যাহোক, ছ'মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বিশাল অংকের ফান্ডটা আমরা পেয়েই গেলাম। যেহেতু বিশাল অংকের ফান্ড তাই আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই করার জন্য মন্ত্রী-মিনিস্টার সহ দেশের বেশ হোমড়া-চোমড়ারা পোটলা-পুটলি বেঁধে রওনা দিলেন। আর সাথে আমরা ক'জন চুনোপুটি রওনা দিলাম যারা এ নিয়ে কাজ করেছি। যা বলছিলাম, যেহেতু মন্ত্রী মহোদয় যাচ্ছেন তাই সৈাজন্য উপহার দিতে হয় দাতা সংস্থার প্রধানকে। তো মন্ত্রী মহোদয় এর সেক্রেটারী জানালেন উনিই উপহার কেনার দায়িত্ব নিবেন। আমরাতো মহা খুশি, ঝামেলা মাথা থেকে দূর হলো।
যথারীতি নিজের গাট্টি বোঁচকা বেঁধে টেধে রওনা দেবার আগের দিন মন্ত্রী মহোদয় এর পার্সোনাল সেক্রেটারী, অফিসের বড় স্যারকে ফোন দিয়ে জানালেন উপহার কেনা হয়েছে তবে তা সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের মতো চুনোপুটিদের নিতে হবে। এবং সেখানে পৈাছে তা উনার হোটেল হস্তান্তর করার জন্য যথারীতি আদেশ দেয়া হলো। উপায় নাই হোলাম হোসেন.... তাই বড় স্যার আদেশ দিলে মাঝারি স্যারকে উপহার কালেক্ট করার জন্য। তো সেই মাঝারি স্যার পড়ি কি মরি হয়ে ছুটলেন সচিবালয়ে। আর আমাদেরকে পরেরদিন যথারীতি এয়ারপোর্টে হাজিরা দিতে বললেন। এবং আরো জানালেন উনি উপহারটা নিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যাবেন।
যাহোক, পরদিন এয়ারপোর্টে পৈাছেই দূর থেকে দেখি আমার মাঝারি স্যার ইয়া বড় একটা আড়ং এর প্যাকেটে রেপিং সহ বাঁধাই করা ছবি ট্রলিতে ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে যাচ্ছেন। একদিকে বিশাল দুই ব্যাগ, অন্যপাশে বিশাল ছবি সামলাতে উনার জান কাবাব হয়ে যাচ্ছে। এক হাতে ছবি ধরলে ব্যাগ কাঁত হয়ে পরে যাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যাগ ধরলে ছবি কাঁত হয়ে পরে যাচ্ছে। আর যেহেতু স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয় এর দেয়া উপহার তাই বেচারা জীবন বাজি রেখে তা সামলিয়ে চলছে। আর আমি দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে উল্টা দিকে ভোঁ দৈাড়। কারন আমি মনে মনে হিসাব কষছি, এ গ্রপের সর্ব কনিষ্ঠ আমি। অফিসিয়াল পজিশানে বড় হলেও সাইজে এবং বয়সে সবচেয়ে ছোট। তাই কোনভাবে আমাকে সামনে পেলে এ ডায়নোসার আমাকে ধরিয়ে দিবে। তাই আমি তক্কে তক্কে ছিলাম উনার ব্যাগটা চেক ইন হয়ে গেলে ঝামেলা শেষ আমি হাজির হবো সবার সামনে।
এভাবে এয়াপোর্টের অলিগলি ঘুরে আমি সবার শেষে চেক ইন করে প্লেনে উঠে দেখি বিশাল জটলা। একটু উঁকি দিয়ে দেখি আমার মাঝারি স্যার সে বিশাল ছবির প্যাকেট মাথার উপরের লাগেজ ব্যাগে উঠানোর চেস্টা করছেন। আর উনাকে সাহায্য করার চেস্টা করছে দুই সুন্দরী বিমানবালা। কিন্তু তারা বার বার বলছে, এত বড় প্যাকেট কোনভাবেই উপরে জায়গা হবে না, আপনি আপনার সাইডে রাখুন। কিন্তু স্যার কোনভাবেই শুনবে না, বার বার বলে যাচ্ছেন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এর উপহার, এটা কোনভাবেই নীচে সাইডে রাখা যাবে না। এটা নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে টানা হ্যাচড়ার মাঝে, এবং দীর্ঘ লাইনের জটলা হয়ে যাওয়াতে সুন্দরী বিমানবালারা ছবির প্যাকেটটা পাশে রেখে স্যারকে এক সাইডে সরে যেতে বলেন যাতে সবাই ঢুঁকতে পারে। তা দেখে আমি চোখ বন্ধ উল্টো দিকে ভো দৈাড়। হেঁটে পরের সারিতে চলে যাই এবং চুপচাপ নিজের সিট খুঁজে চোখ বন্ধ করে বসে পরি।
