আমি এক ক্ষুদ্র ব্লগার। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া লেখালেখির গুণটা চালিয়ে যাচ্ছি ব্লগ লিখে। যখন যা দেখি, যা মনে দাগ কাটে তা লিখি এই ব্লগে। আমার ফেসবুক এড্রেস: https://www.facebook.com/sohani2018/

রেসিডিন্সিয়াল স্কুল অব কানাডা: কানাডিয়ান ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়

১৭ ই নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০২১ এর মে মাস, পুরো কানাডা আরেকবার স্তব্ধ হয়ে টিভির পর্দায় দেখছিল ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্স এ সদ্য আবিস্কৃত ২১৫টি আদিবাসী শিশুর কবর, এর মাঝে তিন বছরের শিশুর কবরও ছিল। এ পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ এর মতো শিশুর অচিহ্নিত কবর পাওয়া গেছে বিভিন্ন জায়গায়। এবং এসব শিশুর মৃত্যু বেশীর ভাগই হয়েছে অত্যাচারিত হয়ে, সেক্সুয়াল এবিউজ হয়ে, রোগে ভোগে কিংবা আত্মহত্যা করে।

কিন্তু কেন? কি অপরাধ করেছিল এ ছোট্ট ছোট্ট শিশুগুলো। যাদের থাকার কথা মায়ের কোলে, কোন অপরাধে তাদের অকালে মরতে হলো?

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৮৭২ থেকে ১৯২১ সালের মাঝে। সে সময়ে ব্রিটিশ ক্রাউন কানাডায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু আদিবাসী নেতার সাথে যথারীতি ব্রিটিশ বুদ্ধি খাটিয়ে প্রায় ১১টি চুক্তি করে। এসব চুক্তির অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কানাডায় প্রবেশের অধিকার অর্জন করে এবং এর বিনিময়ে কৃষির জন্য যন্ত্রপাতি ও অর্থের বিনিময়ে জমি ক্রয়ের শর্ত যুক্ত ছিল। অতপর: ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাদের স্বভাবসূলভ দুপাক্ষিক চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একপাক্ষিক বানিয়ে নেয় সই এর পরপরই। এবং সেই সাথে পূর্ণ উদ্যোমে নিজেদের অত্যাচারের কলাকৈাশল এপ্লাই করতে থাকে যথারীতি।



এ উৎপীড়নের ধারাবাহিকতায় ১৮৭৬ সালে কানাডিয়ান পার্লামেন্ট "ইন্ডিয়ান এ্যাক্ট" নামে এ্কটি আইন পাস করা হয়। সে আইনের আওতায় যেমন আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত রিজার্ভের বাইরে কোথাও যেতে পারবে না বা গেলে পারমিশন লাগবে তেমনি আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা দেবার নাম করে নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, শিক্ষা, ধর্ম বা এমন কি পরিচয়ও মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করে।

এ আইনের আওতায় শিশুদেরকে জোরপূর্বক পরিবার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হতো ও ভর্তি করানো হতো ক্যাথলিক চার্চের আওতাধীন রেসিডিন্সিয়াল স্কুলে। ১৮৩১ সাল থেকে ১৯৯৬ সালে বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত প্রায় ১৩৯ রেসিডিন্সিয়াল স্কুল চালু করে বিভিন্ন প্রভিন্স এ। প্রায় ১৫০,০০০ আদিবাসী শিশুকে এক কথায় নির্বাসন দেয়া হয় সেখানে এবং মৃত্যবরণ করে হাজার হাজার শিশু। অন্ধকার অপরিচ্ছন্ন, স্যাতস্যাতে পরিবেশ, বাসি পচাঁ নোংরা খাবার, অনাহার বা অর্ধাহার, রোগ-বিরোগ ছিল এসব শিশুদের নিত্যসঙ্গী। সেই সাথে কানাডিয়ান ভয়াবহ ঠান্ডাতো আছেই। এতো কিছুর সাথে আরো যোগ হতো এসব শিশুদের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্ট বানানো এবং অবলীলায় মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতো এ ছোট ছোট শিশুদের।

আপাত: দৃষ্টিতে "শিশু শিক্ষা" নামের সহজ সরল তকমা আঁটা থাকলেও জটিল ছিল এ রেসিডিন্সিয়াল স্কুলের কাজকর্ম। যেমন বাচ্চাদেরকে যখন নেয়া হতো পরিবার থেকে তখন তাকে আশেপাশের কোন স্কুলে দেয়া হতো না, তাকে দেয়া হতো সর্বোচ্চ দূরের কোন স্কুলে। যাতে তারা কোনভাবেই পরিবারের সংস্পর্শে আসতে না পারে কিংবা বাবা-মা বা পরিবারের কেউ যেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে। নিজেদের নাম, ভাষা, পোসাক, আচরন, ধর্ম সবকিছুই ছিল কঠিনভাবে নিষিদ্ধ সেখানে। কোন শিশু ভুল করে নিজেদের ভাষা বললে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো তাকে, তাদেরকে বলা হতো ওটা শয়তানের ভাষা। আর ওই শয়তানের ভাষায় কথা বলার শাস্তি ছিল ভয়াবহ। এ ধরনের শাস্তি শিশুদেরকে করতো বাকরুদ্ধ, আতংকিত ও ট্রমাটাইজ। সে সব স্মৃতি তারা কখনোই ভুলতে পারতো না। কি কঠিন মানসিক বিপর্যয়ের মাঝে শিশুগুলো যেতো তার ছোট্ একটি উদাহরন পাওয়া যায় Jack Kruger এর বক্তব্যে। জ্যাক রেসিডিন্সিয়াল স্কুল থেকে বেচেঁ ফিরে আসা একজন আদিবাসী। যে আদিবাসীদের অধিকারের লড়াই এর সাথে যুক্ত।

