আমি বরাবরেই মেয়েদের এবিউজ নিয়ে লিখি। কিন্তু বাস্তবতা হলো মেয়েদের পাশাপাশি অনেক পুরুষও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়। মেয়েদের নির্যাতন নিয়ে যত সহজে কথা বলা যায় ছেলেদের বেলায় তত সহজে বলা যায় না। কারন সবাই ধরেই নেয় এবিউজ আর মেয়ে সমার্থক শব্দ। ছেলেরা এবিউজ হতেই পারে না, যদি হয় তাহলে এটা তার ব্যার্থতা।
যার কারনে নির্যাতন নিয়ে খুব কম ছেলেরাই মুখ খুলে বা এ থেকে বেরিয়ে এসে তা জনসমক্ষে জানায়। এদিকে আমাদের দেশে জন্ম থেকেই শেখানো হয় বউ যে পুরুষ চালাতে পারে না সে আবার পুরুষ নাকি সেতো হিজরা। যার কারনে পুরুষ শ্রেনী তাদের পুরুষত্ব বাঁচাতে নির্যাতনের বিষয় নিয়ে সহজে কথা বলে না।
যাহোক, আমি বিশ্বাস করি নির্যাতন মানে নির্যাতন। সেটা যেখানেই ঘটুক, যেভাবেই ঘটুক তা নিয়ে অবশ্যই কথা বলতেই হবে, সোচ্চার হতেই হবে। এ নির্যাতনকারী স্বামী কিংবা স্ত্রী বা সন্তান অথবা বাবা-মা, যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে নতুবা নির্যাতন করাকেই স্বাভাবিকই ধরে নিবে ও নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিবে।
এমন কিছু চিত্র আমি আমরা চারপাশে খুব সহজেই দেখতে পাই কিন্তু খুব কমই আলোচনা করি। এ নিয়ে সোচ্চার হওয়া অবশ্যই জরুরী। আমার দেখা এমন কিছু পুরুষ নির্যাতনের চিত্র নিয়ে আসলাম এবার। শুনি তাহলে??
ঘটনা: ১
আমার এক ক্লায়েন্টকে কখনই একা আসতে দেখিনি। সে যখনই অফিসে আসতো তার দশাসই স্ত্রী ও মেয়ে তার দু'পাশে তাকে ঘিরে থাকতো। সে চুপচাপ মাথা নীচু করে চেয়ারের এক কোনায় বসে থাকতো। তার টাকা পয়সা হিসাব নিকাশ সবই তার স্ত্রী আর মেয়েই সামাল দিতো। আমি খুবই অবাক হতাম যে কানাডার মতো জায়গায় সাধারনত সবাই নিজেই নিজের টাকা পয়সা সম্পত্তি ডিল করে, নিজের হিসাব নিকাশ নিজেই রাখে। অথচ ভদ্রলোক কিছুই বলতে গেলে জানে না তার টাকা পয়সার খবর। যতক্ষন অফিসে থাকে পুরো সময়টায় একটাও কথা বলে না। বা কখনো বলার চেস্টা করলে তার স্ত্রী তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করে। একদিন কথায় কথায় জানলাম এই কন্যাটি ভদ্রলোকের বর্তমান স্ত্রীর আগের স্বামীর।
বেশ ক'দিন পর একদিন হঠাৎই ভদ্রলোক অফিসে হাজির একা। এলোমেলো পোষাক, অস্থির অস্থির অবস্থা চেহারায়। একটু অবাক হয়েছি কারন সবসময়ই ভদ্রলোক বেশ ফিটফাট ভাবে অফিসে আসতো। বসতে বলে কেন এসেছে জানতে চাইলাম। ভদ্রলোকতো প্রায় কাঁদো কাঁদো দশা। যা বললো তার সংক্ষেপ হলো, বছর দুয়েক হলো এ মহিলাকে বিয়ে করেছেন আগের স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে। তারপর ভদ্র মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতে উঠে আসে। জীবনে যা আয় করেছে ও সঞ্চয় করেছে এ দুই বছরে সে সবই প্রায় নিয়ে গেছে তার নতুন স্ত্রী ও কন্যা। এখন এ মহিলা ডিভোর্স ফাইল করেছে ও এই বাড়ি সহ তার বাকি সম্পত্তি দাবী করেছে। কারন কানাডীয় আইনে ডিভোর্সের পর স্ত্রী বা স্বামীর অর্জিত সব সম্পত্তিই অর্ধেক অর্ধেক ভাগ হয়। তাই এসেছে পরামর্শের জন্য এখন এমন কিছু কি করা যায় যাতে কিছুটা হলেও তার এ সম্পদ রক্ষা পায়?