সেবার আমরা গিয়েছিলাম এ্যামিরাটস্ এ। তাই সর্ট জার্নি শেষে দুবাই পৈাছাই। দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদেরকে প্রায় সাড়ে আট ঘন্টার ট্রান্জিট তাই হোটেল পাবো না, এয়ারপোর্টেই রাত কাটাতে হবে। অত:পর চেক আউট করতে করতেই দেখি স্যারের সাথে দেখা। বেচারা সারারাত এ ছবরি প্যাকেট ধরে বসে ছিল কোনভাবেই হাতছাড়া করেনি। যদি কেউ এটা নষ্ট করে ফেলে সেই ভয়ে। যার কারনে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি। আমিতো উনাকে দেখে আকাশ থেকে পড়লাম। স্যার, আপনি এতো বড় ছবিটা নিয়ে ঘুরছেন কেন? লাগেজে দেননি কেন? স্যার জানালেন, এটা সাইজে অনেক বড় তাই লাগেজে নেয়নি। তারপরও তারা জানালো, লাগেজে দিলে এটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে তাই হাতে নেয়াই ভালো।
আমি আহারে উহারে বলে কোন চিপা থেকে পালানো যায় তার পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু স্যার আমাকে বললেন, আপনি একটু প্যাকেটটা ধরবেন, আমি বাথরুমে যাবো। সারারাত প্যাকেটটা ধরে বসে ছিলাম বাথরুমেও যেতে পারিনি। এ শুনে পাশ থেকে একজন হোমড়া চোমড়া বলে উঠলেন, ঠিক করেছেন। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এর উপহার বলে কথা। একটু রকমফের হলেইতো বান্দরবনে ট্রান্সফার......
কি আর করা, হাতের লাগেজটা পাশে রেখে অতি যত্নে ছবিটা ধরে রাখলাম যাতে কোনভাবেই তা ব্যাথা না পায়। এভাবে কিছুক্ষন দাঁড়ালাম, আরো কিছুক্ষন দাঁড়ালাম, তারপর অনেকক্ষন দাঁড়ালাম কিন্তু স্যার মহোদয়ের আর দেখা নাই। আমি বুঝিতে পারিলাম, ইহা সেই রুপকথার গল্পের মতো। তুমি যাহাকে ছুঁইবে সেই পাথর হইয়া যাইবে ও তোমার মুক্তি মিলিবে...........। এদিকে আমি ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কাঁন্দে অবস্থা। এ বোঝা ফেলেও যেতে পারছি না, কাঁধে নিয়ে ঘুরতেও পারছি না। প্রথমে ফ্লোরে বসে পড়লাম, তারপরে কাঁত হয়ে শুয়ে পড়লাম অত:পর। কতক্ষন আর দাঁড়ায়ে থাকা যায়। প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর ছবিটা বোগলদাবা করিয়া গাঁটতি বোঁছকা সহ আল্লাহর নাম নিয়া উনাকে খুঁজতে বাহির হইলাম।
এক হাতে বিশাল ছবির প্যাকেট, অন্য হাতে ট্রলি ব্যাগ, পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ, অন্য কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ........... আমি মোটামুটি হিমালয় পর্বত ঠেলা শুরু করলাম। বিশাল দুবাই এয়াপোর্টের এ গলি থেকে ও গলিতে খুঁজতে লাগলাম। মনে হলো একবার চিৎকার দিয়া ডাকি, স্যারগো কই গেছেন গা!!! আরেকবার মনে হইলো, চাকরীর গুষ্ঠি কিলাই। এটারে গার্বেজে ফেলে দেই। যাহোক, আমার এ দূরবস্থা দেখিয়া একজন ভদ্রলোকের বেশ দয়া হলো। সে দেখি কোথা থেকে একটা ট্রলি এনে আমাকে দিয়ে বললো, টেক ইট। ইট উইল হেল্প ইউ। আরে তাইতো, এ সহজ বুদ্ধি এতক্ষন কই ছিল!!!! তাহারপর সে ট্রলি ঠেলিয়া রাস্তায় রাস্তায় খুঁজতে শুরু করলাম। প্রায় ৪০ মিনিট খোঁজার পর দেখি উনারা ম্যাক এ বসে বার্গার খাচ্ছেন আয়েশে। আমি পাশে অগ্নিমূর্তি নিয়া দাঁড়াইতে স্যার বললেন, ক্ষিধা পেয়েছিলতো তাই চলে এলাম খেতে। আমি ছবিটা তার পাশে দিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। আর তা দেখে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? আমি গম্ভীর হয়ে বল্লাম, বাথরুমে!!!