১৯৫৬ এ জ্যাক যখন ৬ বছর বয়স তখন তাঁকে জোরপূর্বক মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে ভর্তি করানো হয় St Eugene স্কুলে। nsyilxcən ভাষা ছিল জ্যাক এর মাতৃভাষা। স্কুলে পৈাছে নিজের ভাষায় কথা বলার অপরাধে তাকে অভুক্ত অবস্থায় চরমভাবে মারধর করা হয়। এবং এর পরবর্তী ৪০ বছর পর্যন্ত জ্যাক কখনই নিজের ভাষায় কথা বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। শুধু তাই নয় এ ৬ বছর বয়সেই সে দেখেছিল তার বন্ধুকে দিনের পর দিন যাজকদের ধর্ষণ এবং অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে শিশুটির আত্মহত্যা। এরকম অসংখ্য মৃত্যু, হত্যা, অত্যাচার তাদেরকে বধির করে দিয়েছিল, তৈরী করেছিল বোধশক্তিহীন প্রানীতে।

স্কুলের ভীতরের চিত্র আর লোক দেখানো বাইরের চিত্র ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। ধর্মগুরুরা পুরো পৃথিবীকে দেখানোর চেস্টা করতো কি অপরিসীম যত্নে তারা সে সব শিশুদের পালন করছে। তাই ঘটা করে বিভিন্ন ছবি তুলতো ও তা প্রচার করতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেল সে সব ছবি কতটা ফেইক। প্রতিটি ছবির পিছনে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অদেখা কষ্ট। আদিবাসী শিশুটির বাবার রক্তের বিনিময়ে আর্জিত সম্পদে যে সময়টিতে ক্রাউন চাকচিক্যময় জীবন কাটাতো সে সময়ে হয়তো অসংখ্য অভুক্ত শিশু ক্ষুধায় কান্না করেছে কিংবা মৃত্যু বরণ করছে।

২০০৮ সালে আদিবাসী ও সাধারন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচারনায় গঠন করা হয় একটি কমিশন, "Truth and Reconciliation Commission of Canada" এবং এ কমিশন রেসিডিন্সিয়াল স্কুলের কাজকর্মকে কালচারাল জেনোসাইড আখ্যা দেয়। যদিও ২০০৮ সালে ফেডারেল গভর্নমেন্ট ক্ষমা চায় এবং পরবর্তীতে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ও দিনের পর দিন ধর্না দেবার পর মাত্রই এ বছর ২০২২ সালে পোপ ফ্রান্সিস রোমান ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রর্থনা করে আদিবাসীর কাছে।

আজো পুরো কানাডাবাসী গভীর কষ্টের সাথে স্মরণ করে সে সব শিশুদের, সে সব পরিবারকে, সে সব দুখী মা-বাবাদের।




এ লিখায় কিছু ছবি শেয়ার করলাম। সব ছবিই নীচের বিভিন্ন লিংক থেকে নেয়া। তবে এর মাঝে উপরের দু'টো ছবির কথা না বললেই নয়। ছবি দু'টিটে পাশাপাশি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে, স্কুলে আসার পরপরই এবং এর কয়েক মাস পরের ছবি। যাতে দেখানো হয়েছে বাচ্চারা কিরকম কেতাদুরস্ত তৈরী হচ্ছে স্কুলের কল্যানে। নীচে Jack Kruger এর বর্তমান ছবি দিলাম পরিবারের সাথে।



সোহানী
নভেম্বর ২০২২


বি:দ্র: গত বছর শুরু করা লিখাটা শেষ পর্যন্ত ইতি টানলাম ফিচার প্রতিযোগীতাকে সামনে রেখে। ফিচার প্রতিযোগীতায় "ইতিহাস" ক্যাটাগরিতে লিখাটা দিলাম। যদিও এ বিষয় নিয়ে আরো অনেক কিছু লিখবো, এখানে শুধুমাত্র প্রাথমিক একটা ধারনা দিলাম।


সূত্র সমূহ:

https://sigmaawards.org/cultural-genocide-the-shameful-history-of-canadas-residential-schools-mapped/
https://indigenousfoundations.arts.ubc.ca/the_residential_school_system/
https://www.theguardian.com/world/ng-interactive/2021/sep/06/canada-residential-schools-indigenous-children-cultural-genocide-map
https://www.scientificamerican.com/article/canadas-residential-schools-were-a-horror/
https://en.wikipedia.org/wiki/Canadian_Indian_residential_school_system#:~:text=In Canada, the Indian residential,and administered by Christian churches.
https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/article/residential-schools
https://www.startresearching.com/blog/indian-residential-schools-a-troubled-history
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৪৭
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×