ঘটনা: ২
আমার এক বস ছিলেন বেশ নরম সরম মানুষ। বিয়ে করেছিলেন পুরান ঢাকার এক আদি জমিদার কন্যাকে। যেদিন বেতনের চেক হতো সেদিন দেখতাম উনার স্ত্রীকে রুমে বসে আছে । অসম্ভব সুন্দরী, চাল চলনে যেকোন নায়িকা ফেইল। একদিন কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাবী কেন ঠিক নির্দিষ্ট এ দিনে আসে। তখন উনি জানালেন টাকা নিতে আসে কারন পার্লার, শাড়ির দোকান, জুয়েলারীর দোকানে সারা মাস যা কিনে তা জমা করে মাস শেষে আমার কাছ থেকে নিয়ে বিল পে করে। আমাকে উল্টো জানতে চাইলো আমি কিভাবে মাসের বিল দেই?
আমি হেসে উত্তর দিলাম, ছয়মাসে একবার শুধু চুল কাটতে পার্লারে যাই। কয়েক মাসে একটা সেলোয়ার কামিজ কিনি না। আর বিয়ের পর এ পর্যন্ত এক ফোটাও সোনার গয়না বানাইনি।
উনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, সাপ্তাহিক ফেসিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউর কিভাবে করেন?
আমি হাসতে হাসতে জানালাম, এ জীবনে পার্লারে মেনিকিউর, পেডিকিউর কিরিনি। ফেসিয়াল মনে হয় জীবনে একবার করেছিলাম।
ভদ্রলোক পুরোপুরি অশ্বিাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বললো, কিভাবে তা সম্ভব?
তারপর তার অবস্থা জানালেন, সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের কাড়াকাড়িতে পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখে না তার স্ত্রী। কিন্তু এদিকে তার রাজকীয় অভ্যাস সামাল দিতে তার জান কাবাব। স্ত্রী কোনভাবেই বুঝতে চান না টাকা নাই শব্দটা। স্ত্রীর কথা, টাকা জোগাড়ের দায়িত্ব তোমার, কিভাবে আনবে সেটা আমার দেখার বিষয় না।
ঘটনা: ৩
ছেলেটি অসম্ভব মেধাবী কিন্তু হঠাৎ বাবা মারা যাওয়াতে ছোট ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব কাঁধের উপর পড়ে। ক্লাসে বরাবরেই ভালো ছাত্র ও ভালো ছেলে ছিল। ক্লাসের যে মেয়েটি সবসময়ই তার বড়লোকী ভাব ধরে চলতো আর টিচারদের রুমে রুমে দৈাড়াতো সে মেয়েটির প্রেমে পড়লো ছেলেটি। হয়তো ছেলেটি ভেবেছিল তার পরিবার বা নিজের ভবিষ্যতে মেয়েটির সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু বিয়ের পর দেখা যায় সবই ফাঁকা বুলি। শশুড় সাহেব সামান্যই চাকরী করেন এবং বছরের মাঝে রিটায়ারমেন্টে চলে যান। উল্টো শশুড় বাড়ির দায়িত্ব তার উপর কাঁধে পড়ে। সামান্য আয়ে স্ত্রীর সীমাহীন চাহিদা, মা ও ভাই-বোনদের দেখাশোনা, শশুড়বাড়ির দায়িত্ব.... এ সব কিছুর সাথে যোগ হয়েছে স্ত্রীর সাথে তার পরিবারের সম্পর্কের টানাপোড়া। এবং তাকেই মাঝ থেকে সবার সম্পর্কের জট খুলতে হয়। এতো কিছু করতে যেয়ে ছেলেটির প্রায় পাগল হবার জোগাড়। অমানুষিক কষ্টের মাঝে ছেলেটিকে যেতে দেখেছি কিন্তু কখনো অভিযোগ করতে শুনিনি।
ঘটনা: ৪