এরপর থেকে হোটেলে পৈাছানো পর পর্যন্ত আমি আর উনার আশে পাশে হাঁটি নাই। পরদিন অফিসে যাবার জন্য রেডি হয়ে নীচে যেয়ে দেখি লবিতে সবাই জটলা বেধেঁ আছে। কি ব্যাপার কোন ঝামেলা? এমন সময় বড় স্যার বলে উঠলেন, গিফটটাতো মাঝারি স্যার সাহেব বহন করে এনেছেন কিন্তু এভাবে আনতে আনতেতো এর রেপিং ছিঁড়ে গেছে। এখন এ ছেঁড়া রেপিং এ মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এর উপহারতো আর এভাবে দেয়া যায় না। দেখুনতো আপনি কিছু ব্যাবস্থা করতে পারেন কিনা? কারন উনি জানেন আমি হইলাম সব মুশকিলের আসান.......... হাহাহাহা। কি আর করা ছবিটা আবার মাথায় করে রুমে রেখে আসলাম।
অফিস শেষ করে জেনেভার এক অফিস কলিগকে বল্লাম, কওতো কোথায় রেপিং পাবো। সে খুব একটা গুড়ুত্ব দিলো বলে মনে হলো না। বললো, এ আর এমন কি সবখানেই পাবা। অফিসের উল্টা দিকে Balexert, Geneva Shopping Centre। সেখানেই পাবা।
অফিস থেকে বের হয়ে সেই শপিং সেন্টারের দিকে হাঁটা দিলাম। হায়, সে বিশাল শপিং সেন্টারের অলিতে গলিতে ঘুরে কোথাও রেপিং পেলাম না। যেখানেই জিজ্ঞেস করি তারা বলে গিফট কিনলে আমরা রেপিং ফ্রি করে দেই। কিন্তু আলাদাভাবে এটা করি না। হায় হায় কি অবস্থা........। এভাবে দোকানে দোকানে জনে জনে জিজ্ঞাসা করতে করতে একজন একটু দিসা দিলো যে তুমি কুওপ এ যেয়ে দেখতো পারো। সুইজারল্যান্ডে চেইনসপ কুওপ খুব জনপ্রিয়, অনেকটা আমাদের ওয়ালমার্টের মতো।
তারপর সেখানে যেয়ে দেখি একই অবস্থা। তারাও তা বিক্রি করে না। এভাবে ঘন্টা খানেক কুওপ এর এখানে সেখানে ঘুরে বুঝলাম এইভাবে হইবেক না, আমাকে অন্য পথ ধরিতে হইবে..........। অত:পর ক্যাশ কাউন্টারে এসে দাঁড়ালাম। তারপর ক্যাশের মেয়েটাকে কাঁদো কাঁদো সুরে বল্লাম, দেখো আমি খুব বিপদে পড়েছি। তুমিই একমাত্র আমাকে উদ্ধার করতে পারো। তারপর তাকে কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা, কিছু করুন কাহিনী তুলে ধরলাম। এবং আরো বলিলাম, এইটা আমাগো দেশের মান-ইজ্জতের প্রশ্ন। এখন একমাত্র তুমিই পারো আমারে উদ্ধার করিতে....। আমার বিশাল বক্তব্য এবং সেই সাথে করুন চাহনী দেখে মেয়েটি সাথে সাথে আমাকে দুইটা রেপিং পেপার দিয়ে দিলো। শুধু তাই না, সাথে ছোট একটা কাঁচি, স্কচটেপ সবই দিয়ে দিলো ফ্রি। টাকা দিতে চাইলে বললো, ইটস্ গিফট্ ফ্রম মি।
অত:পর উপহার কাহিনীর এভাবেই মধুর সমাপ্তি ঘটিল।
সবাইকে ধন্যবাদ এ দীর্ঘ লিখাটি পড়ার জন্য।
সোহানী
জুলাই ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২৩ সকাল ৭:১৪