ভদ্রলোক বলতে গেলে এক কথায় বহু কাঠখোড় পুড়িয়ে কানাডায় আসেন। তারপর রিফিউজি কোটা থেকে তিলতিল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এখানে। নিজে দাড়াঁনোর পরপরই ভাই-বোনদেরকে যেভাবে পেরেছেন নিয়ে এসেছেন কানাডায়। আর এভাবে আনতে যেয়ে বলতে গেলে শূণ্য হয়েছেন বারবার। তারপর এক সময় মায়ের পছন্দে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। দেশ থেকে আনা স্ত্রী তেমন কিছুই জানেন না তাই বলতে গেলে স্ত্রী কোন জব জোগাড় করতে পারেননি এখানে, পুরোপুরি সংসারী। যাহোক, তাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পরই সমস্যা বাঁধে। কারন স্ত্রী তার বাবা-মা ভাই-বোনদেরকে এখানে আনার বায়না ধরেন। স্ত্রীর আবদার রাখতে ভদ্রলোক মধ্যবয়সে সীমাহীন পরিশ্রম করে বাকিদেরকে আনেন এবং বলতে গেলে শূণ্য হাতে রিটায়ারমেন্ট এ যান। কিন্তু তখন সেই স্ত্রীই তাকে সীমাহীন গন্জনা দিতে থাকে কেন তার কোন সম্পত্তি নেই? ননদ দেবরদের কেন আনলো? অথচ মহিলার নিজের পরিবারকে এনেছে সেটা নিয়ে কথা বলে না। এমন কি তার দুই সন্তানও একইভাবে বাবাকে ব্লেইম করতে থাকে। আমি সেই ভদ্রলোকের সীমাহীন মানসিক অর্থনৈতিক দূর্দশা দেখেছি কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করতে দেখেনি।
ঘটনা: ৫
খুব নামকরা ডাক্তার ছিলেন তিনি। স্ত্রীও ছিলেন ডাক্তার। ভালো জব অফার নিয়ে সৈাদিতে যেতে চাইলে স্ত্রী রাজি হননি নিজের চাকরী ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে। সে তিক্ততা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ায়। ডিভোর্স দিয়েই ভদ্রলোক আবার বিয়ে করে সৈাদিতে চলে যান দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। সৈাদিতে থাকা অবস্থায় তার ক্যান্সার ধরা পরে ও উনাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। দেশে ফিরে ভদ্রলোক চাচ্ছিলেন উন্নত কোন দেশে যেয়ে চিকিৎসা শুরু করবেন কিন্তু বাঁধ সাধেন উনার দ্বিতীয় স্ত্রী। মহিলা কোনভাবেই উনার চিকিৎসা করার জন্য বিদেশে যেতে দিতে রাজি হননি। কারন এতে অনেক টাকা চলে যাবে এবং সে মারা গেলে তেমন কোন টাকা পয়সা অবশিষ্ট থাকবে না। এবং এক পর্যায়ে ভদ্রলোক প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। যে ক'দিন বেঁচে ছিলেন তার সীমাহীন দূর্ভোগ দেখেছি।
ঘটনা: ৬
ছেলেটি বেশ মেধাবী ছিল ও ভালো চাকরী করতো ও সহকর্মীর প্রস্তাবে তার অল্পবয়সী বোনের সাথে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়ের পরপরই সব হিসেব নিকেশ পাল্টে যায়। মেয়েটি কোনভাবেই তার শশুড়বাড়ির কাউকেই পছন্দ করতে পারেনি। যার কারনে প্রচন্ড একটা বৈরী পরিবেশ তৈরী হয় পরিবারে। মাঝখান থেকে ছেলেটি না পারছিল মা-বোনদের মন রক্ষা করতে না পারছিল বউয়ের মন রক্ষা করতে। দু পাশের চাপে তার অবস্থা ছিল চ্যারাচ্যাপ্টা।
এরকম চরিত্র কম বেশী আমরা দেখি। যদিও নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান অনেক বেশী কিন্তু তাই বলে পুরুষ নির্যাতনের পরিসংখ্যানও কম নয়। ১৩.৯% ছেলেরা বা প্রতি ৭ জনে ১ জন ও ২৭% মেয়েরা বা প্রতি ৪ জনে ১ জন পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার হয়।
সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ হোক ও সুন্দর হোক আমাদের পারিবারিক বন্ধন এ প্রত্যাশায়।
সোহানী
জুলাই ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২৪ সকাল ৮:৪৪